E-Paper

একসূত্রে গাঁথা ইতিহাস

নিজে জন্মসূত্রে কেনিয়ান হলেও, গুগির সাহিত্যিক উত্তরাধিকারের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি আফ্রিকান মানুষের পরিচয়ের সংগ্রাম, আর দাস-ব্যবসা-পরবর্তী চুক্তিবদ্ধ ভারতীয় প্রবাসীর সাংস্কৃতিক পরিচয় রক্ষার ইতিহাস।

গৌতম চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ০৪ জুলাই ২০২৫ ০৬:৪৭

আফ্রিকার প্রতিরোধের কথাশিল্পী গুগি ওয়া থিয়োং’ও প্রয়াত হলেন গত ২৮ মে। এই মে মাসেই বিশ্ব জুড়ে পালিত হয় ‘আফ্রিকান হেরিটেজ ডে’, আর ১৮৩৮ সালের এই মাসেই সেকালের কলকাতা বন্দর থেকে ডেমেরারার উদ্দেশে রওনা হয়েছিল চুক্তিবদ্ধ শ্রমিক বা ‘ইনডেনচার্ড লেবার’দের প্রথম জাহাজটি— ‘হেস্পেরাস’। তিনটি ঘটনার এই সমাপতন যেন ইতিহাসের অদৃশ্য সূত্রে গাঁথা। নিজে জন্মসূত্রে কেনিয়ান হলেও, গুগির সাহিত্যিক উত্তরাধিকারের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি আফ্রিকান মানুষের পরিচয়ের সংগ্রাম, আর দাস-ব্যবসা-পরবর্তী চুক্তিবদ্ধ ভারতীয় প্রবাসীর সাংস্কৃতিক পরিচয় রক্ষার ইতিহাস। হেস্পেরাস হুগলি নদী দিয়ে সাগরে পাড়ি দেওয়ার ঠিক একশো বছর পর, ১৯৩৮ সালে জন্ম গুগির— পরবর্তী কালে যিনি হয়ে ওঠেন আফ্রিকার উপনিবেশ-উত্তর সংগ্রামের মুখ্য কণ্ঠ।

শুধু এক শক্তিশালী লেখকই নন, উপনিবেশ-বিরোধী সংগ্রামের প্রতীকও ছিলেন তিনি। কেনিয়ার প্রত্যন্ত গ্রামে জন্ম নেওয়া মানুষটি ব্রিটিশ শাসনের অত্যাচার দেখেছেন, মাউ মাউ বিদ্রোহের সাক্ষী ছিলেন। বুঝেছিলেন, উপনিবেশবাদ শুধু দেশ দখল করে না, মানুষের ভাষা ও চিন্তার উপরেও আধিপত্য কায়েম করে। আন্তর্জাতিক ‘আফ্রিকান হেরিটেজ ডে’ পালনের মূল উদ্দেশ্য আফ্রিকার বিপুল প্রাকৃতিক ঐতিহ্য ছাড়াও, ডায়াস্পোরা বা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া আফ্রিকান বংশোদ্ভূত মানুষের সাংস্কৃতিক পরিচয় রক্ষা। গুগি তাঁর জীবনব্যাপী এই সংগ্রামকে সাহিত্যে ধারণ করেছেন— তাঁর উপন্যাস দ্য রিভার বিটুইন-এ বিশেষ করে। এই উপন্যাসে নদী কেবল কেনিয়ার গিকুয়ু সম্প্রদায়ের বিভাজনেরই নয়, বিশ্বব্যাপী সব উপনিবেশিত মানুষের বিচ্ছিন্নতারও বহমান প্রতীক।

মনে রাখা দরকার, হুগলি নদীতীর থেকে উনিশ শতকে যাত্রা করা সেই ঠিকা শ্রমিকদের অনেকেই পৌঁছেছিলেন পূর্ব আফ্রিকায়— কেনিয়া, উগান্ডা, তানজ়ানিয়ায়। গুগির লেখায় যদিও সরাসরি ভারতীয় অভিবাসীদের কথা নেই, তবু তাঁর রচনায় উপনিবেশ-পরবর্তী সমাজের সঙ্কট ও সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্বের যে ছবিটা মেলে, তা ভারতীয় ডায়াস্পোরার অভিজ্ঞতার সঙ্গে আশ্চর্য ভাবে মিলে যায়। ডিকলোনাইজ়িং দ্য মাইন্ড গ্রন্থে গুগি লিখেছিলেন, “উপনিবেশবাদ শুধু ভূখণ্ড দখল করে না, তা মনোজগতেও ভাষার মাধ্যমে আধিপত্য কায়েম করে।” কলকাতা থেকে যাওয়া ঠিকা শ্রমিকদের ক্ষেত্রেও এ কথা সমান প্রযোজ্য— তাঁদের সন্তান-সন্ততিরা আজও গায়ানা, ত্রিনিদাদ বা দক্ষিণ আফ্রিকায় হিন্দি, ভোজপুরি, তামিল বা বাংলার টুকরো শব্দ আঁকড়ে রেখেছে পরিচয়ে।

“মৃত্যু নেই, আছে শুধু নদীর মতো এক তীর থেকে অন্য তীরে যাত্রা,” লিখেছিলেন তিনি। তাঁর লেখায় নদীতীর ফিরে আসে বার বার। কালাপানি পেরিয়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের উদ্দেশে পাড়ি দিয়েছিলেন যে ভারতীয়রা, তাঁদের অস্তিত্বের তিন তীর মিলেমিশে যায় গুগির ভাবনার রঙে। প্রথম তীর হুগলি নদী, যেখান থেকে ভারতীয় শ্রমিকরা বিদেশের পথে যাত্রা করেছিলেন; দ্বিতীয় তীর তাঁর উপন্যাসে বর্ণিত কেনিয়ার পাহাড়ি নদী, যা সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংঘাতের প্রতীক; আর তৃতীয় তীর ‘ইন্দো-প্যাসিফিক’ সুবিপুল জলরাশির, আফ্রিকাকে যা বিভক্ত করেছে কিন্তু সংযুক্ত করেছে ডায়াস্পোরাকে।

গিকুয়ু লোককাহিনি, চিনুয়া আচেবে-র থিংস ফল অ্যাপার্ট, ফ্রানৎজ় ফ্যানন-এর উপনিবেশ-বিরোধী মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ— এই সব ছিল তাঁর আদর্শ। সাহিত্যিক, নাট্যকার ও শিক্ষাবিদ হিসেবে তিনি গড়ে তুলেছিলেন এক আন্তঃমহাদেশীয় সংলাপ। তাঁর উত্তরাধিকার ছড়িয়ে পড়েছে আফ্রিকার বাইরে, ভারতের মতো অন্য দেশেও, যেখানে ভাষা-রাজনীতি, বাস্তু ও স্থানচ্যুতি কিংবা জাতি-ধর্ম-বর্ণ পরিচয় ঘিরে বৈষম্য আজও জ্বলন্ত। তাঁর কলম মনে করিয়ে দেয়, উপনিবেশের ইতিহাস কখনওই অতীত হয় না। রাষ্ট্রের দমন-পীড়ন শুধু প্রশাসনিক ব্যর্থতা নয়, ঔপনিবেশিকতার বহতা ধারারও তা বহিঃপ্রকাশ। এর বিরুদ্ধেই আজীবন লড়াই করেছেন গুগি। তাঁর লেখায় যে সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের আহ্বান, তা শুধু আফ্রিকার প্রেক্ষাপটে কেন, আজকের ভারতের প্রেক্ষিতেও প্রাসঙ্গিক।

তাঁর পেটালস অব ব্লাড তুলে ধরে স্বাধীনতা-পরবর্তী বিশ্বাসঘাতকতা, নতুন শাসকেরা যেখানে হয়ে ওঠে আগের শোষকদের ছায়া। ডেভিল অন দ্য ক্রস গ্রন্থে তিনি লেখেন পুঁজিবাদের নির্মমতা নিয়ে, আ গ্রেন অব হুইট-এ প্রশ্ন তোলেন বিপ্লব ও আত্মদ্বন্দ্বের সীমারেখা নিয়ে। তাঁর কলম আর কিছু নয়, প্রতিবাদের আঙ্গিকে জনজাতি ও মূলনিবাসী মানুষের নিপীড়নের প্রতিবাদ, কৃষক আন্দোলনের উপর দমন নীতির বিরোধিতা। মতপ্রকাশের উপর আঘাত তিনি কখনও সহ্য করেননি। “স্বাধীনতা একটি মুহূর্ত নয়, বরং একটি প্রক্রিয়া”— এই সত্যই তিনি বোঝাতে চেয়েছেন বারংবার। যখন আমরা কোনও হারানো ভাষা বাঁচাই, ‘নিষিদ্ধ’ কবিতা প্রকাশ করি, বা স্মৃতির নদীতে ভেসে যাই ঘনিষ্ঠদের সঙ্গে— তখনই সেই প্রক্রিয়া এগিয়ে চলে। কলকাতা বন্দর থেকে ডেমেরারার উদ্দেশে যাত্রা করা প্রথম জাহাজটি থেকে শুরু করে গুগির সাহিত্য, সবই এক ইতিহাস-সূত্রে গাঁথা। মানুষের জীবনগল্প বুকে নিয়ে সেই ইতিহাস বয়ে চলেছে— হুগলি থেকে সুদূর নাইরোবি পর্যন্ত।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Legend Writer famous personality

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy