Advertisement
E-Paper

নীতি যখন নিরামিষ

সম্ভবত এ হল সব বিদেশি জিনিসকে দিশি করে দেখানোর প্রবণতার এক চরম দৃষ্টান্ত।

নীলোভা রায়চৌধুরী

শেষ আপডেট: ০৩ জানুয়ারি ২০২২ ০৮:৫১
Share
Save

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সফরের সময়ে তাঁর সম্মানে যে নৈশভোজ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, সেখানে পরিবেশন করা হয়েছিল কালো গাজরের ‘ক্যাভিয়ার’। রুশ অতিথিরা চমকে গিয়েছিলেন। ‘ক্যাভিয়ার’ জিনিসটা হল মাছের ডিম। পাতলা বিস্কুট, টোস্ট বা অন্য সুখাদ্যের উপর সামান্য মাখিয়ে, কিংবা সরাসরি চামচে করে খাওয়া হয়। সেরা হল বেলুগা ক্যাভিয়ার, যা আসে ক্যাস্পিয়ান সাগর এবং কৃষ্ণসাগর থেকে। নুন মেশানো কালো গাজর সিদ্ধকে ‘ক্যাভিয়ার’ বলার মানেটা কী?

সম্ভবত এ হল সব বিদেশি জিনিসকে দিশি করে দেখানোর প্রবণতার এক চরম দৃষ্টান্ত। ধরুন পানিফলকে কলাপাতায় মুড়ে ভাপে সেদ্ধ করে কেউ যদি বাঙালির পাতে দেয় ‘পানিফলের ইলিশপাতুরি’ বলে, নিমন্ত্রিতরা তাতে খেপচুরিয়াস হয়ে উঠতেই পারেন। হাঁসজারু খাবারে চেনা নামের লেবেল লাগিয়ে অতিথিদের মন পাওয়ার এমন চেষ্টা একটু ছেলেমানুষি। তাতে হিতে বিপরীত হওয়ার ভয়ও থাকে, সৌহার্দের সম্পর্ক আরও বলিষ্ঠ না হয়ে অকারণ ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হতে পারে।

ভুল থেকেও শিক্ষা নেয় না মোদী সরকার। ২০১৪ সালে চিনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং যখন সদলবলে আমদাবাদ পৌঁছলেন, তাঁদের চিনা খাবার বলে খেতে দেওয়া হল গোবি মাঞ্চুরিয়ান, সেজ়ওয়ান চিলি নুডলস উইথ পনির, সুইট অ্যান্ড সাওয়ার ভিন্ডি! ভাগ্যিস, মোদী নিজে সাবরমতী নদীর তীরে যে ভোজ দিয়েছিলেন, তাতে ছিল গুজরাতি খাবার! তবে ফের ওই নিরামিষ। এই সম্পূর্ণ শাকাহারী ভোজ চিনা অতিথিরা ভাল ভাবে নেননি। তাই ২০১৯ সালে মহাবলীপুরমে মোদী-শি বৈঠকের মেনুতে রাখা রয়েছিল চিংড়ি, মাছ, মাটন আর মুরগিও।

নিরামিষ খাওয়ার যতই উপকারিতা থাক, কূটনীতি এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কে তার প্রয়োগ ভারতের কতটা উপকার করছে, সে প্রশ্নটা থেকেই যাচ্ছে। এত দিনে স্পষ্ট হয়েছে যে. সরকারি ব্যাঙ্কোয়েট বা ভোজসভাতে বিদেশি অতিথিদের নিরামিষ খেতে বাধ্য করা হচ্ছে বলে ভারত সফরে আসা নেতা-আধিকারিকরা ভোজনের আমন্ত্রণ যথাসম্ভব এড়িয়ে যাচ্ছেন। ভারতে সরকারি ভোজসভায় মদ পরিবেশন করা হয় না, এটা সবাই মেনে নেন। কিন্তু মাছ-মাংস খাওয়ার সুযোগই দেওয়া হচ্ছে না, এটা অনেকেই মানতে পারছেন না।

