Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪
Duare Ration

Duare Ration: কার্ড আছে, রেশন নেই

এখন রেশন কার্ডের সঙ্গে প্রত্যেক উপভোক্তার ফিঙ্গার প্রিন্ট সংযুক্তিকরণের ব্যবস্থাটি বাধ্যতামূলক হয়েছে।

প্রহেলী ধর চৌধুরী
শেষ আপডেট: ০৭ এপ্রিল ২০২২ ০৫:৩৮
Share: Save:

আদিজা বেগমকে (নাম পরিবর্তিত) যখন জিজ্ঞেস করলাম যে, খাদ্যসাথী প্রকল্পের চাল ও আটা তিনি প্রত্যেক মাসে মাসে পাচ্ছেন কি না, সরাসরি উত্তর এল: “না তো!”
পাঁচ সদস্যের পরিবার, মাথাপিছু প্রতি মাসে দু’কেজি করে চাল আর প্রায় তিন কেজি করে আটা বরাদ্দ। মাসে মাসে সেই চাল আর আটা যে তোলাও হচ্ছে, তার হিসাবও রয়েছে পরিষ্কার। তবে? আর কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই আদিজার স্বামী ফোনটি ধরলেন। সেখানেই প্রশ্নোত্তরের ইতি।

আরও বেশ কয়েক জনের সঙ্গে কথা বলার পর ব্যাপারখানা স্পষ্ট হল। সরকারি খাতায় এঁদের সবার নামে রেশন কার্ড থাকলেও, এবং সেই কার্ডে প্রতি মাসে তাদের পরিবার থেকে চাল, গম তোলা হলেও, তা পৌঁছচ্ছে না তাঁদের হাতে। আসলে আদিজার পরিবারের পুরুষেরা সময়মতো রেশনের চাল, গম তুলছেন। কিন্তু তা বাড়িতে না এনে, অনেক সময়েই সরাসরি বেচে দিচ্ছেন বাজারে। তা হলে সংসার চলছে কী করে? খাচ্ছেন কী? কখনও ধারদেনা করে, আবার কখনও বা পরিচারিকার কাজ করে, সেলাই করে বা বিড়ি বেঁধে বৌয়ের রোজগার করা মাসিক আড়াই-তিন হাজার টাকাতেই চলছে সংসার। শুধু আদিজার পরিবারেই নয়, বহু পরিবারেই একই ছবি।

এখন রেশন কার্ডের সঙ্গে প্রত্যেক উপভোক্তার ফিঙ্গার প্রিন্ট সংযুক্তিকরণের ব্যবস্থাটি বাধ্যতামূলক হয়েছে। এই ব্যবস্থায়, প্রত্যেক ব্যক্তিকে তাঁর নিজের নামের কার্ডটি চালু করার জন্য বাধ্যতামূলক ভাবে রেশন দোকানে গিয়ে নিজের আঙুলের ছাপটি গিয়ে দিতে হয়। এতে তো বিষয়টি সম্পর্কে আদিজাদের অজ্ঞতা দূর হওয়ার কথা। মুশকিল হল, আদিজারা ফিঙ্গার প্রিন্ট দিচ্ছেন, কার্ডও পাচ্ছেন। তার পর পরিবার থেকেই তাঁদের বোঝানো হচ্ছে যে, কার্ডে কিছু সমস্যা হচ্ছে বলে রেশন পাওয়া যাচ্ছে না। অতঃপর পরিবারের লোকজনই সেই রেশন তুলে বাজারে বিক্রি করে দিচ্ছেন। আদিজারা জানেন না।

আর জানলেই বা কী আসে যায়? বদলায় না কিছুই। যেমন বদলায়নি গীতারানি মণ্ডলের ক্ষেত্রে (নাম পরিবর্তিত)। চুয়াল্লিশ বছরের গীতাদেবীকেও জিজ্ঞাসা করি একই প্রশ্ন: খাদ্যসাথী প্রকল্পের চাল আটা পাচ্ছেন প্রতি মাসে? নিরুত্তাপ গলায় উত্তর আসে, “সে কথা ছেলের বাবা বলতে পারবে!”

আপনি জানেন না? আপনার নামেও তো আলাদা কার্ড আছে।
“আছে তো!”

গীতারানির গলায় এই ‘আছে তো’ বলে দেয়, ওই ছোট দু’টি শব্দে আসলেই অনেক কিছু আছে। জানা আছে যে, আত্মীয়-বন্ধু বা প্রতিবেশীদের কাছে তাঁর পরিচয় কেবলমাত্র ‘রাজুর মা’ হলেও, অন্তত সরকারের খাতায় নিজের গোটা নামটা আছে। জানা আছে যে, সেই নামে আস্ত একটা কার্ড আছে, সেই কার্ডে মাসে মাসে চাল-আটার সুরক্ষা আছে। আর জানা আছে, এ সব জানাজানিতে যে আসলে কিচ্ছুটি যায় আসে না, সেই চ্যালেঞ্জের সুর।

কী রকম? গীতারানি ভালই জানেন যে, তাঁর সংসারের ছ’জন সদস্যের মোট ছ’টি খাদ্যসাথী কার্ড আছে, এবং সেই কার্ডে মাথাপিছু প্রত্যেক মাসে দুই কেজি চাল আর তিন কেজি আটা দেওয়া হয়। কিন্তু ওই জানাটুকুই সার। আজ অবধি এক সঙ্গে এত রেশন হেঁশেলে কখনও দেখেননি তিনি। কী হয় ওই রেশন? প্রশ্ন শুনে গীতারানি চুপ করে থাকেন। হয়তো তিনি সত্যিই জানেন না কী হয়, কোথায় যায় সেই রেশন। অথবা হয়তো জানেন, ওই রেশন বিক্রির টাকাতেই তাঁর স্বামীর মদের জোগান হয়।

গীতার মতো অল্প কথার মানুষ নন রিঙ্কু মান্ডি (নাম পরিবর্তিত)। তিনি বলে চলেন। বছর দুয়েক আগে পাশের গ্রামেই বিয়ে হয় তাঁর। বিয়ে করে রিঙ্কু শ্বশুরবাড়ি এলেন। আর সেই থেকে রিঙ্কুর বাপের বাড়ির পাঁচ সদস্যের জন্য বরাদ্দ মাসিক দশ কেজি চাল আর পনেরো কেজি আটাও প্রতি মাসে রিঙ্কুর শ্বশুরবাড়িতেই আসতে থাকল। “এই রেশনের চাল-আটাতেই আমাদের রান্না হয়। দু’বাড়ি মিলিয়ে যা পাওয়া যায়, তাতে আমাদের হয়ে বেশি।” ‘হয়ে বেশি’, তবু তা শ্বশুরবাড়িতেই যায়। উপরিটুকুও ফেরত যায় না বাপের বাড়ির লোকের কাছে। এ ঘটনা কি শুধু কি রিঙ্কুর শ্বশুরবাড়ির? তার আশেপাশে যত ঘরে যত রিঙ্কু এসেছেন বিয়ে হয়ে, সে সব ঘরের হেঁশেলেই তাঁদের বাপের বাড়ির রেশনের চাল ফোটে। এটাই এখানকার নিয়ম।

“প্রত্যেক বাড়ির একটা নিয়ম থাকে— সংসার করতে গেলে তা নিয়ে অত প্রশ্ন করতে নেই।” বিয়ের সময় গ্রাম শহরের সীমানা ছাড়িয়ে; পুরুলিয়া- বাঁকুড়া-কলকাতার গণ্ডি পেরিয়ে সব মা তাঁদের মেয়েদের পইপই করে শিখিয়ে দিয়েছেন এই জীবনদর্শন— সবার সঙ্গে থাকতে গেলে নিজেকে একটু মানিয়ে-গুছিয়ে নিতে হয়। সংসারে এই মানিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব তো মেয়েদেরই!
তাই রিঙ্কুরা মানিয়ে নেন। নিজের ভাগের খাবারটুকু নিজের ভাগ্যে না জুটলেও মানিয়ে নেন। রেশন কার্ড থাকা সত্ত্বেও রেশন পাওয়া যাচ্ছে না বলে, পেট চালানোর জন্য সারা দিনের কাজকর্মের পর রাত জেগে সেলাই মেশিনে কাজ করতে করতে মানিয়ে নেন। রোজ দু’বেলা বাপের বাড়ির রেশনের ভাত শ্বশুরবাড়ির পাতে বেড়ে দিতে দিতে মানিয়ে নেন। রেশনের চাল বেচে মদ খেয়ে বাড়ি ফেরা স্বামীর হাতের মার খেতে খেতেও ওঁরা মানিয়ে নেন।

আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Duare Ration Ration Card problem
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE