E-Paper

তিলোত্তমা টোটো স্ট্যান্ড

তেড়ে গালি দেওয়া মেয়েদের আত্মরক্ষার একটা উপায়। আর একটা উপায় রসিকতা। উল্টো দিকের অটো থেকে ভেসে এল ডাক, “এ বাসন্তী!” সরস্বতী পাল্টা হাঁকলেন, “এ গব্বর!”

স্বাতী ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০৬:১৮
চালিকা: টোটো চালিয়ে যাত্রী-পরিবহণের জীবিকা এঁদের কাছে প্রাত্যহিক কঠিন যুদ্ধ, দমদম ক্যান্টনমেন্ট।

চালিকা: টোটো চালিয়ে যাত্রী-পরিবহণের জীবিকা এঁদের কাছে প্রাত্যহিক কঠিন যুদ্ধ, দমদম ক্যান্টনমেন্ট।

পিচের আস্তরণ উঠে গিয়ে ইট বেরিয়ে পড়েছে, রাস্তার উপর নেমে এসেছে দোকান। দমদম ক্যান্টনমেন্টের এক নম্বর রেল গেট থেকে প্যাসেঞ্জার তুলে দু’নম্বর গেটে যাওয়ার পথে গর্তে পড়ে গাড়ি লাফিয়ে উঠছে বার বার। টোটোর চালক সরস্বতী চক্রবর্তী বললেন, “আমার কষ্টটা কিছু না। গাড়িটার কষ্ট হয়, এটাই খারাপ লাগে।” ভাড়া গাড়ি তো নয়, কাজ করে জমানো টাকায় কেনা। কী কাজ? কী না কাজ! কচি ছেলে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি ছাড়ার পর (“বড্ড মারত!”) বাচ্চা রাখার কাজ, ঘুরে ঘুরে বিস্কুট-চানাচুর বিক্রি, চা-ঘুগনির দোকান, কেটারিং ব্যবসার শেষে টোটো কেনা। ভাড়া দেবেন ভেবেছিলেন, কিন্তু নতুন টোটোখানা দেখে সরস্বতীর সাধ হল চালাতে। প্রথম চেষ্টাতে ইটের পাঁজায় ধাক্কা। গাড়ি তুবড়ে গেল, সরস্বতীর নাক ফাটল। তাতে আরও জেদ চেপে গেল মেয়ের।

আজ একচল্লিশ বছরের সরস্বতী দিনে দশ-বারো ঘণ্টা টোটো চালান। “সরস্বতীদিকে দেখেই আমরা এই লাইনে এসেছি,” বললেন রুম্পা সাহা, সঙ্ঘমিত্রা পটেল, রাখী বিশ্বাসরা। এখন দমদম ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় গোটা পঁচিশ মহিলা টোটো চালক। প্রায় সকলেই সংসারের প্রধান রোজগেরে। গৃহপরিচারিকা, আয়া, আনাজ-ফল বিক্রি, পুরসভার অস্থায়ী কর্মীর চাকরির পর এই লাইনে এসেছেন। তাঁদের গল্প মানে যুদ্ধের গল্প। “উবর-এর প্যাসেঞ্জার তুললেও ছেলেগুলো বলত, ‘তুই রাস্তা থেকে প্যাসেঞ্জার তুলছিস কেন?’ জোর করে চাবি খুলে নিত,” বললেন সঙ্ঘমিত্রা। “ইচ্ছে করে আমাকে দেখিয়ে ছোট বাইরে করত। কিছু বললে শোনাত, ‘এখানে সতীগিরি করলে হবে না।’ আগে আমার মুখ দিয়ে কথা বেরোত না। এখন এমন মুখ খারাপ করি, ওরাই চুপ করে যায়।”

তেড়ে গালি দেওয়া মেয়েদের আত্মরক্ষার একটা উপায়। আর একটা উপায় রসিকতা। উল্টো দিকের অটো থেকে ভেসে এল ডাক, “এ বাসন্তী!” সরস্বতী পাল্টা হাঁকলেন, “এ গব্বর!” দিঘায় যাওয়ার প্রস্তাব ছুড়ে দিলেন এক পুরুষ-চালক। চটুল উত্তর দিলেন সরস্বতীও। “কিছু মনে করবেন না দিদি, এই লাইনে এ সব চলে।” আরও কত কী চলে! “আমাদের প্যাসেঞ্জার জোর করে উঠিয়ে নিজেদের টোটোয় বসায়,” বললেন রুম্পা। গাড়ি ঘোরাতে বাধা দেওয়া, টাকা দাবি করা, গাড়ি ‘রেস’ করা, ইচ্ছে করে চেপে দেওয়া। ‘তুই’ সম্বোধন, অশ্লীল ইশারা, টোন-টিটকিরি। কথার আঘাতে নীরবে সরে গিয়েছে অনেক মেয়ে। সোনারপুরের ভবানী হালদার মেয়েদের একটি সমবায় সমিতির নেত্রী। সমবায়ের টাকায় টোটো কিনে ভবানীরা ছ’সাত জন চালাতে শিখেছিলেন। আশা ছিল, মেয়েরা সমবায় থেকে ঋণ নিয়ে টোটো কিনবে। অনর্গল টোন-টিটকিরির মুখে মেয়েরা পিছু হটেছে। একা ভবানী টোটো কিছু দিন চালিয়ে হাল ছেড়েছেন। “কেবল বলত, ‘তোর লজ্জাশরম নেই, শিক্ষা নেই, তাই টোটো চালাচ্ছিস।’ ছেড়ে দিলাম, কিন্তু খুব, খুব দুঃখ হয়।”

