E-Paper

দেশপ্রেম মানে অসৌজন্য নয়

আমরা ভুলিনি জার্মানির লং জাম্পার লুজ় লং-এর কথা, যিনি ১৯৩৬ সালে দাঁড়িয়ে হিটলারের আর্য-উৎকৃষ্টতাবাদ নস্যাৎ করে আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গ খেলোয়াড় জেসি ওয়েন্সকে জরুরি পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করেছিলেন।

সমুদ্র রায়

শেষ আপডেট: ৩০ অক্টোবর ২০২৫ ০৫:৫১

ইসাবেল উইলকারসন আমেরিকার প্রথম আফ্রিকান-আমেরিকান মহিলা সাংবাদিক, যিনি পুলিৎজ়ার পুরস্কার জেতেন (১৯৯৪)। সম্প্রতি তাঁকে নিয়ে তৈরি হয়েছে একটি ছবি, অরিজিন (পরিচালক আভা দু’ভার্নে, ২০২৩)। অরিজিন ছবিটি দেখিয়েছে, কৃষ্ণাঙ্গদের উপর ক্রমান্বয়ে চলা অত্যাচার, এমনকি হত্যা পর্যন্ত অধিকাংশ সময়ে সাদা মানুষদের চোখে ধরাই পড়ে না। যেখানে সরকারি নির্দেশ নেই, সেখানেও ভিন্ন বর্ণ, জাত, লিঙ্গের মানুষকে ‘নিষিদ্ধ’ করা, ‘অপর’ করে রাখার প্রক্রিয়া চলতেই থাকে। তেমন একটি ঘটনা রয়েছে এই ছবিতে। অ্যালিসন ডেভিস ছিলেন শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম আফ্রিকান-আমেরিকান নৃতত্ত্ববিদ অধ্যাপক। আমেরিকার দক্ষিণে কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি বৈষম্যের ইতিহাস সম্পর্কে একটি আকরগ্রন্থের সহলেখক ছিলেন অ্যালিসন। ১৯৪০ সালের বার্লিনের একটি লাইব্রেরিতে বয়স্কা, শ্বেতাঙ্গ লাইব্রেরিয়ানের কাছে তিনি অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট বইটি চান। লাইব্রেরিয়ান কঠিন দৃষ্টিতে অ্যালিসন ও তাঁর (কৃষ্ণাঙ্গ) স্ত্রী এলিজ়াবেথকে দেখেন, তাঁদের লাইব্রেরি কার্ড চান, এবং তাঁদের পাসপোর্টও চেয়ে বসেন।

এক জন লাইব্রেরিয়ান কেন পাসপোর্ট দেখতে চাইবেন? এই প্রশ্নটা মনে ভেসে উঠল এশিয়া কাপ দেখতে দেখতে, যেখানে ভারতের ক্রিকেট দলের অধিনায়ক একটি ম্যাচের শেষে শেখানোর চেষ্টা করলেন, দেশপ্রেম কাকে বলে। যেমন লাইব্রেরিয়ানের কাজ হল লাইব্রেরি কার্ড দেখে পাঠককে তাঁর কাঙ্ক্ষিত বই এগিয়ে দেওয়া, তাঁকে ভাবতে-বুঝতে সাহায্য করা, তেমনই একটি দেশের প্রতিনিধিত্ব করা খেলার দলের অধিনায়কের কাজ হল দর্শকের মনোরঞ্জন, এবং খেলোয়াড়-সুলভ মানসিকতার পরিচয় দেওয়া। খেলার এই দর্শন ‘দেশপ্রেম’ নামক ধারণার চেয়ে অনেক বৃহত্তর ও কঠিন। তা দেশ-জাতি-বর্ণ, সব বিভেদকে ছাপিয়ে ওঠে। এই মানসিকতা আসে খেলার এমন এক আদর্শ থেকে, যেখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা মানে খেলার মাঠে উৎকর্ষের পরীক্ষা, কৌশল ও শক্তির প্রদর্শনী। সেখানে রেষারেষি আছে, বিদ্বেষ নেই।

আমরা ভুলিনি জার্মানির লং জাম্পার লুজ় লং-এর কথা, যিনি ১৯৩৬ সালে দাঁড়িয়ে হিটলারের আর্য-উৎকৃষ্টতাবাদ নস্যাৎ করে আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গ খেলোয়াড় জেসি ওয়েন্সকে জরুরি পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করেছিলেন। যার জেরে জেসি জেতেন সোনা, লুজ় পেয়েছিলেন রুপো। হিটলার সেই থেকে জয়ীদের অভিনন্দন জানানোই বন্ধ করে দিয়েছিলেন। খেলার মাঠে এক দলের কাছে অপর দলের মানুষদের একটাই পরিচয়— তাঁরা একই খেলার খেলোয়াড়। ‘ফেয়ার প্লে’ বা ‘ন্যায্য প্রতিযোগিতা’-র ধারণা সমাজ খেলোয়াড়দের থেকেই গ্রহণ করেছে, যেখানে তীব্র প্রতিযোগিতার মধ্যেও সৌহার্দ এবং সৌভ্রাত্র অটুট থাকে। দেশের সীমা ছাড়িয়ে খেলোয়াড়রা নিজেদের স্বজন-বৃত্ত তৈরি করেন, যেখানে তাঁরা একে অপরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, একান্ত অনুরাগী। দেশ, ধর্ম, গাত্রবর্ণ, ভাষা— কিছুই সেখানে দেওয়াল তৈরি করতে পারে না।

ভারতের যে ক্রিকেটার একটি ম্যাচের শেষে বিপক্ষের খেলোয়াড়দের সঙ্গে হাত মেলাতে অরাজি হলেন, তিনি কি খেলোয়াড় হয়ে উঠতে শিখেছেন? যদি শিখতেন, তা হলে বুঝতেন যে কল্পিত দেশপ্রেমের স্বঘোষিত দেবতার স্থান খেলার মাঠে নেই। যেমন লাইব্রেরিয়ান পাসপোর্ট চাইতে পারেন না, তেমনই খেলার মাঠের বাইরের কোনও প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে টেনে দেশপ্রেমের পরিচয় দাবি করা, বা পেশ করা, ক্রিকেটারের কাজ নয়। শোনা যাচ্ছে যে, বিসিসিআই থেকে মহিলা দলের অধিনায়ক হরমনপ্রীত কউরকে যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, তার জেরেই নাকি তিনি মহিলা বিশ্বকাপের ম্যাচে পাকিস্তানের ফতিমা সানার সঙ্গে করমর্দন করতে পারেননি। তবে পেস বোলার ক্রান্তি গৌড়, যিনি মেয়েদের ম্যাচ জেতায় বড় ভূমিকা নিয়েছেন, তিনি বলেই দিয়েছেন যে ভারত-পাকিস্তান নিয়ে তাঁর কিছু ভাবার ছিল না। তাঁর কাজ শুধু ছিল ভাল বোলিং করা। আনন্দের কথা এই যে, এর পর অনুষ্ঠিত একটি হকি ম্যাচে ভারতীয় দল খেলোয়াড়চিত আচরণই করেছেন। রোহিত শর্মা ও বিরাট কোহলি তাঁদের পাকিস্তানি ভক্তদের প্রতি যে সৌজন্যমূলক আচরণ করেছেন, তা আমাদের গর্বিতই করেছে।

আজকের ভারতে কিছু মানুষ যেন অন্য সকলের দেশপ্রেমের পাসপোর্ট পরীক্ষার ঠিকা নিয়েছেন! এই উৎসাহের পিছনে রয়েছে ‘জিম ক্রো’-সুলভ আইন প্রয়োগের চেষ্টা। শ্রমজীবী মানুষ, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, যাঁদের পণ্য বিক্রি হচ্ছে না বাজারে ক্রেতার অভাবে, তাঁদেরও উত্তেজিত করে নামিয়ে দেওয়া হচ্ছে ‘ধর্মরক্ষা’-র কাজে। অতি-উল্লাসে আঘাত করছেন তাঁরই সহকর্মীকে। যদিও অর্থনীতির পেষণে তাঁদের দু’জনের পরিবার একই ভাবে দম আটকে মরছে। তাই, সাহস করে বলতে হবে— ওহে গ্রন্থাগারিক, তুমি বাপু, বইপত্র আর লাইব্রেরি কার্ডের দিকে মন দাও; পাসপোর্টের জন্য অন্য অফিস আছে। নিজের কর্মক্ষেত্র, নিজের সামাজিক দায়দায়িত্বের প্রতি সৎ ও সজাগ থাকলেই দেশপ্রেমের যথেষ্ট পরিচয় দেওয়া হবে। বাড়তি অসৌজন্যের প্রয়োজন নেই।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Virat Kohli Rohit Sharma Cricket

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy