আপনার হাইট কত মশাই? কিছু মনে করবেন না।” রাজস্থানের পথে ট্রেনে লালমোহনবাবুর প্রশ্নের উত্তরে ফেলুদা বলল, ‘প্রায় ছয়’। লালমোহনবাবু বললেন, “আমার হিরোকেও আমি ছয় করিচি।” কোনও পক্ষেরই বুঝতে অসুবিধা হল না যে, ‘ছয়’ মানে ছ’ফুট। কিন্তু, লালমোহনবাবু যদি জানতে চাইতেন যে, ফেলুদার ওজন কত, প্রায় বাজি ধরে বলতে পারি, উত্তরটা কিলোগ্রামে হত, পাউন্ডে নয়। ব্যাপারটার মধ্যে মজা কোথায়, ক্লাস সিক্সের বিজ্ঞান পড়লেই যে কেউ বুঝবে— ফুট হল ‘ফুট-পাউন্ড-সেকেন্ড’ পদ্ধতির একক, আর কিলোগ্রাম হল মিটার-কিলোগ্রাম-সেকেন্ড পদ্ধতির। আমরা দিব্য মিলিয়ে-মিশিয়ে ব্যবহার করে চলেছি। শুধু কি এটুকুই? গাড়ি চড়লে দূরত্ব মাপি কিলোমিটারে, এমনকি মিটারেও— কিন্তু ঘরের মাপ বলতে গেলেই বলি ফুট-বর্গফুট। একই মুদিখানায় চিনি-ময়দা-চাল কিনি কিলোগ্রাম হিসাবে, পাউরুটি কিনি পাউন্ডের মাপে।
তাতে আমাদের দৈনন্দিন কাজ আটকায় না বটে, কিন্তু এমন মিলঝুলের হিসাব বহু গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রেই গ্রাহ্য নয়। আবার, শুধু এক রকম একক ব্যবহার করলেই তো হয় না, তার সঠিক মাপ কী, সেটাও জানা দরকার। শুধু ওজনের জন্য কেজি নয়, দৈর্ঘ্যের মিটার, সময় মাপার সেকেন্ড, তাপমাত্রার কেলভিন, তড়িৎপ্রবাহের অ্যাম্পিয়ার— এমন সব পরিচিত একক নিয়ে সঠিক মাপজোখ ছাড়া দুনিয়া অচল। প্রশ্ন উঠবে, এগুলোর সঠিক মাপ কী? কোন দেশ বা কোন সংস্থার মাপকাঠি সর্বজনগ্রাহ্য হবে? আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় যে মাপটা নিয়ে কোনও তর্কই থাকতে পারে না, তা হল সেকেন্ড। পৃথিবী নিজের অক্ষের চার পাশে এক বার ঘুরতে চব্বিশ ঘণ্টা সময় নেয়— অর্থাৎ ৮৬৪০০ সেকেন্ড। তার মানে, সেকেন্ড একক বলা যায় পৃথিবীর আহ্নিকগতির পর্যায়কালের ১/৮৬৪০০তম ক্ষুদ্র অংশ। কিন্তু, যে-ই জানতে পারি যে, পৃথিবীর ঘূর্ণন বেগ ক্রমশ কমছে— কোনও এক যুগে নিজের অক্ষের উপরে এক পাক ঘুরতে সময় লাগত তেইশ ঘণ্টা, অমনি সব গোলমাল! ঐতিহাসিক ভাবে আর সেকেন্ডের মাপকেও বিশ্বাস করা যায় না। অতএব, সর্বজনগ্রাহ্য এবং সর্বত্র ধ্রুব, এমন একক এবং তার সঠিক পরিমাপ তৈরি করার প্রয়োজন হল বিশ্ব জুড়েই।
আজ থেকে দেড়শো বছর আগে সে প্রয়োজন মিটল। দিনটি ছিল ১৮৭৫ সালের ২০ মে। প্রথম মিটার কনভেনশন অনুষ্ঠিত হল প্যারিস শহরে। তৈরি হয় ইতিহাস— দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত নানা একক নিয়ে দীর্ঘ দিনের বিভ্রান্তি নিরসনের জন্য গঠিত হয় ইন্টারন্যাশনাল ব্যুরো অব ওয়েটস আ্যন্ড মেজারস বা বিআইপিএম। তার মাত্র কয়েক বছর আগে ১৮৭০-৭১ জুড়ে ফ্রাঙ্কো-প্রুশিয়ান যুদ্ধে জার্মানির কাছে পরাজিত হয়ে ফ্রান্স হারিয়েছে তাদের দু’টি বিশাল অঞ্চল— আলযাস ও লাহরেন। সম্রাট তৃতীয় নেপোলিয়ন হয়েছেন নির্বাসিত। দেশ শাসনের জন্য তৈরি হয়েছে তৃতীয় রিপাবলিক। ভার নিয়েছে নতুন দল, নতুন নেতারা। অন্য দিকে, যুদ্ধ জয়ে ভবিষ্যতের প্রবল শক্তিধর দেশ জার্মানির অঙ্কুর বিকশিত হতে শুরু করেছে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, অর্থনীতি এবং মিলিটারি শক্তিতে। ইতিমধ্যে পরাজয়ের গ্লানি কাটিয়ে ফরাসিরা যে বিশ্বের তৎকালীন সমৃদ্ধিশালী অনেক দেশকে একক পরিমাপ নিয়ে আলোচনায় এক মঞ্চে নিয়ে আসতে পারবে, সেটি ভাবা কঠিন ছিল। মূলত ইউরোপ, আমেরিকা এবং লাতিন আমেরিকার সতেরোটি দেশের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে ওজনের একক কিলোগ্রাম এবং দৈর্ঘ্যের একক মিটার নিয়ে উদ্ভূত সমস্যাগুলি খতিয়ে দেখা হল। একটি সর্বজনগ্রাহ্য অনন্য একক পদ্ধতি— যা আজ ইন্টারন্যাশনাল সিস্টেম অব ইউনিটস বা এসআই পদ্ধতি নামে পরিচিত— তার বীজ বপন করা হয় বিআইপিএম সংস্থা পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে।
কয়েক বছরের মধ্যে লন্ডনের জনসন ম্যাথে তৈরি করে দিয়েছিল ৩০টি মিটার মাপের দণ্ড, আর ৪০টি চোঙাকৃতির কিলোগ্রাম। ১৮৮৯ সালে জেনারেল কনফারেন্স অব ওয়েটস অ্যান্ড মেজারস-এর (সিজিপিএম) প্রথম বৈঠকে গৃহীত হয় এই মিটার ও কেজির প্রামাণ্য রূপ। পরে ১৯৬০ সালে মোট সাতটি ভৌত রাশিকে মৌলিক ধরে বর্ধিত এমকেএস (মিটার কেজি সেকেন্ড) একক সমষ্টির নাম দেওয়া হয় এসআই মূল একক। আরও বাইশটি উপলব্ধ একককে নিয়ে পথ চলা শুরু করে এসআই। ২০১৯ সালের ২০ মে শেষ সংস্কার সাধিত হয় এসআই একক পদ্ধতিতে। সাতটি মৌলিক রাশির একক এখন নির্ধারিত সাতটি ধ্রুবকের মানের উপরে নির্ভর করে। যেমন মিটারের সংজ্ঞা দাঁড়িয়ে আছে শূন্য মাধ্যমে আলোর বেগের ভিত্তিতে— প্রতি সেকেন্ডে ২,৯৯,৭৯২,৪৫৮ মিটার। প্লাঙ্ক ধ্রুবকের সঙ্গে জুড়ে গেছে কেজি একক। সিজিয়াম ১৩৩ পরমাণুর নির্দিষ্ট বিকিরণের সঙ্গে সেকেন্ড। বোলৎসমান ধ্রুবকের সঙ্গে কেলভিন। অ্যাম্পিয়ার একক ইলেকট্রন আধানের উপর ভিত্তি করে সংজ্ঞায়িত, আভোগাদ্রো ধ্রুবক থেকে মোল একক। ভবিষ্যৎই বলবে মাপজোখের বিজ্ঞান বা মেট্রোনমি আরও কত বিস্ময় সৃষ্টি করে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দুনিয়াকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
পদার্থবিদ্যা বিভাগ, সেন্ট জ়েভিয়ার’স কলেজ, কলকাতা
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)