ভারতের কূটনীতির সাংস্কৃতিক দিক (সফ্‌ট ডিপ্লোম্যাসি) হয়ে দাঁড়িয়েছে নিরামিষ ভোজন, যোগচর্চা আর পরিবেশপ্রীতি, যেগুলিকে হিন্দু ধর্মের মৌলিক বৈশিষ্ট্য বলে তুলে ধরা হচ্ছে। এই সূত্রেই নতুন করে বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি আগ্রহের উদ্ভব, এবং তার ভিত্তিতে জাপান, মঙ্গোলিয়া, কোরিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় করার চেষ্টা চলছে। বিশেষ করে রামায়ণের মাধ্যমে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলিতে হিন্দুধর্মের প্রসারের বিষয়টি এখন ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব কালচারাল রিলেশনস-এর কাজে বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে। প্রতিবেশী নেপাল, ভুটান এবং শ্রীলঙ্কার সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের তার বাঁধা হচ্ছে হিন্দু বা বৌদ্ধ ধর্মের সুরে। মধ্য এশিয়া এবং আফগানিস্তানের প্রাচীন বৌদ্ধ স্মারকগুলিও স্থান পেয়েছে ভারতের কূটনৈতিক আদানপ্রদানে। যার নিহিত বার্তা হল, হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্ম ছড়িয়েছে শান্তিপূর্ণ ভাবে, এবং এখানেই ইসলামের থেকে তারা আলাদা।

ইদানীং ভারতের কূটনীতির আর একটি ঝোঁক হল, কোনও ঘটনা বা ধারণাকে বোঝাতে ইংরেজির কিছু শব্দ এমন ভাবে চয়ন করা, যাতে তার আদ্যাক্ষর নিলে একটা ভারতীয় শব্দ তৈরি হয়। যেমন, ভারত মহাসাগর নিয়ে ভারতের নীতিকে বিবৃত করা হল এ ভাবে, ‘সিকিউরিটি অ্যান্ড গ্রোথ ফর অল ইন দ্য রিজিয়ন’, যার আদ্যক্ষর নিলে তৈরি হয় ইংরেজি ‘সাগর’ শব্দটি। এক দিকে সরকারি নীতির সরলীকরণ করা হচ্ছে, অন্য দিকে হিন্দি-হিন্দুত্বের প্রসারই বিশ্বে ভারতের প্রসার, এই ছেলেমানুষি চিন্তাগুলো ভারতের বিদেশ নীতি এবং কূটনীতিতে ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে উঠছে।

তালিবান আফগানিস্তান দখল করার পরে সে দেশ থেকে ভারতীয়দের উদ্ধার করে আনার কার্যসূচির নাম দেওয়া হল ‘অপারেশন দেবী শক্তি’। যদিও সরকারি তথ্য অনুসারে যে ৬৬৯ জনকে আফগানিস্তান থেকে উদ্ধার করেছে ভারত, তাঁদের মধ্যে ৪৪৮ ভারতীয় এবং ২০৬ জন আফগান। ২০২১-এর অগস্টে মাত্র ৫৬৫ জনকে উদ্ধার করা হয়েছে, যাঁদের মধ্যে ৪৩৮ জন ভারতীয়।

এক সময়ে আফগানিস্তানের মানুষদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিল ভারত। অত্যন্ত আক্ষেপের কথা যে যুদ্ধ আর ক্ষুধায় বিপর্যস্ত হয়েও আফগানরা ভারতে আসতে আগ্রহী নন। যাঁরা এসেছেন, তাঁরাও এখান থেকে চলে যাওয়ার চেষ্টা করছেন, পশ্চিম এশিয়া, ইউরোপ বা কানাডায়। ভারত সরকারের নাগরিকত্ব আইনের সংশোধনের প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে ভারতের বন্ধু দেশগুলির মধ্যেও।

Non Veg Dishes Narendra Modi

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}