E-Paper

সবাই এখন ইতিহাসবোদ্ধা

পাশ্চাত্যে উনিশ শতক নাগাদ উদ্ভূত হয়েছিল পেশাদারি ইতিহাসশাস্ত্র; আমাদের দেশে বিশ শতকের প্রথমার্ধ নাগাদ। জ্ঞানচর্চার এই পেশাদারিকরণের একটি পরিণাম জনসাধারণের থেকে তার বিচ্ছিন্নতা।

রাজকুমার চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ১৯ নভেম্বর ২০২৫ ০৫:১০

ফেসবুক ও ওয়টস্যাপ ইউনিভার্সিটির যুগে একটি ‘নিঃশব্দ বিপ্লব’ (আসলে প্রতিবিপ্লব) ঘটে গিয়েছে। আমরা ভুলে গিয়েছি, জ্ঞানচর্চার জন্য পরিশ্রম ও নিবিড় নিষ্ঠার প্রয়োজন, নিছক ‘কমন সেন্স’ জ্ঞানের উৎপাদনে যথেষ্ট নয়।

ভারতীয় আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যে ‘অধিকারীভেদ’ বলে একটি কথা ছিল। তবে সেখানে অধিকারের বিভাজনটা কিছুটা সামাজিক ও জন্মগত। আধুনিক জ্ঞানচর্চার জগৎটি এমনিতে সর্বজনীন— খাতায়-কলমে সকল মানুষের জন্যেই উন্মুক্ত। সেই সঙ্গে মনে করা হয়, নির্দিষ্ট পদ্ধতিতন্ত্র বা মেথডোলজি মেনে নিরলস চর্চা ও গবেষণাই যথার্থ ‘অধিকারী’ হয়ে ওঠার পথ। বিভিন্ন ডিসিপ্লিন-এর উদ্ভব ও জ্ঞানচর্চার ‘পেশাদারিকরণ’— যার মাধ্যমে শুধু ‘জ্ঞান’ উৎপন্ন হয় না, জ্ঞানের প্রশিক্ষিত ‘উৎপাদক’-ও জন্ম নেয়— এক নতুন ‘অধিকারীভেদ’-এর জন্ম দিয়েছিল। এতে ‘জ্ঞান’ ও ‘ক্ষমতা’-র যোগ অস্বীকৃত হয়নি। এই ‘সমস্যা’-কে নিশ্চয়ই আমরা বিশ্লেষণের আওতাভুক্ত করতে পারি, প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে স্বীকৃত জ্ঞানকে প্রশ্নবিদ্ধও করতে পারি। কিন্তু সেই ‘প্রতিস্পর্ধী জ্ঞান’-এর অবলম্বনও নিছক পড়ে-পাওয়া কিছু ধারণা কিংবা জনশ্রুতি নয়। ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে নিবিড় চর্চা ও গবেষণা সেই বিকল্প জ্ঞানেরও পূর্বশর্ত।

অধুনা ফেসবুক-ওয়টস্যাপের যুগে এই ব্যবস্থাপনাটাই ভেঙে পড়েছে। নাগরিকদের একটি বড় অংশ মনে করছে, কোনও রকম পরিশ্রম ও নিবিড় অনুশীলন ছাড়াই, দু’-একটি ‘মেসেজ’-এর অলস পাঠই জ্ঞানার্জনের জন্যে যথেষ্ট। সমাজমাধ্যমে আলটপকা মন্তব্য করে নিজের ‘অজ্ঞতা’ প্রকাশ করতেও সে কুণ্ঠাহীন। কারণ, এখন সেই অজ্ঞতার সমঝদার ও ‘বাহা বাহা’ করে তাল দেওয়ার লোকেরও অভাব নেই।

সমস্ত ডিসিপ্লিনের মধ্যে প্রবণতাটি সবচেয়ে বেশি বোধ হয় ইতিহাসকে নিয়ে। মানুষের মধ্যে এই ধারণা বদ্ধমূল যে, ইতিহাস জানতে খুব বেশি মেধা ও চর্চার দরকার হয় না, সমাজমাধ্যম থেকে কিছু তথ্য ও লেখা পড়ে নিলে কিংবা জনপ্রিয় কথাসাহিত্য পড়ে ও বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র দেখেই জেনে ফেলা যায় ‘সাচ্চা ইতিহাস’। লক্ষ করা দরকার, ইতিহাস নামক শাস্ত্রটির কেউ ছাত্র হন বা না হন, সমাজবদ্ধ মানুষ হিসেবেই তাঁর কিছু ইতিহাস-কল্পনা থাকে, যা তিনি সমাজ থেকে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে আহরণ করেন। ইতিহাসবিদ ও সমাজ-বিজ্ঞানীদের পরিভাষায় এই ধরনের ইতিহাস-কল্পনার নাম ‘সামাজিক স্মৃতি’। লোককথা, প্রবাদ-প্রবচন, জনশ্রুতি, কথাসাহিত্য, যাত্রা-নাট্য-চলচ্চিত্র, পাঠ্যপুস্তক, জাতীয় ছুটির দিবস, প্রত্নবস্তু, স্মৃতিস্তম্ভ ইত্যাদি নানা কিছুর সমন্বয়েই গঠিত হয় সামাজিক স্মৃতির এই ভান্ডার।

সামাজিক স্মৃতি ও আধুনিক ইতিহাসবিদ্যা এক নয়। আমার বিবেচনায় উভয়ের তিনটি মূল পার্থক্য। প্রথমত, সামাজিক স্মৃতি স্বতঃস্ফূর্ত, কোনও সচেতন বৌদ্ধিক ক্রিয়া ব্যতিরেকেই মানবমনে তা স্বতঃসিদ্ধ ভাবে আত্মস্থ হয়। অন্য দিকে, ইতিহাস হল একটি সমালোচনাত্মক শাস্ত্র, এর মূলে আছে সাক্ষ্যপ্রমাণের অনুপুঙ্খ চর্চা ও সূত্র-সমালোচনা পদ্ধতি। এই পদ্ধতির প্রয়োগে সামাজিক স্মৃতিতে অ-বহমান কোনও বিষয়ের উপর যেমন ইতিহাসবিদ্যা আলোকপাত করতে পারে, তেমনই সামাজিক স্মৃতিতে ভেসে থাকা কোনও অপ্রমাণিত বিশ্বাসকেও পারে প্রশ্নবিদ্ধ করতে।

দ্বিতীয়ত, ঐতিহাসিক জ্ঞানে অতীতের কালানুক্রমিক বা পর্যায়ক্রমিক বর্ণনা প্রকাশিত হয়। সময়-এর প্রবহমানতা সম্পর্কে ইতিহাস সচেতন। অন্য দিকে, সামাজিক স্মৃতি খণ্ড-বিচ্ছিন্ন কিছু স্মৃতির টুকরো— যা ক্রমপরম্পরা মেনে স্মৃতির মধ্যে সুবিন্যস্ত থাকে না। তৃতীয়ত, আধুনিক ইতিহাসবিদ্যা কালানৌচিত্যবোধ সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন। সামাজিক স্মৃতির প্রবণতাই হল কালানৌচিত্যদোষ (অ্যানাক্রনিজ়ম)— বর্তমান-কালের ভাবনা ও ধারণাগুলিকে অতীতের উপর ভ্রান্ত ভাবে (অনৈতিহাসিক ভাবে) আরোপ করে দিতে এর জুড়ি নেই। কেউ যখন প্রাচীন ভারতে ‘দেশপ্রেম’ খুঁজে পায়, প্রাচীন ও মধ্যযুগের প্রারম্ভে ‘হিন্দু সম্প্রদায়’-এর অস্তিত্ব, অথবা রানাপ্রতাপের মধ্যে ‘জাতীয়তাবাদী নায়ক’, তখন তা এই রকম কালানৌচিত্যদোষের দৃষ্টান্ত হয়ে ওঠে।

পাশ্চাত্যে উনিশ শতক নাগাদ উদ্ভূত হয়েছিল পেশাদারি ইতিহাসশাস্ত্র; আমাদের দেশে বিশ শতকের প্রথমার্ধ নাগাদ। জ্ঞানচর্চার এই পেশাদারিকরণের একটি পরিণাম জনসাধারণের থেকে তার বিচ্ছিন্নতা। উচ্চশিক্ষার সংস্পর্শে খুব কম মানুষই আসতে পারত, গবেষণালব্ধ ঐতিহাসিক জ্ঞানকে গণমানসে ছড়ানোর জন্যে বিরাট কোনও ইতিহাস-আন্দোলনও গড়ে তোলা যায়নি। ‘সামাজিক মন’-কে প্রভাবিত করার জন্যে বিদ্যালয়স্তরের পাঠ্যপুস্তকের কিছুটা ভূমিকা অবশ্য আছে (যদিও সে-প্রভাব খুব বেশি নয়)। ভারতীয় নেশন-স্টেট সেই দায়িত্ব গ্রহণ করে ছাত্রছাত্রীদের ধর্মনিরপেক্ষ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উদার জাতীয়বাদের পাঠ দেওয়ার প্রয়াসও নিয়েছিল। কিন্তু এত বছর পরে ফিরে-দেখলে বোঝা যায় সেই পাঠ প্রত্যাশিত ফলাফল সৃষ্টি করতে পারেনি। সামাজিক স্মৃতির জগৎটা বিদ্যায়তনিক ইতিহাস ভাষ্যের বাইরে (বা তার সঙ্গে ক্ষীণ সম্পর্ক রেখে) বহাল তবিয়তেই থেকে গিয়েছিল।

হালে ভারতীয় নেশন স্টেটের জাতীয়তাবাদের ভাষ্যের বদল ঘটেছে— অন্তর্ভুক্তিমূলক ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে তার স্পষ্ট ঝোঁক এখন হিন্দু জাতীয়তাবাদী (আরও সঠিক অর্থে, হিন্দুত্ববাদী) ভাষ্যের প্রতি। এই প্রেক্ষিতে ক্ষমতাসীন রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বের সঙ্গে ইতিহাসশাস্ত্রের পেশাদার জগৎটির কিছু দ্বন্দ্ববিরোধ দেখা যাচ্ছে। বর্তমান নেতৃত্ব যেমন ইতিহাস ভাষ্য চাইছেন, প্রথম সারির ইতিহাসবিদেরা তেমন ইতিহাস-ভাষ্য সরবরাহ করতে পারছেন না। কৃতবিদ্য ইতিহাসবিদদের তরফে রাষ্ট্র-অনুমোদিত পাঠ্যপুস্তকগুলির বিরুদ্ধে প্রায়শই উঠছে ‘ইতিহাস’-কে বিকৃত করার অভিযোগ। তবে তলিয়ে দেখলে আমরা বুঝব— বর্তমান শাসকগোষ্ঠী তাদের মনোমতো ইতিহাস-ভাষ্য নির্মাণে বিদ্যায়তনিক পাঠ্যপুস্তকের উপর যতটা না নির্ভর করছে, তার চেয়ে অনেক বেশি তার নজর সামাজিক স্মৃতির জগৎটিকে প্রভাবিত করতে। ‘সামাজিক স্মৃতি’ সম্পর্কে শুরুতে বলেছিলাম, এই স্মৃতি স্বতঃস্ফূর্ত প্রক্রিয়ায় স্মৃতির ভান্ডারে জমা হয়। গভীর ভাবে পর্যালোচনা করলে অবশ্য দেখা যাবে, এক ধরনের ‘রাজনীতি’ সামাজিক স্মৃতির জগৎটিকেও নিয়ন্ত্রণ করে। ক্ষমতাবান বা আধিপত্যকারী শ্রেণি বা গোষ্ঠী নানা মাধ্যম ব্যবহার করে তার স্বার্থোপযোগী স্মৃতিগুলিকে উস্কে দেয়। সেখানে চলে ‘নির্বাচিত স্মরণ’ ও ‘বিস্মরণ’-এর খেলা। যে-স্মৃতিগুলি ক্ষমতাবানের কাঙ্ক্ষিত ভাষ্যটিকে ছত্রখান করে দিতে পারে, সেই স্মৃতিগুলিকে বিস্মরণের গহ্বরে পাঠিয়ে দেওয়াটাই এখানে দস্তুর।

সেই লক্ষ্যে চলে ক্ষমতাবানের পরিকল্পিত প্রচার— নানা আঙ্গিকে ও নানা ছদ্মবেশে। এ ধরনের ‘ইতিহাস’-এ ‘সত্য’-এর নির্ধারক তথ্যপ্রমাণ ও নির্মোহ সাক্ষ্যবিচার নয়, বক্তব্যের ‘রিপিটেশন’— বারংবার পুনরুক্তি। সচেতন বিশ্লেষণী বিচার ছাড়াই গণমন অজানতেই ভাষ্যগুলিকে ‘সত্য’ বলে বিশ্বাস করে নিতে থাকে (এই অর্থেই সামাজিক স্মৃতির ‘স্বতঃস্ফূর্ততার’ কথাটি ব্যবহার)।

‘সমাজমাধ্যম’-এর ইতিহাস-বিতর্কে আমরা এই ঘটনাটিই লক্ষ করছি। সুকৌশলে ইতিমধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে এই কথা যে, ইতিহাসবিদরা এত দিন ‘সত্য ইতিহাস ইচ্ছাকৃত ভাবে লুকিয়ে রেখেছিল’। সামাজিক স্মৃতিকেই ‘যথার্থ ইতিহাস’ বলে মান্যতা দেওয়ার এ এক কূটকৌশলই বটে। পেশাদারি ইতিহাসবিদেরা যদি ‘ভণ্ড’ বলে চিহ্নিত হন, তা হলে যে-কোনও কারও ‘ইতিহাসবিদ’ হয়ে উঠতে আর অসুবিধা হয় না।

ইতিহাস বিভাগ, জিজিডিসি গোপীবল্লভপুর ২।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Society Historian

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy