তখনও স্কুলে ‘পরীক্ষা’ দিতে শুরু করিনি। গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভোঁদড় বাহাদুর পড়তে গিয়ে এক জায়গায় থমকে গেলাম। এক পাল রাজহাঁস বুক ফুলিয়ে ঘাড় নেড়ে নেড়ে যাচ্ছে কোথাও, আর তাদের কাছে এক কাহন সোনা ধার চাইতেই প্যাঁক প্যাঁক করে বলে উঠছে— ‘আমাদের এখন বিরক্ত কর না, আমরা পরীক্ষা দিতে যাচ্ছি।’
এটা পড়ে আমি নিজের মতো করে কিছু জিনিস বুঝে নিয়েছিলাম। প্রথমত, পরীক্ষা সাংঘাতিক ব্যাপার, সে সময়ে কাউকে সামান্য কোনও কথা জিজ্ঞেস করলেও তা বিরক্তির উদ্রেক করতে পারে। দ্বিতীয়ত, কেমন একটা ধারণা মনে গেঁথে যায় যে পরীক্ষার্থীকে হতে হবে রাজহাঁসের মতো। বিষয়টা পরে আরও খোলসা করছি। তবে, ‘পরীক্ষা’ সম্পর্কে এটাই কিন্তু আমার প্রথম মনোভাব। কেটেছে অনেকগুলো বছর। তিনটে-চারটে পাশ করেছি বটে, তাও ধারণাটা বদলায়নি একটুও।
পরীক্ষা-ফোবিয়া সকলেরই থাকে কমবেশি, আমার হয়তো একটু বেশিই আছে। তাই পরীক্ষা দেওয়াটা আমার কাছে সবচেয়ে কঠিন, কিন্তু টিকে থাকতে অবশ্যকরণীয় কাজ তো বটেই। দুনিয়ায় প্রতিটা পদক্ষেপেই তো পরীক্ষা। বাদশা থেকে কেরানি সবাইকেই জীবনের সর্বক্ষেত্রে দিতে হয় কোনও না কোনও পরীক্ষা। কখনও কিছু পেতে, কখনও নিছকই টিকে থাকতে। এ গ্রহের ইতিহাসের আদিপর্ব থেকেই যোগ্যতমের উদ্বর্তনের মন্ত্রে দীক্ষিত সবাই। নিজেকে যোগ্যতম প্রমাণ করার এই লড়াইটাই তো পরীক্ষা। তাতে জয়ের ঔজ্জ্বল্য, প্রাপ্তির তৃপ্তি, পথ চলার আনন্দ ও ক্লান্তি, হার মানার হতাশা, ব্যর্থতার গ্লানি— থাকে সবই। কিন্তু পরীক্ষাভীতিটা থাকে অগোচরে। তাই সেই পরীক্ষা দিতে পিছপা হয় না কেউই। জীবনের স্বার্থে জীবনই সেই পরীক্ষা নিয়ে নেয়। তা ছাড়াও, এই সব পরীক্ষার ফল অনেকটাই থেকে যায় অজানা। জীবন তো একটি বারের অভিজ্ঞতা মাত্র। তাই জীবনের কোন বাঁকে কী করলে আরও ভাল হত, কে যোগ্য আর কে-ই বা অযোগ্য, তা খণ্ডকালের ছোট ছোট পিঞ্জরে আবদ্ধ থেকে আমরা জানতে পারি না। কে জানে, মহাকালের বিচারে আমরা সকলেই ফেল করে বসে আছি কি না! কিংবা নিজের অবস্থানে থেকে আমরা প্রত্যেকেই হয়তো পাশ করি।
কিন্তু, আমরা, যারা প্রচলিত অর্থে পরীক্ষার্থী, তারা হয়তো ভাবিই না এত কিছু। ভাবার অবকাশই বা আমরা পাই কোথায়! আমরা তাই রাজহাঁসের মতো জল-মেশানো দুধের থেকে আসলটুকু চিনে নিই চট করে, সময় বুঝে ঝেড়েও ফেলি ডানা ও পালকের জল। হাঁসের মতো ‘ডানা-ভরা কলম’ নিয়ে ওড়ার কথা ভাবি না বড় একটা। আমরা জেনেছি, অর্জুনের মতো ‘সফল’ ছাত্ররা দেখে শুধু পাখির চোখটাকে, তাতে পৃথিবীর স্বরূপ চেনা যাক আর না যাক, তাতে লক্ষ্যভেদ করা যায়— আর তাতেই খুশি হন গুরু দ্রোণাচার্যরা। আমরা তাই নস্যাৎ করি গোটা পাখির অস্তিত্বকে, উপেক্ষা করতে বাধ্য হই জল-স্থল-আকাশের ঐকতান সঙ্গতকে— লক্ষ্যভেদই যে আমাদের লক্ষ্য। এটাই আমাদের পরীক্ষা। কিন্তু সেটাই তো জীবন নয়!
মাঝে মাঝে মনে হয়, আমি বুঝি পরীক্ষার্থী হিসাবে উপযুক্ত নই। আমি যে ‘অর্জুন’ হতে চাই না। লক্ষ্যে সমগ্র দৃষ্টি ও মনোযোগ স্থির রেখে বাঁচা আমার জন্য নয়। সুবোধ পরীক্ষার্থীর সবটুকু ক্ষমতা, মনোযোগ, সময়, চেষ্টা— সর্বোপরি ইচ্ছা— ঘুরপাক খায় জেতা, ভাল ভাবে জেতা, আরও ভাল ভাবে জেতাকে ঘিরে। এতেই মেলে সাফল্য, খুশি হন অভিভাবক ও শিক্ষক, জয়মাল্য দেয় পরিপার্শ্ব। তথাকথিত উন্নতি আসে সেই পথেই। এর মাঝে যুগান্তরের ঘূর্ণিপাককে বোঝা বড় শক্ত। তাই যারা অবোধ, ফলের আশা না রেখে অযাত্রাতে নৌকা ভাসিয়ে অলক্ষ্মীকে পেতেই তাদের আগ্রহ বেশি।
পরীক্ষা নিয়ে সমাজের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চললেও, সভ্যতার অগ্রগতির জন্য পরীক্ষা নিশ্চয়ই অবশ্যম্ভাবী। তবে তা কেমন হওয়া উচিত? নিশ্চিত ভাবে কিছু বলা মুশকিল বইকি। আমরা শুধু এটুকু চাইতে পারি, যাতে তৃতীয় পাণ্ডবের মতো শুধু পাখির চোখেই আটকে না থাকে পরীক্ষার্থী। অর্জুন যদি আর একটু বেশি দেখতে পেতেন, তবে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে সব হারিয়ে জয়লাভের পরেও তাঁর জন্য কী অবশিষ্ট থাকতে পারে, আদৌ তাকে জয় বলে কি না— তার আঁচ পেতেন।
এই প্রসঙ্গে আর এক অর্জুনের কথা মনে এল। ইউভাল নোয়া হারারি-র ‘স্যাপিয়েন্স’ সিরিজ়ের দ্য পিলার্স অব সিভিলাইজ়েশন বইতে তুলে ধরা হয়েছে ‘হেরে-যাওয়া সাফল্য’কে। হারারি যাকে বলছেন ‘লাক্সারি ট্র্যাপ’। সদ্য কলেজ পাশ করা অর্জুন চাকরি পেল মস্ত এক সংস্থায়। ঠিক করল দশ-পনেরো বছর পর ছেড়ে দেবে চাকরিটা। তত দিনে যা সঞ্চয় হবে, তাতে সে বাকি জীবনটা দিব্যি কাটিয়ে দিতে পারবে হেসেখেলে, সেতার শিখে, এবং প্রতি মাসে প্যারাডাইস আইল্যান্ড-এ প্যারাগ্লাইডিং-এ গিয়ে। কিন্তু পনেরো বছর পর দেখা গেল স্ত্রী, তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে তার ভরা সংসার। সন্তানদের পড়ার খরচ, দুটো গাড়ির জন্য লোন, উৎকৃষ্ট মদ এবং বিদেশে ছুটি কাটানো ব্যতিরেকে তার কাছে জীবন অর্থহীন— এই তার অবস্থান। চাকরি ছেড়ে সেতার বাজানোর প্রশ্নই আর ওঠে না। এই সব অর্জুনরা আসলে জীবনের স্রোত কোন দিকে যাচ্ছে, দেখতেই পায়নি। বেচারা অর্জুনরা! আমরা তাই এমন পরীক্ষা চাই, যা শুধু জীবনযাত্রার মানের নয়, বিকাশ ঘটাবে জীবনবোধেরও।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)