সম্প্রতি আইআইটি মাদ্রাজ স্থাপন করেছে সেন্টার ফর দ্য সায়েন্স অব হ্যাপিনেস। সেখানে দেওয়া হবে সুখশিক্ষা। সুখ শেখানোর এ-হেন প্রচেষ্টা কিন্তু খুব নতুন নয়। কোভিড-কালে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ইস্কুলে ইস্কুলে মানসিক স্বাস্থ্য এবং ভাল থাকার ক্লাস করানো হয়েছিল। তবে ভেবে দেখলে বোঝা যাবে, তা ছিল মূলত ‘সুখ’-এর রংচঙে মোড়কে পুরে কাউন্সেলিং-এর প্রচেষ্টা।
২০২০ সালে সস্ত্রীক ভারত সফরে এসেছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প— তখন তিনি আমেরিকায় প্রথম দফার প্রেসিডেন্ট। ফার্স্ট লেডি মেলানিয়া ট্রাম্প গিয়েছিলেন দিল্লির এক সরকারি স্কুলে, একটা হ্যাপিনেস ক্লাসে যোগ দিতে। তাতে ছিল পরস্পরের দিকে তাকিয়ে হাসা, সঙ্গীদের ইতিবাচক দিক খুঁজে বার করা, ধ্যান করা ইত্যাদি। বেশ খানিক নিউজ়প্রিন্ট খরচ হয়েছিল ব্যাপারটাকে নিয়ে।
খুঁজেপেতে দেখছি, দিল্লির স্কুলে সুখশিক্ষার এই পাঠক্রম চালু হয় কোভিডের আগেই, ২০১৮ সালে। সে যেন ছিল এক সামাজিক পরীক্ষানিরীক্ষা। গল্প বলা, ইনডোর গেমস, নাটক, আলোচনা, এই সব সেই ৪৫ মিনিটের ক্লাসের উপাদান। এর ফলে স্কুলের বাচ্চাদের ‘সুখ’ গত সাত বছরে কতটা বাড়ল, তার হিসাব অবশ্য চোখে পড়েনি।
আড়াইশো বছর আগে টমাস জেফারসনের নেতৃত্বে আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে অন্তর্ভুক্ত হয় ‘জীবন, স্বাধীনতা এবং সুখের সাধনা’। কিন্তু ‘সুখ’ কাকে বলে? আর সুখের সাধনা করবই বা কী ভাবে? যেন এক অস্পষ্ট আলো-আঁধারিতে ঘেরা মায়াময় সুখের জগৎখানা। প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে হিমালয়ের কোলের এক ছোট্ট রাজ্যের রাজপুত্র যখন তাঁর পরিবার, রাজ্য এবং সমস্ত জাগতিক আরাম ছুড়ে ফেলে বেরিয়েছিলেন, সেও কি ছিল কোনও এক ‘পারসুট অব হ্যাপিনেস’?
আসলে ‘সুখ’ বলে চিহ্নিত করে এ সব পাঠক্রমে যা শেখানো হচ্ছে, তা অনেকাংশেই ‘ওয়েল বিইং’-এর পাঠ মাত্র। অর্থাৎ ‘ভাল থাকা’র পথনির্দেশ। হয়তো সুখ বলতে প্রধানত এই ‘ভাল থাকা’কেই বুঝি আমরা। কিন্তু সুখের সঙ্গে তার কি বিস্তর ফারাক নয়? সুখ কি সত্যিই শেখানো সম্ভব, না কি তা মনের অজানা গহনে উৎসারিত বহু বর্ণের এবং বহুমাত্রিক উচ্ছ্বাস— যাকে দু’হাত বাড়িয়ে না যায় ধরা, না যায় ছোঁয়া? রাষ্ট্রপুঞ্জের ২০২৫-এর ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্ট-এ ভারতের ক্রম ১৪৭টি দেশের মধ্যে ১১৮তম। তর্ক অবশ্য উঠতেই পারে সেখানকার সুখের সংজ্ঞা এবং পরিমাপের পদ্ধতি নিয়ে। এক মুঠো অর্থনীতি, এক চিমটে যোগাযোগ ও প্রযুক্তি, এক আঁজলা খাদ্য ও বাসস্থান— এ সব যেন অনেকটাই সেখানকার ‘ভাল থাকা’র রেসিপি। এ সব যদি সুখের সঘন রসায়নই হত, তবে আর রাজার অসুখ কমে না কেন?
