ছায়ামানুষের মতো এ বারের বিহার বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারে দেখা গিয়েছে নীতীশ কুমারকে। তিনি ছিলেন, আছেন, কিন্তু যেন অন্তরালে। যদিও তাঁকে নিয়ে অতিকথা প্রবহমান, তাঁর বিভিন্ন নীতির সুফল বিহারের রাজনৈতিক খেতখামারে শস্যের মতো আলো হয়ে রয়েছে। মহিলারা লিট্টি চোখা স্বজনের পাতে দেওয়ার সময় নীতীশের নামে কিছুটা সরিয়ে রেখেছেন অদৃশ্য বাটিতে। অতি অনগ্রসর শ্রেণি (ইবিসি) আস্থা রেখেছে নীতীশে। গত শতকের নব্বইয়ের দশক জুড়ে রাজনৈতিক অপরাধের রমরমায় ত্রাসে থাকা যাদব ব্যতীত অন্যান্য ওবিসি-রা নীতীশে মুক্তি খুঁজেছেন।
কিন্তু নীতীশ নিজে এ বারের ভোট মরসুমে ডুমুরের ফুলের কাছাকাছি হয়ে ফুটেছেন। অথচ ২০২০ বিধানসভা ভোটেই দেখা গিয়েছিল, তিনি গোটা রাজ্যে দাপিয়ে জনসভা, পদযাত্রা করছেন। ২৪০টি জনসভা করেছিলেন শুধুমাত্র ভোট উপলক্ষে। এ বারে কিন্তু সেই জনসভার সংখ্যা নেমে এসেছে ৮০-তে। এ দিকে গত বারের এক-তৃতীয়াংশ ভোটপ্রচার করে তিনি গোলায় তুলেছেন গত বারের প্রায় দ্বিগুণ আসন। ভারতীয় নির্বাচনের গবেষণাগারে এ বারের ভোটের ফলাফল নিঃসন্দেহে আগামী বহু বছর অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নীচে রেখে পরীক্ষানিরীক্ষা করা হবে। আপাতত আমরা ফিরে যাই সামান্য পুরনো সময়খণ্ডে।
কলকাতার সজল আবহাওয়া ছে়ড়ে তখন সোজা গিয়ে পড়েছি গনগনে দিল্লিতে। সেখানে তখন বাজপেয়ী সরকারকে দু’বেলা ধুনছেন বিরোধীরা, রাজনৈতিক তাপমাত্রা বেশ চড়া। পৌঁছনোর পরই কার্যত প্রথম বড় অ্যাসাইনমেন্ট হিসাবে জুটে গেলাম দুই রেলমন্ত্রীর নিত্য দিনের লড়াইয়ে। এক জন তখন বর্তমান, অন্য জন সদ্য প্রাক্তন। এক জন নীতীশ কুমার, অন্য জন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মমতা দিল্লিতে এসে তাঁর রামমনোহর লোহিয়ার হাসপাতালের নিকটবর্তী আবাসন থেকে গর্জন করছেন, পূর্ব রেল বিভাজন হলে সংসদ অচল করে দেবেন। অন্য দিকে, নীতীশ তাঁর অতি শান্ত ঠান্ডা গলায় বলছেন, “আপনাদের দিদিকে বোঝান, এটা হলে বাংলার কোনও ক্ষতি নেই, বরং প্রশাসনিক সুবিধাই হবে।” আমার কাজ ছিল দু’পক্ষের সঙ্গে নিয়মিত কথা বলে (মূলত নীতীশ কুমারের সঙ্গেই) রিপোর্ট লিখে যাওয়া।
এ ভাবেই নীতীশের সঙ্গে সখ্য, তাঁর সাক্ষাৎকার নেওয়ার সুযোগ। ল্যান্ডলাইন থেকে নিয়মিত কথা। সংসদে রেলমন্ত্রীর নির্দিষ্ট ঘরে বসে তাঁর সঙ্গে কিছুটা হালকা পরিবেশে কথা বলা। সালটা ছিল ২০০২। কিছু পরে ‘প্যাসিভ অ্যাগ্রেসিভ’ বলে শব্দবন্ধ শুনেছি, নীতীশ ছিলেন সেই গোপনে আগ্রাসী গোত্রের উজ্জ্বল সংযোজন। মুখে হালকা হাসি ঝুলিয়ে রাখতেন, কণ্ঠস্বর কখনও একটি বিশেষ পর্দার উপরে যেত না। তাঁর মিতকথন, সুচারু রসবোধ, কেজো ভাষার উপর দখল ছিল অসামান্য। আবার অনেক ক্ষেত্রেই কথা বলার সময়ে ঠেট শব্দের প্রয়োগে মনে হত না তিনি অভিজাত কোনও মন্ত্রকের মেহগনি-শোভন ঘরে বসে রয়েছেন। বরং মনে হত, তিনি বিহারের কোনও চৌরা বা গ্রামের দালানে হুঁকোর নল নিয়ে সেখানকার মানুষের সঙ্গে গপ্পে মেতেছেন। কিন্তু তাঁর অগ্রজ লালু প্রসাদেরও তো সেই গুণ ছিল, এবং অনেক বেশি মাত্রাতেই ছিল। তবু লালু-নীতীশে মোক্ষম তফাত একটা ছিল। ওই প্যাসিভ অ্যাগ্রেশনে (সদর্থে) এবং চূড়ান্ত পেশাদারিত্বের প্রশ্নে, আমার মতে তিনি লালুর থেকে কয়েক আলোকবর্ষ এগিয়ে। এঞ্জিনিয়ারিং-এর এই স্নাতক ছিলেন যাকে বলে ‘হার্ড টাস্কমাস্টার’। তাঁর অফিসারদের তটস্থ করে রাখতেন ফাইল রিপোর্ট, মিটিং, জবাবদিহি, কাজে ফাঁকি না দেওয়াতে। কোনও ফাইল পরের দিনের জন্য যেন পড়ে না থাকে, সে বিষয়ে ছিলেন বিশেষ যত্নবান। মন্ত্রিত্বের দায়দায়িত্বের প্রতি অতি সতর্ক।
অথচ এই নীতীশই সংসদের রেলমন্ত্রীর কামরায় বসে আমাকে এক প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন, “রাজনীতি করতে শুরু করার পর থেকে আমাদের সময়ে লক্ষ্য ছিল একটাই। সেটা নেতা, মন্ত্রী, বিধায়ক বা ক্ষমতাবান হওয়া নয়। সে জন্য রাজনীতি শুরুই করিনি। আমার এবং আমার মতো অনেকেরই স্বপ্ন ছিল সাংসদ হওয়ার। সংসদ ছিল আমাদের কাছে চূড়ান্ত গন্তব্য এবং সাংসদ হওয়া ছিল অত্যন্ত সম্মানের ব্যাপার।”
এ-হেন নীতীশই তাঁর সাধের সংসদ ছেড়ে পটনা গেলেন, আর ফিরলেন না। বিহারেই থেকে গেলেন মুখ্যমন্ত্রী হয়ে। একই সঙ্গে ‘পাল্টুরাম’ এবং ‘সুশাসনবাবু’র দু’টি আলাদা আলাদা তকমা তাঁর পাঞ্জাবিতে সেঁটে গেল ব্রোচের মতো। তাঁকে ঘিরে পল্লবিত হতে লাগল নানা মিথ বা অতিকথা, যা তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের নিশানাবাহকও বটে। তিনি নিজের বন্ধু এবং শত্রুকে একই ভাবে সামলে নিতে পারেন। রাজনীতির দাবা খেলায় তিনি ঘোড়ার মতো আড়াই চাল দেন, তবে সেটা একই সঙ্গে সামনে ও পিছনে! তাঁর এক হাত জানে না অন্য হাত কী করতে চলেছে! বিরোধী শিবিরে সব সময়ই তাঁর কিছু লোক মজুত থাকে, প্রয়োজনে পড়লে যাতে তিনি নিজের জোট বদলে ফেলতে পারেন। চাণক্যের মতো তিনিও বিশ্বাস করেন, রাজনীতিতে স্থায়ী শত্রু বা মিত্র নেই।
এক দীর্ঘ রাজনৈতিক নাগরদোলায় সওয়ার নীতীশ কুমার, দেখতে দেখতে দশ বার মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে শপথ নিয়ে ফেললেন পটনা স্টেশন সন্নিকটে গান্ধী ময়দানে। এর মধ্যে বার বার বন্ধু বদল করেছেন তিনি, সেই ইতিহাস বহু-আলোচিত। কিন্তু এখানে এটাই বলার, যে কোনও মূল্যে ক্ষমতায় থাকার জন্যই কেবল ক্ষুদ্র স্বার্থের কারণে নীতীশ সঙ্গী বদল করেননি বোধ হয়। তা যদি হত, তা হলে ২০১৪ সালে তাঁর দলের খারাপ ফলাফলের পর নিজে সরে দাঁড়িয়ে দলিত নেতা জিতন রাম মাঁঝিকে মুখ্যমন্ত্রী করতেন কি তিনি?
এমনটাও নয় যে নীতীশ বিহারকে আমূল বদলে দিয়েছেন তাঁর সুশাসনে। বহু কিছুই করে উঠতে পারেননি তিনি এবং তাঁর সরকার। জনপ্রতি রোজগারে বিহার এখনও জাতীয় তালিকার তলায়। লালুর শাসনের সময় রাজ্য ছেড়ে যাওয়া বিনিয়োগ এবং বেসরকারি শিল্প সংস্থাগুলিকে তিনি আজও ফিরিয়ে আনতে পারেননি তাঁর রাজ্যে। প্রতিভাসম্পন্ন ছাত্রছাত্রীদের এবং কায়িক শ্রম-নির্ভর কর্মীদের দলে দলে রাজ্য ছেড়ে অন্য রাজ্যে চলে যাওয়া আজও বিষফোড়ার মতো রয়েছে বিহারে।
তবুও সে রাজ্যে তাঁর জনপ্রিয়তা কেন ধারাবাহিক ভাবে থেকে গেল, তার কারণ অনুসন্ধান চলছে, চলবেও। গত বছর দেড়-দুই, তাঁর অসুস্থতা নিয়েও গুঞ্জন ছড়িয়েছে। তাঁকে প্রচারসভায় নিয়ে আসা হয়েছে কম। শূন্যদৃষ্টিতে তিনি দাঁড়িয়ে রয়েছেন, ভোটের মুখে এক মিনিটেরও কম সময়ে দলীয় ইস্তাহার প্রকাশ সেরে ফেলা হয়েছে। প্রথাবিরুদ্ধ ভাবেই তাঁকে সাংবাদিকদের কোনও প্রশ্ন নিতে দেখা যায়নি। তাঁর বয়সজনিত অসুস্থতা, অসংলগ্নতা বা ভারসাম্য নিয়ে রাজনৈতিক কটাক্ষ যেমন হয়েছে, কৌতূহলও তৈরি হয়েছে সাধারণ মানুষের মনে।
এ-হেন নীতীশ কুমারকে জয় নিশ্চিত হওয়ার চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে ক্যামেরার সামনে দেখাই যায়নি এ বার। এই অনুপস্থিতি নিয়ে যখন দেশ জুড়ে প্রশ্ন ও সংশয় আরও গভীর হচ্ছে, তখনই হঠাৎ হাসিমুখে এক কালের প্রতিদ্বন্দ্বী চিরাগ পাসোয়ানের সঙ্গে তিনি প্রথম দেখা দিলেন। উষ্ণ হাসি, আলিঙ্গনাবদ্ধ, হাতে ফুল, যদিও দৃষ্টিতে সেই তীক্ষ্ণতা নেই, বরং ভাষাহীনতাই বেশি। এই পরিস্থিতিতে আগামী পাঁচ বছর তিনি মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে কাজ চালাতে পারবেন কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছেই।
তবুও নীতীশ ম্যাজিক নিয়ে চর্চা চলবেই বিহারে। মহিলাদের ক্ষেত্রে যে নিঃশব্দ বিপ্লব তিনি ঘটিয়েছিলেন, তার ফল এখনও পাচ্ছে তাঁর দল। শুধুমাত্র জাতপাতের রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে মহিলা বন্ধনীর মধ্যে তিনি বাঁধতে পেরেছেন এমনকি আরজেডি-র সমর্থক যাদব পরিবারের মহিলাদেরও। বিহার পুলিশ ফোর্সে আজ ৩৭ শতাংশ মহিলার উপস্থিতি নীতীশের অবদান।
শুধু মহিলাই নয়, মহাদলিত, অতি অনগ্রসর শ্রেণিকে শক্তিশালী করার রাজনীতিও মোক্ষম ভাবে বার বার তাঁকে ভোট এনে দিয়েছে। দু’দশক ক্ষমতায় থাকার পরেও তাঁর বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত দুর্নীতির ছিটে লাগতে পারেনি কখনও। কয়লাখনির উপর দাঁড়িয়ে থাকা রাজ্যে এ বড় সহজ কাজ ছিল না।
নিঃসন্দেহে বিহারের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে এটা তাঁর শেষ ইনিংস। সেটা জেনেই বিহার তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের সায়াহ্নে এসে পাশে দাঁড়াল। এই ভোটে বিহারবাসীর কৃতজ্ঞতাও মিশে রইল।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)