গত একুশ মাস ধরে গাজ়ায় যা চলছে, তাকে নিছক কোনও সামরিক সংঘর্ষ বলার উপায় নেই। ইজ়রায়েলের দাবিমতো, এ তার নিরাপত্তা রক্ষার অভিযানও নয়। বাস্তবিক অর্থেই এ একটি জনগোষ্ঠীকে ধ্বংস করে দেওয়ার এবং তাদের ভূখণ্ড থেকে উৎখাত করার সুপরিকল্পিত পদক্ষেপ। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ইজ়রায়েল ইতিমধ্যে প্রায় ১ লক্ষ টনের বেশি বোমা ফেলেছে গাজ়ার মাটিতে। যুদ্ধে নিহত হয়েছেন প্রায় ৫৬ হাজারের বেশি মানুষ, যাঁদের মধ্যে অধিকাংশই নারী ও শিশু। গাজ়ায় এমন পরিবার খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হবে, যারা যুদ্ধের বিভীষিকার শিকার হয়নি। কেউ প্রিয়জন হারিয়েছেন, কেউ আজীবনের জন্য পঙ্গু, কেউ মানসিক ট্রমা আক্রান্ত। শিশুদের কচি মনে এই যুদ্ধ চিরস্থায়ী ক্ষত চিহ্ন এঁকে দিয়েছে। ধ্বংসস্তূপে পরিণত ঘরবাড়ি, স্কুল, হাসপাতাল, দোকান, অফিস, এমনকি ধর্মস্থান। হামলা থেকে রেহাই পায়নি ত্রাণের লাইনে দাঁড়ানো ক্ষুধার্ত শিশু, নারী ও বৃদ্ধ। এই নিধনযজ্ঞ নিঃসন্দেহে এক মানবতাবিরোধী অপরাধ। সাম্প্রতিক ইতিহাসে নজিরবিহীন মানবিক বিপর্যয়।
বিস্মিত হতে হয় সমগ্র আন্তর্জাতিক মহলের ভূমিকা দেখে। মুখে মানবতার কথা বললেও, বাস্তবে ইজ়রায়েলের সামরিক আগ্রাসন বন্ধ করার কোনও পদক্ষেপ এখনও পর্যন্ত করতে পারেনি তারা। সকলেই এই নির্মম হত্যাযজ্ঞের নীরব দর্শক। রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধবিরতির একাধিক প্রস্তাব উঠলেও, শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর নিজেদের মধ্যে দলাদলির কারণে তা বার বার মুখ থুবড়ে পড়ছে। মানুষের জীবনের চেয়েও তাদের কাছে অধিক জরুরি নিজের নিজের ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ ও কূটনৈতিক দৌত্যকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।
এই নীরবতা ও নিষ্ক্রিয়তার সবচেয়ে লক্ষণীয় উদাহরণ আজকের আরব বিশ্ব। এই মুহূর্তে যাদের কাছে প্যালেস্টাইনিদের স্বার্থের চেয়েও বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে ভূ-রাজনীতি ও অর্থনৈতিক স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়া। অথচ, ১৯৪৮ সালে ইজ়রায়েল রাষ্ট্র ঘোষণার পর প্রথম আরব-ইজ়রায়েল যুদ্ধে জর্ডন, মিশর, সিরিয়া, লেবানন ও ইরাক একজোট হয়ে প্যালেস্টাইনের পক্ষে লড়াই করে। বস্তুত এই সময়ে প্যালেস্টাইন প্রশ্নটি ছিল আরব বিশ্বের রাজনৈতিক ঐকমত্যের চিহ্ন। কিন্তু একুশ শতকের পৃথিবীতে সেই ঐক্য যেন মানবিকতার মতোই কর্পূর হয়ে উবে গিয়েছে। সংযুক্ত আরব আমিরশাহি, বাহরাইন, মরক্কো ও সুদানের মতো দেশ শুধুমাত্র আমেরিকার সামরিক ও অর্থনৈতিক সমর্থন লাভের আশায়, ইজ়রায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। অন্য দিকে, সৌদি আরব-সহ বেশ কয়েকটি উপসাগরীয় দেশ ইজ়রায়েলকে ভাবে ইরানবিরোধী অক্ষের অংশ। প্যালেস্টাইনের পক্ষে অবস্থান নিয়ে এই কূটনৈতিক সম্পর্ককে ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে তারা আদৌ রাজি নয়। মিশর ও জর্ডনও এখন শরণার্থীদের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে মরিয়া।
পশ্চিম এশিয়ায় ইজ়রায়েল হল আমেরিকার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র এবং তার কৌশলগত ঘাঁটি, যা মার্কিন তেলনীতি, ইরান-বিরোধী অভিযান ও আঞ্চলিক আধিপত্য বজায় রাখার হাতিয়ার হিসাবে কাজ করে। তবে ১৯৯০-এর দশকে, শীতল যুদ্ধের পর, প্যালেস্টাইন ও ইজ়রায়েল প্রশ্নে আমেরিকা নিজেকে একটি নিরপেক্ষ মধ্যস্থতাকারী পক্ষ হিসাবে তুলে ধরতে সচেষ্ট হয়। ১৯৯১-এ মাদ্রিদ সম্মেলন এবং ১৯৯৩-এ অসলো চুক্তিতে দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের ধারণাটিকে গ্রহণ করা হয় শান্তি প্রতিষ্ঠার মৌলিক কাঠামো হিসাবে। এবং এই চুক্তিতেই প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও) ও ইজ়রায়েল পরস্পরকে স্বীকৃতি দেয়। প্রেসিডেন্ট ওবামার সময় পর্যন্ত এই দুই রাষ্ট্রকেন্দ্রিক নীতির মূল কাঠামোটি বজায় ছিল।
কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্পের পরিকল্পনায় সেই নীতি থেকে সরে আসার ছাপ স্পষ্ট। তিনি ইজ়রায়েল-প্যালেস্টাইন সমস্যা নিরসনে, ২০২০-তে যে ‘শান্তি পরিকল্পনা’ (পিস টু প্রসপারিটি) পেশ করেছেন, সেখানে প্যালেস্টাইনের (গাজ়া ও ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক) জন্য আর্থিক বিনিয়োগ ও পরিকাঠামো উন্নয়নের কথা থাকলেও, কৌশলে প্যালেস্টাইনিদের রাষ্ট্রীয় অধিকারকে উপেক্ষা করে ইজ়রায়েলের অবৈধ বসতিগুলোকে বৈধতা দেওয়ার কথা বলেছেন। সম্প্রতি তিনি গাজ়াকে ‘পশ্চিম এশিয়ার সমুদ্রনগরী’ বানানোর অভিলাষ ব্যক্ত করেছেন, তাই সেখানকার অধিবাসীদের পরামর্শ দিয়েছেন যাতে তাঁরা অন্যত্র চলে যান। ট্রাম্পের অবস্থান ইজ়রায়েলকে আরও বেশি আগ্রাসী করে তুলেছে।
ইংল্যান্ড, জার্মানি, ফ্রান্সের ভূমিকা— এবং সঙ্গে চিন ও রাশিয়ার ভূমিকাও খুবই পক্ষপাতমূলক। এই সংঘাতের দায় হামাসের উপর চাপিয়ে পরোক্ষ ভাবে ইজ়রায়েলের আক্রমণকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টাও হয়েছে। অথচ ইইউ কিন্তু ঘোষিত ভাবেই ‘দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান’-এর সমর্থক।
স্বাধীন ভারতের কূটনীতির ভিত্তি গড়ে উঠছিল উপনিবেশবিরোধী আন্দোলন ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের মূল্যবোধের উপর। এবং তার ভিত্তিতেই রচিত হয়েছিল ভারতের প্যালেস্টাইন ও ইজ়রায়েল নীতি। ১৯৭৪-এ প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও)-কে এবং ১৯৮৮-তে, রাষ্ট্র হিসাবে প্যালেস্টাইনকে স্বীকৃতি দেয় ভারত। আর এখন? ভারত প্যালেস্টাইনের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে ক্রমশ ইজ়রায়েলের দিকে ঝুঁকেছে, প্রতিরক্ষা, সাইবার নিরাপত্তা, কৃষি থেকে নজরদারির প্রযুক্তির স্বার্থে। গত কয়েক বছর ধরে দিল্লি সম্মিলিত রাষ্ট্রপুঞ্জে প্যালেস্টাইনের পক্ষে ভোটদানে বিরত থেকেছে। এ বারের সংঘর্ষেও উদ্বেগ প্রকাশ করলেও সরাসরি নিন্দা জানায়নি নয়াদিল্লি। সম্প্রতি রাষ্ট্রপুজ্ঞের নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধবিরতির যে খসড়া প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে, তাতেও বিপক্ষে ভোট দিয়েছে ভারত। একুশ শতকের পৃথিবীতে মানবতা বা নৈতিকতার বদলে রাষ্ট্রীয় স্বার্থ, অর্থনৈতিক লেনদেন ও ভূ-রাজনৈতিক কৌশলই একমাত্র বিবেচ্য। তাতে কেউ ধ্বংস হয়ে গেলেও কিছু যায় আসে না।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)