২০০২-এর নোবেল-বিজয়ী মনস্তত্ত্ববিদ ড্যানিয়েল কানেম্যান এবং তাঁর সহ-গবেষকরা অবশ্য দেখিয়েছেন যে, একটা পর্যায় পর্যন্ত আয় বাড়লে সুখও নাকি বাড়ে। তার পর নাকি টাকার সুখ কেনার ক্ষমতায় টান ধরে। তবে, কানেম্যানেরই ২০২৩-এর সর্বশেষ গবেষণায় উঠে এসেছিল যে, এই নিয়মটাও সবার ক্ষেত্রে খাটে না। তবে এ সব ‘ভাল থাকা’ গোত্রের সুখ কি না, কে জানে! না কি ‘ভাল থাকা’ আর ‘সুখ’ কোথাও মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়— আমরা ফারাক বুঝি না?
২০০৯ সালে লার্নিং টু রাইড এলিফ্যান্টস: টিচিং হ্যাপিনেস অ্যান্ড ওয়েল-বিয়িং ইন স্কুলস নামে চমৎকার একটি বই লিখেছিলেন ব্রিটেনের ওয়েলিংটন কলেজের ‘ওয়েল-বিয়িং’এর বিভাগীয় প্রধান ইয়ান মরিস। ‘হাতিতে চড়া শেখা’ এই শিরোনামটির মধ্যেই যেন নিহিত রয়েছে মরিসের যুক্তির কেন্দ্রীয় রূপকটির সারসংক্ষেপ— নিজের মস্তিষ্ক এবং মহাবিশ্বের বিশাল শক্তিকে একযোগে চালনা করার প্রচেষ্টা যেন হাতির পিঠে আসীন হয়ে সেই বিশাল হাতিকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টার মতোই।
তবে, শিখিয়ে-পড়িয়ে সুখের কিছু বিজ্ঞানভিত্তিক বিশ্বাসযোগ্য উপাদানকে আয়ত্ত করা হয়তো সম্ভব হতেও পারে। যেমন, সুখ-গবেষণার প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্ব আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন-এর প্রাক্তন চেয়ারম্যান মার্টিন সেলিগম্যান তাঁর ২০০৪-এর বই অথেনটিক হ্যাপিনেস-এ জীবনের সকল দিক উন্নত করার কিছু রেসিপি দিয়েছেন— মনমেজাজ মনোরম রাখার চেষ্টা, জীবনের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থেকে ‘তৃপ্তি’ অর্জন, বৃহত্তর কিছুর সেবা এবং তার মধ্যে নিজেদের অন্তর্ভুক্তি, ইত্যাদি। অর্থাৎ, সরাসরি সুখ শেখানো না গেলেও, শিক্ষার্থীরা যাতে নিজেরাই নিজেদের সুখ গড়ে তুলতে পারে তার জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা প্রদান করা হয়তো সম্ভব হতেও পারে।
কিন্তু সে জন্য সুখের ঠিক কতটা অংশ আমাদের নিয়ন্ত্রণে সেটা সর্বাগ্রে বোঝা জরুরি। সুখসুলুকের নির্দেশক একটি পাই চার্ট অবশ্য তৈরি হয়েছে বিশ বছর আগেই। করেছেন সোনজ়া লিউবোমিরস্কি, কেনন শেলডন আর ডেভিড স্কেকাডে নামে তিন গবেষক। ২০০৫-এর একটি গবেষণাপত্রে তাঁরা জানান, সুখের ক্ষেত্রে জিন বা বংশগতির প্রভাব ৫০%, ক্রিয়াকলাপের অবদান ৪০%, আর জীবনের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে বাকি ১০% সুখকে।
তা হলে কি ক্লাসরুমে সুখ শেখানোটা মাঝের ওই চল্লিশ শতাংশকে নিয়ন্ত্রণের অভীপ্সায়? এমআইটি স্লোন-এর কোর্স ‘পারসুইং হ্যাপিনেস অ্যান্ড আ মিনিংফুল লাইফ’-এর ঘোষিত উদ্দেশ্য হল সম্পর্ক এবং বন্ধুত্বের উন্নয়ন, স্থিতিস্থাপকতার বিকাশ ঘটানো, ব্যর্থতা থেকে ঘুরে দাঁড়াতে শেখানো। মননশীলতা এবং উপলব্ধির মাধ্যমে মানসিক ও শারীরিক সুস্থতা বৃদ্ধিও বটে।
দুনিয়া জুড়েই এমন পাঠক্রমের সংখ্যা ও তাদের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। ইয়েল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক লরি সান্তোস-এর কথা এ প্রসঙ্গে উঠবেই। শিক্ষার্থীদের ক্রমবর্ধমান মানসিক স্বাস্থ্যের চাহিদা পূরণের জন্য সান্তোস তাঁর ‘সাইকোলজি অ্যান্ড দ্য গুড লাইফ’ পাঠক্রমটি শুরু করেন ২০১৮-তে। তিন শতাব্দীরও বেশি সময়কালের ইতিহাসে এটি হয়ে ওঠে ইয়েলের জনপ্রিয়তম কোর্স— প্রতি চার জন ছাত্রের মধ্যে এক জন ভর্তি হলেন এতে। অনলাইন লার্নিং প্ল্যাটফর্মে ‘দ্য সায়েন্স অব ওয়েলবিয়িং’ নাম দিয়ে এর ফ্রি সংস্করণও চালু করেছেন ‘প্রফেসর অব হ্যাপিনেস’ নামে পরিচিত লরি সান্তোস। ২০১৮ থেকে এ পর্যন্ত ৩৪ লক্ষের বেশি মানুষ ভর্তি হয়েছেন কোর্সটিতে, যা শেখায়, কী ভাবে সুখ বাড়াতে হয় এবং গড়ে তুলতে হয় আরও ফলপ্রসূ অভ্যাস।
তবে, সুখের ওই ৫০:৪০:১০ অনুপাতটির সঙ্গে সহমত নন অনেকেই। যেমন, জর্জ ম্যাসন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক টড কাশদান যুক্তি দিয়েছেন— জিন, কার্যকলাপ এবং জীবনের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ রূপে বিচ্ছিন্ন বিষয় হতে পারে না। পারস্পরিক প্রভাবে এদের সীমান্ত হয়ে যেতে পারে ধূসর, থাকতে পারে খানিক সমাপতিত অংশ। ও দিকে গ্রোনিংগেন ইউনিভার্সিটির নিকোলাস ব্রাউন এবং লিপজিগ ইউনিভার্সিটির জুলিয়া রোহরারের গবেষণায় উঠে এসেছে যে, সুখের ৭০-৮০%-ই হয়তো বা বংশগত। ‘স্বার্থপর জিন’ সেখানে প্রবল হয়ে ওঠে। আবার ‘জীবনের পরিস্থিতি’— এই শব্দবন্ধটি বড়ই সুগভীর, বিস্তৃত, যা অন্তর্ভুক্ত করে কোনও ব্যক্তির জাতীয়, ভৌগোলিক, সাংস্কৃতিক পরিসরকে। সুখের উপর এ সবের প্রভাব বর্ণনা করতে মাত্র ১০% সম্ভবত অপর্যাপ্ত।
শেলডন এবং লিউবোমিরস্কি— ফের একটি গবেষণাপত্র ছাপান জার্নাল অব পজিটিভ সাইকোলজি-তে, ২০২১ সালে। সেখানে এমত নানাবিধ আপত্তির সঙ্গে একমত হন তাঁরা। স্বীকার করেন, পাই চার্টটা ছিল বাস্তবতার অতি-সরলীকরণ। তবে, সেই সঙ্গে তাঁরা এও বলেন যে, মোটের উপরে তাঁদের বার্তাটা থেকে যায় অপরিবর্তিত। তা হল— সচেতন প্রচেষ্টার মাধ্যমে সুখ বৃদ্ধি করা সম্ভব।
আমাদের সুখের কতটা অংশ কোন উৎস থেকে নির্গত, তার অনুপুঙ্খ নির্ধারণ কি আদৌ সম্ভব? এবং আমাদের কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে কতটাই বা বাড়াতে পারি সুখকে? সুখের সন্ধান— এবং সুখের উৎসের সন্ধান— তাই চলতেই থাকে।
রাশিবিজ্ঞান বিভাগ, ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট, কলকাতা।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)