সবচেয়ে বড় যুদ্ধ টোটো স্ট্যান্ড নিয়ে। বছর পাঁচেক আগে সরস্বতী যখন নরেন্দ্র সিনেমার উল্টো দিকের স্ট্যান্ডে গাড়ি রাখতে চেয়েছিলেন, তখন তিন জন কাউন্সিলরের সুপারিশের চিঠি দেখাতে হয়েছিল। ক্রমে মেয়ে চালকদের সংখ্যা বাড়তে মেয়েরা চেয়েছিলেন নিজেদের স্ট্যান্ড। হকার কমিটির সঙ্গে কথা বলে গত সেপ্টেম্বরে দমদম ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনের বাইরে চার-পাঁচ জন মেয়ে টোটো রেখেছিলেন। পিছনে ফ্লেক্স, ‘তিলোত্তমা টোটো স্ট্যান্ড’।

১১ সেপ্টেম্বর অটো চালকরা বাঁশ, রড নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল। “ওরা বলছিল, ‘তিলোত্তমা স্ট্যান্ড করেছিস? তোদেরও তিলোত্তমা করে দেব।’ আমরাও ছাড়িনি লড়ে গিয়েছি,” বললেন মেয়েরা। র‌্যাফ নামল, পুলিশ এসে মেয়েদের টোটো নিয়ে গেল থানায়। পুরকর্তারা প্রথমে মেয়েদের বিকল্প স্ট্যান্ড ঠিক করলেন যেখানে, সেখানকার অটো চালকরাও বেঁকে বসল। অনেক কথাবার্তার পর এখন যেখানে স্ট্যান্ড দিয়েছে পুরসভা, সেখানে দিনে তিন-চারটে প্যাসেঞ্জারও মেলে না। অগত্যা মেয়েরা ‘ফ্লাইং প্যাসেঞ্জার’, নইলে অ্যাপ-এর যাত্রী তুলছেন। যুদ্ধবার্ষিকীর দিন (১১ সেপ্টেম্বর, ২০২৫) গিয়ে দেখা গেল, ফাঁকা স্ট্যান্ডে ল্যাম্পপোস্টের গায়ে বাঁধা হলুদ বোর্ডে লেখা, ‘তিলোত্তমা টোটো স্ট্যান্ড: তিলোত্তমা বিচার পাক, তিলোত্তমারা এগিয়ে যাক।’

এই বাধা সর্বত্র। বাউড়িয়ার একটি নারী সংগঠনের নেত্রী রহিমা খাতুন বললেন, “আমরা ত্রিশ জন মেয়েকে প্রশিক্ষণ দিয়েছিলাম টোটো চালানোর। কিন্তু স্ট্যান্ডের লোকেরা বলল, ছেলেরাই যেখানে করে খেতে পারছে না, সেখানে মেয়েরা ঢুকবে কেন? মাত্র একটি লড়াকু মেয়ে এখন টোটো চালাচ্ছেন।” সেই মেয়ে, আবদা নিশা, ঘুরে ঘুরে প্যাসেঞ্জার তোলেন। “আমাকে স্ট্যান্ডের লোকেরা বলে, তুমি লোকের বাড়ি কাজ করো, দোকান দাও। গাড়ি চালাতে এসেছ কেন?” মেয়েদের কাছে কিন্তু বাড়তি রোজগার ছাড়াও টোটো-চালনার আকর্ষণ, ইচ্ছেমতো সময়ে কাজ করার স্বাধীনতা। সংসার সামলে কেউ সকাল-বিকেল টোটো চালান, কেউ বিকেল থেকে মাঝরাত। পরিবারের বাধাও কমছে— তনু বারুইকে টোটো কিনে দিয়েছেন তাঁর মা। পথের দখল চাইছেন মেয়েরাও। কী করছে পুরসভা? “আমাদের সহানুভূতি রয়েছে,” বললেন দমদম পুরসভার উপ-পুরপ্রধান বরুণ নট্ট।

সক্রিয়তার নিদর্শন তামিলনাড়ু। সেখানে ‘পিঙ্ক অটো’ প্রকল্প চালু করেছেন মুখ্যমন্ত্রী এম কে স্ট্যালিন। অটো কিনতে এক লক্ষ টাকার ভর্তুকি দিচ্ছে সরকার, ব্যাঙ্ক ঋণের গ্যারান্টরও হচ্ছে। কয়েকটি অসরকারি সংস্থা চালক-প্রশিক্ষণ দেয় মেয়েদের, দেয় অটো কেনায় সহায়তা, কাজের ব্যবস্থাও করে। চেন্নাইয়ের চারশো মহিলা অটো চালক গড়েছেন ইউনিয়ন, ‘ভিরা পেঙ্গল মুন্নেত্র সংগম’ (বীরাঙ্গনা অগ্রগতি সংগঠন)। এত কিছু সত্ত্বেও চেন্নাইয়ের অটো চালক মেয়েরা অটো স্ট্যান্ডে জায়গা পাননি, জানালেন ভিপিএমএস-এর নেত্রী মোহনাসুন্দরী। “অথচ, এটা বিশেষ সুবিধার প্রশ্ন তো নয়। পাবলিক জায়গায় মেয়েদের সমানাধিকারের প্রশ্ন।” যাত্রী ধরতে অ্যাপ-ই ভরসা আপাতত। মোহনাসুন্দরীর অভিজ্ঞতা, অ্যাপ-নির্ভর, স্ট্যান্ডহীন পুরুষ চালকরা মেয়েদের সঙ্গে ভাল ব্যবহার করে, কিন্তু স্ট্যান্ডের চালকরা দুর্ব্যবহার করে।

“আইনত স্ট্যান্ডের জায়গা নির্দিষ্ট করা, কে দাঁড়াবে তা ঠিক করার কর্তৃত্ব পুরসভার,” বললেন ভিপিএমএস-এর কার্যকর্তা বিজয় জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদ। “কিন্তু বাস্তবে দশ-বারো জন অটোওয়ালা জড়ো হয়ে এক জন নেতার কাছ থেকে মৌখিক স্বত্ব নেন। বিনিময়ে মিছিল-সমাবেশে হাজির হতে হয়।” এই লেনদেন-এর ব্যবস্থায় মেয়েরা থাকে না বলেও তাঁদের নিতে নারাজ পুরুষরা। বিজয়ের মতে মেয়েদের জন্য অটো-প্রকল্প চালুর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য, আরও মেয়েকে দলীয় মিছিলে টানা। থাকতে পারে টাকার দাবিও। ভবানী জানালেন, টোটোর দাম এবং স্ট্যান্ডে দাঁড়ানোর অনুমোদন মিলিয়ে দু’লক্ষ টাকা চেয়েছিল সোনারপুরের একটি স্ট্যান্ড। মেয়েদের হাতে অত টাকা কোথায়?

চেন্নাইয়ে ভিপিএমএস এখন দু’ভাবে লড়ছে। এক, অটো স্ট্যান্ডগুলিতে মেয়েদের কেবল ঢোকাতেই চাইছে না, স্ট্যান্ড-ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট, সেক্রেটারি পদে নির্বাচিত করাতে চাইছে। আর দুই, কিছু মেট্রো স্টেশনের বাইরে কেবল মহিলা চালকদের স্ট্যান্ড তৈরি করতে চাইছে। এই দাবি কলকাতার মেয়েদেরও। “এতগুলো নতুন মেট্রো স্টেশন হল, একটার বাইরে আমাদের দাঁড়াতে দিক।” পুরকর্তারা বলছেন, “দেখছি।”

সংবিধান অধিকার দেয়, সরকার প্রকল্প দেয়, কিন্তু ভারতে কাজের বাজারের প্রকৃত স্বত্ব দেয় দলীয় রাজনীতি। পুরুষরা সেই স্বত্বের দখলকে ‘স্বাভাবিক’ মনে করে। মেয়েদের দূরে রাখতে তারা টেনে আনে সাবেক রীতিকে। দমদম ক্যান্টনমেন্টের এক পুরুষ-চালক যেমন বললেন, “মেয়েরা টোটো চালাতে চাইলে চালাক, কিন্তু রাত দশটার পর নয়। রাতে লোকেদের চাহনি খারাপ।” কথাটা উড়িয়ে দিলেন সরস্বতী, সঙ্ঘমিত্রারা। “বললেই হল? আমার সংসার কি ও চালাবে? আমরা রাত দেড়টা-দুটোতেও টোটো চালাই। হাজার-বারোশো টাকা না উঠলে ঘরে ফিরি না।” এই সব তিলোত্তমাদের নগরী কলকাতা।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Toto Driver Life Struggle Employment Politics

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy