E-Paper

সত্যিই যুদ্ধ থামল কি

১৯৪৭-৪৮ সালে ওয়াজিরিস্তান থেকে ট্রাইবাল লস্কর পাঠিয়ে জম্মু-কাশ্মীর জোর করে দখল করার চেষ্টা করে।

অশোক কুমার লাহিড়ী

শেষ আপডেট: ১৪ মে ২০২৫ ০৭:১২
ফয়সালা: প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে যুদ্ধবিরতি সংক্রান্ত বৈঠক। ১০ মে, নয়াদিল্লি।

ফয়সালা: প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে যুদ্ধবিরতি সংক্রান্ত বৈঠক। ১০ মে, নয়াদিল্লি। ছবি পিটিআই।

১০ মে সন্ধ্যা ৫টায় যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করল ভারত ও পাকিস্তান। অনেকেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন। কিন্তু এই বিরতি কি সাময়িক না দীর্ঘস্থায়ী, এই প্রশ্নও থাকে। এ প্রসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ দু’টি প্রশ্ন— পাকিস্তান কেন যুদ্ধ করে, এবং ভবিষ্যতে কি আবার যুদ্ধ করবে?

এটা ছিল পাকিস্তানের অঘোষিত যুদ্ধ। পাকিস্তান-সমর্থিত সন্ত্রাসবাদের মাধ্যমে ভারতের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধ বহু দিন ধরে চলছে। যেমন, ২০০১ সালে দিল্লিতে সংসদে, এবং ২০০৮ সালে মুম্বইয়ের তাজ হোটেলে ২৬/১১-র হামলা। ধর্মের ভিত্তিতে ২৬ জন নিরীহ পর্যটককে গুলি করে হত্যা— এটাও সেই অঘোষিত যুদ্ধেরই আর একটি প্রকাশ। ভারতের পক্ষে অবস্থা অসহনীয় হয়ে ওঠে।

কেন্দ্রীয় সরকার জানিয়েছে যে, ভারত সীমান্ত না পেরিয়ে ৭ মে পাকিস্তান-অধিকৃত কাশ্মীরে ছ’টি জায়গায় (মুজফ্ফরাবাদ, কোটলি, রায়োলাকোট, চকশ্বরী, ভীমবর, এবং নীলম ভ্যালি) এবং পাকিস্তানের পঞ্জাব প্রদেশের তিনটি জায়গায় (ঝেলাম, চাকবাল এবং বাহাওয়ালপুর) সন্ত্রাসবাদীদের ঘাঁটি মিসাইল আক্রমণে বিধ্বস্ত করে। বদলা নিতে পাকিস্তান ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকায় গোলাবর্ষণ করে, এবং কিছু সামরিক ঘাঁটিতে মিসাইল এবং ড্রোন আক্রমণ চালায়। উত্তর-প্রত্যুত্তর চলতে থাকে। সমগ্র পৃথিবী উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়ে। যুদ্ধবিরতিতে সে উৎকণ্ঠার প্রশমন হয়েছে। কিন্তু, সত্যিই কি শেষ হল, না কি ‘শেষ হইয়াও হইল না শেষ’?

আমাদের সঙ্গে পাকিস্তানের এই যুদ্ধং দেহি মনোভাব প্রায় জন্মলগ্ন থেকেই দেখা দিয়েছিল। মুসলমান-প্রধান হওয়া সত্ত্বেও, কাশ্মীরের ইসলামি পাকিস্তানে যোগ না দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ ভারতে শামিল হওয়াটা পাকিস্তান ভাল মনে মেনে নিতে পারেনি। ১৯৪৭-৪৮ সালে ওয়াজিরিস্তান থেকে ট্রাইবাল লস্কর পাঠিয়ে জম্মু-কাশ্মীর জোর করে দখল করার চেষ্টা করে। গিলগিট, বাল্টিস্তান-সহ জম্মু-কাশ্মীরের অনেক অংশ জোর করে দখল করে তাকে ‘আজ়াদ কাশ্মীর’ নাম দিয়ে শাসন করেছে এবং করছে। সেই নিয়ে হয় প্রথম ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ। তার পর বহু দিন ধরে আন্তর্জাতিক স্তরে কাশ্মীর নিয়ে অনেক বিতর্ক চলেছে। আন্তর্জাতিক মহলে পাকিস্তান হালে পানি পায়নি— তাদের নৈরাশ্য বেড়েছে। ১৯৬৫ সালে অপারেশন জিব্রাল্টারের মাধ্যমে আবার চেষ্টা করেছে কাশ্মীর দখল করতে। তাতে অবশ্য স্থিতাবস্থার কোনও নড়চড় হয়নি।

পাকিস্তান আমাদের স্বাধীন ভারতের, ১৯৪৭ সালে জন্মের সময়ই হারিয়ে যাওয়া যমজ সহোদর। এর সৃষ্টি পাকিস্তানের কায়েদ-ই-আজ়ম মহম্মদ আলি জিন্না সাহেবের দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে। জিন্না আদতে দেশভাগ চেয়েছিলেন, না কি একটি বিকেন্দ্রিত মিলিত দেশ চেয়েছিলেন; স্বাধীনতার পর পাকিস্তানে একটি মৌলবাদী ইসলামিক রাষ্ট্রব্যবস্থা হবে চেয়েছিলেন, না কি একটি আধুনিক দেশ চেয়েছিলেন, সে সম্বন্ধে বিতর্ক রয়েছে। সেই বিতর্ক ইতিহাসবিদদের জন্য; আমাদের আজকের আলোচ্য নয়। কিন্তু, মার্ক্সিস্টদের পরিভাষায় ধর্মনিরপেক্ষ ভারত এবং মৌলবাদী পাকিস্তান হচ্ছে থিসিস আর অ্যান্টিথিসিস। মারাত্মক ভাবে পরস্পরবিরোধী দু’টি তত্ত্বের— দ্বিজাতি তত্ত্ব নয়, দেশের ধারণাগত তত্ত্বের— ভিত্তিতে সৃষ্ট পাকিস্তান এবং ভারতের দ্বন্দ্ব এক দিক থেকে খুবই স্বাভাবিক ছিল। ১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে দেশ ভাগ করে যে বিষবৃক্ষ ইংরেজরা রোপণ করে গিয়েছিল, ইসলামিক পাকিস্তানের ভারতের প্রতি যুদ্ধং দেহি মনোভাব তারই ফল।

স্বাধীনতার ৭৮ বছর পরেও ভারতে সংখ্যালঘু মুসলমান ধর্মাবলম্বী মানুষের সংখ্যা পাকিস্তানের মুসলমানদের থেকে মাত্র একটু কম। দ্বিজাতি তত্ত্বকে মান্যতা দিয়ে আমাদের সংখ্যালঘুরা পাকিস্তানে ছুটে-ছুটে যাওয়ার প্রচেষ্টা করছেন না। সাম্প্রতিক সংঘর্ষের সময় আমাদের সামরিক বাহিনীর প্রবক্তা এক মুসলমান নারী কর্নেলের নির্ভীক ও স্পষ্ট বার্তায় দ্বিজাতি তত্ত্বের সারবত্তার কোনও আভাস মেলেনি। জিন্না পাকিস্তান সৃষ্টির ১৩ মাসের মধ্যে প্রয়াত হন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা, বালুচিস্তানের এবং খাইবার-পাখতুনখোয়ার বিদ্রোহ তাঁকে দেখে যেতে হয়নি। এই সব ঘটনা তাঁর পক্ষে খুবই মর্মান্তিক হত। জানি না, তিনি এগুলি দেখলে দ্বিজাতি তত্ত্বকে ত্রিজাতি, চারজাতি কিংবা আরও বেশি জাতি তত্ত্বে পরিণত করতেন কি না।

বিগত ৭৮ বছরে ভারতের সঙ্গে পশ্চিম প্রান্তে পাকিস্তানের ভৌগোলিক দূরত্ব বাড়েনি, কিন্তু রাজনৈতিক, আর্থিক এবং সামাজিক বিবর্তনে ব্যবধান অনেক বেড়েছে। প্রথম, বঙ্গোপসাগরের উপকূলে, পশ্চিমবঙ্গের পূর্বে অবস্থিত পূর্ব পাকিস্তান এখন স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশ। দ্বিতীয়, স্বাধীনতার পর বহু বছর পাকিস্তান ভারতের থেকে তুলনামূলক ভাবে ‘ধনী’ দেশ ছিল। ১৯৯৬ সালেও, পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় ভারতের প্রায় দেড়গুণ ছিল। ২০২৪ সালে সেটা ভারতের ৬০ শতাংশের কাছাকাছি। ১৯৯০-এর দশকেও বৈদেশিক মুদ্রার অনুপাতে পাকিস্তানি টাকার মূল্য ভারতীয় টাকার সমান বা বেশি ছিল— আর, আজ ভারতীয় টাকার দাম পাকিস্তানি টাকার তিন গুণ। ১৯৯১ সালের পর থেকে, বৈদেশিক মুদ্রার সঙ্কটের জন্য ভারতকে আর আন্তর্জাতিক অর্থ ভান্ডারের দ্বারস্থ হতে হয়নি। পাকিস্তান ১৯৯১ সালের পর সাম্প্রতিকতম ঋণ নিয়ে মোট বারো বার অর্থ ভান্ডারের শরণাপন্ন হয়েছে। ভারতের বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডার ৬৮,৬৮৬ কোটি ডলার— সেখানে পাকিস্তানের ভান্ডারে আছে ১৫৬ কোটি ডলার; যা বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ এবং আমদানি চালু রাখার জন্য অপ্রতুল।

দ্বিতীয় প্রশ্ন, ভবিষ্যতে কি পাকিস্তান আবার ভারতের উপর সন্ত্রাসবাদী আক্রমণ চালাবে? সেটা নির্ভর করছে বেশ কয়েকটি প্রশ্নের উত্তরের উপরে— কত দ্রুত পাকিস্তানে সামরিক বাহিনীর আওতা থেকে বেরিয়ে গণতান্ত্রিক সরকার গঠন হবে; সেই সরকার পাকিস্তানে মৌলবাদী সন্ত্রাসের ঘাঁটিগুলিকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারবে কি না; এবং পাকিস্তানের জনগণের মঙ্গলের জন্য উন্নয়নের কাজে মনোনিবেশ করবে কি না। উন্নয়নের নিরিখে ভারত পাকিস্তানের থেকে অনেক এগিয়ে। এতে যমজ ভাইয়ের ঈর্ষা এবং গাত্রদাহ অবাঞ্ছিত হলেও স্বাভাবিক। পাকিস্তানে উন্নয়নের অভাব ঢাকতে ভারতকে জুজু বানানো একটি সহজ পন্থা। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, পাকিস্তান একটি ফ্র্যাজাইল বা ভঙ্গুর দেশ। কেউ কেউ বলেন, ব্যর্থ রাষ্ট্র। পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগ নিয়ে নিজেদের বাজেট, অস্ত্র সংগ্রহ এবং সুযোগ-সুবিধা গুছিয়ে নিতে ব্যস্ত। এই অবস্থায় ভারতকে চরম শত্রু হিসাবে দেখানোটা তাদের একটি প্রবল ভাবে কার্যকর কৌশল।

অন্য দিকে, ভারত নিজের উন্নয়ন ত্বরান্বিত করে ‘বিকশিত ভারত’ হওয়ার সাধনায় রত। পাকিস্তানের জনগণ, বিশেষ করে বুদ্ধিজীবীদের বোঝা উচিত যে, প্রতিবেশীর বাড়িতে কেউ আগুন চায় না। ভারত সরকারি ভাবে ঘোষণা করেছে যে, ভারত যুদ্ধ চায় না। কিন্তু পাকিস্তান যদি যুদ্ধ চায়, তবে যুদ্ধ করতেও ভারত পিছপা হবে না। আর, পাকিস্তানের সন্ত্রাসবাদী আক্রমণকে যুদ্ধের সমতুল গণ্য করা হবে।

তা হলে প্রশ্ন, ভবিষ্যতে কি পাকিস্তান আবার ভারতের উপর সন্ত্রাসবাদী আক্রমণ চালাবে? সেটা নির্ভর করবে কত দ্রুত পাকিস্তানে সামরিক বাহিনীর আওতার থেকে বেরিয়ে গণতান্ত্রিক সরকার গঠন হবে, সেই সরকার পাকিস্তানে মৌলবাদী সন্ত্রাসের ঘাঁটিগুলিকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারবে এবং পাকিস্তানের জনগণের মঙ্গলের জন্য উন্নয়নের কাজে মনোনিবেশ করতে পারবে। কাজটা সহজ নয়। সন্ত্রাসবাদীরা মার্কণ্ডেয় পুরাণের রক্তবীজের মতো। পাকিস্তান ওদের সমূলে উৎপাটিত না করলে ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের দানবের মতো সন্ত্রাসবাদীরা নিজের স্রষ্টাকেও ধ্বংস করে ফেলবে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

India Pakistan Relation ceasefire

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy