Advertisement
E-Paper

আনন্দভূমি, দীপিকা পাড়ুকোন এবং ২২ সেকেন্ড!

‘পাঠান’ ছবির গানের দৃশ্যে দীপিকার গেরুয়া বিকিনি নিয়ে বিতর্ক দেখতে দেখতে মনে পড়ে গেল পাকিস্তানি ছবি ‘জয়ল্যান্ড’-এর কথা।

অনিন্দ্য জানা

অনিন্দ্য জানা

শেষ আপডেট: ১১ জানুয়ারি ২০২৩ ০৮:২৩
আপনার অভ্যাস আছে দীপিকা। পদ্মাবতী থেকে পদ্মাবত, করণীসেনার ভন্সালীকে চড়, ছপক, জেএনইউ... নিশ্চয়ই আপনি ভুলে যাননি।

আপনার অভ্যাস আছে দীপিকা। পদ্মাবতী থেকে পদ্মাবত, করণীসেনার ভন্সালীকে চড়, ছপক, জেএনইউ... নিশ্চয়ই আপনি ভুলে যাননি। মূল ছবি: দীপিকার ইনস্টাগ্রাম থেকে। ছবি সম্পাদনা: শৌভিক দেবনাথ।

আপনি কি ভুল দেশে জন্মেছেন, দীপিকা পাড়ুকোন?

‘জয়ল্যান্ড’ ছবিটা দেখতে দেখতে ঝপ করে আপনার কথা মনে পড়ল। ঘটনাচক্রে, ছবিটি অস্কারে প্রথম পাকিস্তানি ছবি হিসেবে মনোনয়ন পেয়েছে। গত বছর মে মাসে ‘কান’ চলচ্চিত্র উৎসবে প্রথম প্রদর্শন। প্রথম পাকিস্তানি ছবি, ‘কান’-এ যার প্রিমিয়ার হয়েছে। সেই উৎসবের সেরা ‘এলজিবিটিকিউ’ ছবি হিসেবে পুরস্কার তো বটেই, বিশেষ জুরি পুরস্কারও পেয়েছিল ‘জয়ল্যান্ড’।

লাহোর শহরের এক মধ্যবিত্ত পরিবারের কাহিনি। যার কর্তা ভীতিপ্রদ রকমের পিতৃতান্ত্রিক। যিনি তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র হায়দর এক নাটকের কামোত্তেজক নাচের দলে ছুটকো ভূমিকায় (গোপনে) কাজ পাওয়ার পর ছোট বৌমাকে চাকরি ছেড়ে বাড়িতে থাকতে বাধ্য করেন। দিন যায়। কাহিনির মোচড়ে খানিক ভীতু, খানিক দুর্বলচিত্ত, খানিক ‘মেয়েলি’ হায়দর প্রেমে পড়ে এক রূপান্তরকামী নর্তকীর। সেই সূত্র ধরেই এগোয় কাহিনি।

দু’ঘণ্টার কিছু বেশি সময়ের এই ছবিতে যা যা দেখানো হয়েছে, তা পাকিস্তানের পক্ষে যুগান্তকারী এবং বৈপ্লবিক। সমকামী (সম্ভবত) হায়দরের সঙ্গে নর্তকীর অন্তরঙ্গ চুম্বন, তার সঙ্গে পায়ুকামের চেষ্টা করে বিতাড়িত হওয়া, হায়দরের ‘অতৃপ্ত’ স্ত্রীর বাইনোকুলার দিয়ে বাড়ির সামনের গলিতে ফোনালাপরত পরপুরুষের উত্তুঙ্গ শিশ্ন কল্পনা করে কাঠের বাক্সের সঙ্গে স্বমেহনের চেষ্টা, অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ার পরে তার স্বেচ্ছায় ঝুঁকি নিয়ে শরীর ঝাঁকিয়ে গর্ভপাত করানোর চেষ্টা এবং কালক্রমে আত্মহত্যা, সেই মৃত্যুর পরে রক্ষণশীল পরিবারের পিতৃতান্ত্রিকতার বোরখা এক ঝটকায় খুলে ফেলে তার জায়ের ক্রুদ্ধ উদ্গীরণ— ‘‘হম সব নে মিলকে মার দিয়া উসকো!’’

একের পর এক জোরালো, সাহসী এবং বাঙ্ময় মুহূর্ত তৈরি হয়েছে ছবিতে। যে ছবির নারী চরিত্র প্রথাগত নারীর ভূমিকাকে অস্বীকার করে। যে ছবির পুরুষ চরিত্র পৌরুষের গা-জোয়ারির ধার ধারে না। ‘জয়ল্যান্ড’। আনন্দভূমি। প্রকাশের আনন্দ। স্বাধীন চিন্তার উদ্‌যাপনের আনন্দ।

স্বাধীন চিন্তার উদ্‌যাপনের আনন্দ ‘জয়ল্যান্ড’। রূপান্তরকামীর চরিত্র ‘বিবা’র ভূমিকায় আলিনা খান।

স্বাধীন চিন্তার উদ্‌যাপনের আনন্দ ‘জয়ল্যান্ড’। রূপান্তরকামীর চরিত্র ‘বিবা’র ভূমিকায় আলিনা খান। ছবি: সংগৃহীত।

দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, এই-ই কি সেই দেশ, যেখানে বসে তহমিনা দুরানি একদা লিখেছিলেন আত্মজৈবনিক কাহিনি ‘মাই ফিউডাল লর্ড’? যার ছত্রে ছত্রে বর্ণনা ছিল তাঁর স্বামীর ঘরে দম-আটকানো অনাচার এবং অত্যাচারের। যে পাকিস্তানি সমাজের কথা পড়ে শিউরে উঠতে হয়েছিল। মনে হয়েছিল, এই নাকি অন্তঃপুর! ‘জয়ল্যান্ড’ দেখতে দেখতে মনে হল, নাহ্, এই পাকিস্তান সেই পাকিস্তান নয়। মনে হল, পাকিস্তানের মতো একটি দেশে যে এই ছবি বানানো হয়েছে, সেটাই এক মূর্তিমান বিপ্লব!

আর মনে হচ্ছিল দীপিকা, আপনার কথা। ‘পাঠান’ ছবিতে একটি ৩ মিনিট ১৪ সেকেন্ডের গান। যার দৃশ্যায়নে রয়েছে‌ন আপনি এবং শাহরুখ খান। নীল সমুদ্র, তাতে দূরগামী ইয়টের অবয়ব, বালিয়াড়ি, ডেক চেয়ার, উদ্ভিন্নযৌবনা রমণীকুল এবং তাদের মধ্যে লাস্যময়ী আপনি এবং খরখরে চেহারার শাহরুখ।

‘বেশরম রং...’ বলে একটি মাপমতো অখাদ্য গানের সঙ্গে আপনাকে একটি আশরীর নাচ নাচতে হয়েছে। কিন্তু সেটা বড় কথা নয়। আসল কথা হল, সেখানে আপনাকে ২২ সেকেন্ডের জন্য একটি গেরুয়া রঙের বিকিনি পরিহিতা অবস্থায় দেখা গিয়েছে। মাত্র ২২ সেকেন্ড!

ব্যস! দাবি উঠেছে, ‘পাঠান’ ছবি থেকে ওই গানটাই বাদ দিতে হবে! সেই মর্মে কেন্দ্রীয় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রকের কাছে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন এক আইনজীবী। তাঁর অভিযোগের মর্মার্থ— গেরুয়া রঙের বিকিনি পরে আপনি এবং শাহরুখ যে গানটি পারফর্ম করেছেন, সেটি দেখতে এবং শুনতে অতীব অশ্লীল। ফলে আপনাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। এহ বাহ্য, কোথায় কোন সাধু শাহরুখের পারলৌকিক ক্রিয়াদি করেছেন। বিজেপির কোন কুচো নেতা বলেছেন, ‘‘এটা সনাতন হিন্দু ধর্মের সংস্কৃতিকে অপমান!’’ মধ্যপ্রদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী (এটা কিন্তু সিরিয়াস। মন্ত্রী আফটার অল) বলেছেন, ‘‘অশ্লীল এবং নিন্দনীয়। এই গান অত্যন্ত নোংরা মানসিকতা নিয়ে তৈরি করা হয়েছে। আমরা মধ্যপ্রদেশে এই ছবি দেখাতে দেব না!’’

গেরুয়া বিকিনির ২২ সেকেন্ডের দৃশ্য ছেঁটে ফেলার দাবিতে বিক্ষোভ নানা প্রান্তে।

গেরুয়া বিকিনির ২২ সেকেন্ডের দৃশ্য ছেঁটে ফেলার দাবিতে বিক্ষোভ নানা প্রান্তে। ছবি: পিটিআই।

তবে কিনা, দীপিকা, এ সবে আপনার অভ্যাস আছে। ‘পদ্মাবতী’র সেটে ঢুকে করণীসেনা নামক এক ভুঁইফোড় সংগঠনের হামলাবাজদের পরিচালক সঞ্জয় লীলা ভন্সালীর মতো ওজনদারকে সপাটে চড় কষানো এবং তার অভিঘাতে ছবির নাম ‘পদ্মাবত’ হয়ে যাওয়া তো আপনি দেখেছেন। আপনার ‘ছপক’ মুক্তির আগে দিল্লির জেএনইউ-র আন্দোলনরত পড়ুয়াদের জমায়েতে গিয়ে স্রেফ দাঁড়ানোর জন্য সেই ছবি নিয়ে কী হয়েছিল, তা-ও নিশ্চয়ই আপনি ভুলে যাননি।

তখন কিছু প্রতিবাদ অবশ্য হয়েছিল। যেমন এখনও হয়েছে। নাসিরুদ্দিন শাহের পত্নী রত্না পাঠক শাহ এবং পরিচালক ওনির আপনার পাশে দাঁড়িয়েছেন। কিন্তু কে না জানে, এ সব প্রতিবাদের হাওয়া ‘ঝড়’ হওয়ার আগে থেমে যায় এ দেশে। অসহিষ্ণুতার গর্জন সঙ্গে পেয়ে যায় ফিল্ম সেন্সর বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রসূন জোশীকে। যিনি বলেন, ‘‘পাঠান-এর নির্মাতাদের বলা হয়েছে কিছু দৃশ্য এবং গান বদলে ছবিটি আবার জমা দিতে। পাশাপাশিই বলতে চাই, আমাদের সংস্কৃতি এবং বিশ্বাস খুব জটিল। অত্যন্ত সূক্ষ্ণ বিষয়েও তাতে টোল পড়তে পারে। আমাদের দেখতে হবে, সত্য থেকে যাতে আমাদের দৃষ্টি ঘুরে না যায়!’’

সত্য? সত্যই বটে!

সেই সত্য ‘জয়ল্যান্ড’ নিয়ে পাকিস্তানও প্রাথমিক ভাবে দেখেছিল। যখন পাক তথ্য এবং সম্প্রচার মন্ত্রক ১৯৭৯ সালে জারি-হওয়া একটি অধ্যাদেশের বলে দেশে ছবিটির মুক্তি নিষিদ্ধ করেছিল। জামাতে ইসলামির এক সেনেটর বলেছিলেন, ‘‘এই ছবি পাকিস্তানি মূল্যবোধের বিরোধী। পাকিস্তানি রূপান্তরকামীদের গ্লোরিফাই করে দেখানো, তাদের প্রেমের এমন উদ্‌যাপন আমাদের বিশ্বাসের উপর সরাসরি আঘাত।’’

কিন্তু কড়া প্রতিবাদ হয়েছিল। বেজায় কড়া। ছবির পরিচালক ইনস্টাগ্রামে লিখেছিলেন, ‘‘এই সিদ্ধান্ত অসাংবিধানিক এবং বেআইনি। এই ছবিতে ইসলামের বিরোধী কিছু নেই। আর আমি এটাও বুঝতে পারছি না যে, কী ভাবে একটি সিনেমা ইসলামের ক্ষতি করতে পারে!’’

‘জয়ল্যান্ড’-এর একটি দৃশ্যে হায়দরের স্ত্রীর চরিত্রে মুমতাজ।

‘জয়ল্যান্ড’-এর একটি দৃশ্যে হায়দরের স্ত্রীর চরিত্রে মুমতাজ। ছবি: সংগৃহীত।

লিখেছিলেন ছবির নির্বাহী প্রযোজকও। তিনি আবার দুনিয়ায় খানিক পরিচিত। নোবেল জিতে বসে আছেন হাজার হোক! নাম মালালা ইউসুফজাই। সেই বীর কিশোরী লিখেছিলেন, ‘‘এই ছবি আসলে পাকিস্তানের প্রতি এক ভালবাসার চিঠি। এই ছবি পাকিস্তানের সংস্কৃতি, খাবারদাবার এবং সর্বোপরি পাক জনতার জন্য লেখা প্রেমের অভিজ্ঞান। এটা অত্যন্ত দুঃখের যে, এমন একটা ছবিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হল এই যুক্তি দেখিয়ে যে, এই ছবি আমাদের জীবন, আমাদের যাপনের কথা বলে না। আসলে সত্যিটা এর উল্টো— এই ছবি পাকিস্তানের কোটি কোটি সাধারণ মানুষের জীবনের কথা বলে, দৈনন্দিন বাস্তবের কথা বলে। সেই সব সাধারণ পাক নাগরিকের কথা বলে, যাঁরা স্বাধীন চিন্তা চান, পূর্ণতা চান। যাঁরা তাঁদের ভালবাসার মানুষদের জন্য আনন্দের মুহূর্ত নির্মাণ করেন।’’

‘জয়ল্যান্ড’ পাকিস্তানে মুক্তি পাওয়ার কথা ছিল গত বছরের ১৮ নভেম্বর। তার আগেই জারি হয়েছিল নিষেধাজ্ঞা। ১৬ তারিখে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয় (মনে করতে চাই, বিভিন্ন স্তরে সরব প্রতিবাদের মুখে পড়েই)। স্বয়ং পাক প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের তরফে জানানো হয়, সরকার নিযুক্ত একটি কমিটি ছবিটি দেখে সামান্য কিছু উত্তেজক দৃশ্য কাটছাঁট করে সেটি মুক্তির অনুমতি দিয়েছে। নির্দিষ্ট দিনেই মুক্তি পেয়েছিল তথাকথিত ‘বিতর্কিত’ ছবি। এবং দেশের সঙ্গে বিদেশেও হিল্লোল তুলেছিল। যার তরঙ্গ সীমান্ত পেরিয়ে এসে পৌঁছেছে এ দেশেও। ২৮তম কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে দেখানো হয়েছে ‘জয়ল্যান্ড’।

কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ‘জয়ল্যান্ড’ দেখানো হল। কিন্তু দেখাতে দিল না কেরলের উৎসব।

কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ‘জয়ল্যান্ড’ দেখানো হল। কিন্তু দেখাতে দিল না কেরলের উৎসব। ছবি: রয়টার্স।

কিন্তু কেরল আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে দেখানো হয়নি! উৎসবের নান্দনিক অধিকর্ত্রী ছবিটি বাতিল করেছিলেন। প্রশ্ন করায় বলেছিলেন, ‘‘এই বিষয়ে এই ফেস্টিভ্যালে অনেক ছবি দেখানো হচ্ছে। ব্যক্তিগত ভাবে আমার এই বিষয় নিয়ে অন্য একটা ছবি ভাল লেগেছে। ‘জয়ল্যান্ড’ অনাবশ্যক খানিকটা লম্বা বলেও আমার মনে হয়েছে।’’

পড়ে মনে হচ্ছিল, কারও ‘ব্যক্তিগত’ পছন্দ-অপছন্দের উপর ভিত্তি করে একটি ছবিকে আন্তর্জাতিক উৎসবের তালিকা থেকে ছেঁটে ফেলা যায়? বিশেষত, সেই ছবি, যেটি অস্কারে মনোনীত?

কেউ প্রতিবাদ করেননি। ইন্ডাস্ট্রির কেউ মুখ খোলেননি। কোনও দেশজ নোবেলজয়ী আপনার সমর্থনে কলম ধরেননি। লেখার প্রথম লাইনে প্রশ্ন তোলাটা ভুলই ছিল। আপনি ভুল দেশেই জন্মেছেন, দীপিকা পাড়ুকোন!

Pathaan Joyland Film Controversy Shah Rukh Khan Deepika Padukone
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy