কোভিড অতিমারিতে দেশ জুড়ে যখন লকডাউন চলছে, তখন কেন্দ্রীয় সরকার সংসদকে এড়িয়ে, কেবল মন্ত্রিসভার অনুমোদন নিয়ে জাতীয় শিক্ষানীতি (এনইপি ২০২০), গ্রহণ করেছিল। বিভিন্ন মতাদর্শের শিক্ষাবিদ, শিক্ষক, ছাত্রছাত্রী বা তাঁদের সংগঠনগুলির মতামত নেওয়া তো দূরের কথা, রাজ্য সরকারগুলির সঙ্গেও আলোচনা করেননি নীতিপ্রণেতারা। অথচ, শিক্ষা যুগ্ম তালিকার অন্তর্ভুক্ত বিষয়। এখন রাজ্যগুলির উপরে এই নীতি চাপিয়ে দিতে কেন্দ্র তৎপর। সুপ্রিম কোর্ট অবশ্য সম্প্রতি একটি মামলার রায়ে স্পষ্ট করেছে যে, জাতীয় শিক্ষানীতি কোনও রাজ্যকে মানতে বাধ্য করা যাবে না।
জাতীয় শিক্ষানীতির নানা দিক নিয়ে সমালোচনা হয়েছে। কিন্তু তার বিকল্প কী হওয়া উচিত, তা এত দিনে জনসমক্ষে উপস্থাপিত হল। ২২ মে ‘সারা ভারত সেভ এডুকেশন কমিটি’ দিল্লি, কলকাতা-সহ দেশের ১৯টি শহরে একই দিনে প্রকাশ করল জনসাধারণের শিক্ষানীতি (পিইপি ২০২৫)। এই বিকল্প নীতিটি মনোযোগ দাবি করে।
জাতীয় শিক্ষানীতি শিক্ষার জন্য দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের (জিডিপি) ৬ শতাংশ বরাদ্দ করার সুপারিশ করেছে। কিন্তু, নীতিটি চালু হওয়ার পর থেকে এখনও অবধি শিক্ষায় তার অর্ধেকও বরাদ্দ করেনি কেন্দ্রীয় বাজেট— বরং মূল্যস্ফীতি ধরলে বাস্তব বৃদ্ধির হার কমেছে। অনেকেই মনে করছেন, শিক্ষায় বেসরকারি বিনিয়োগের গুরুত্বকে তুলে ধরে এনইপি তার পথ প্রসারিত করে দিয়েছে। পিইপি মনে করে, সর্বজনীন শিক্ষার স্বপ্ন পূরণ করতে হলে কেন্দ্রীয় বাজেটের কমপক্ষে ১০ শতাংশ, এবং জিডিপি-র ন্যূনতম ৬ শতাংশ শিক্ষার জন্য বরাদ্দ করতে হবে। কয়েকটি জাতীয় শিক্ষা কমিশনেরও এই সুপারিশ ছিল। দ্বিতীয় প্রসঙ্গ শিক্ষার তালিকাভুক্তি। শিক্ষা আগে রাজ্য তালিকাভুক্ত ছিল, কিন্তু জরুরি অবস্থায় ৪২তম সংবিধান সংশোধনী (১৯৭৬)-তে শিক্ষাকে যুগ্ম তালিকাভুক্ত করা হয়েছিল। বর্তমান সরকার কার্যত শিক্ষাকে কেন্দ্রীয় তালিকাভুক্ত বিষয় হিসাবে বিবেচনা করে, শিক্ষায় সম্পূর্ণ দিল্লির দখলদারির ব্যবস্থা করেছে। পিইপি প্রস্তাব দিয়েছে, শিক্ষাকে ফের রাজ্য তালিকার বিষয় করতে হবে। সেই উদ্দেশ্যে সংবিধান পুনরায় সংশোধন করতে হবে।
তৃতীয় বিষয়টি প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষা। এনইপি তিন বছরের প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করেছে। অথচ স্কুলে প্রাক্-প্রাথমিক ক্লাসের ব্যবস্থা রয়েছে সামান্যই। প্রাক্-প্রাথমিক ক্লাস চলে প্রধানত অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে, যাকে ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান’ বলা কঠিন। ফলে উচ্চ-বেতনের বেসরকারি ‘নার্সারি’ বা ‘মন্টেসরি’ তকমাধারী স্কুলের রমরমা বাড়ছে। পিইপি দু’বছরের ঐচ্ছিক প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষার সুপারিশ করেছে। তবে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র নয়, পড়াতে হবে সরকারি স্কুলে। প্রথাগত শিক্ষা শুরু হবে প্রথম শ্রেণি থেকেই। ২০০৯ সালের শিক্ষার অধিকার আইনে ৬-১৪ বছর পর্যন্ত বিনামূল্যে বাধ্যতামূলক শিক্ষার ব্যবস্থা ছিল। পিইপি ওই আইন বাতিল করে ৩-১৭ বছর বয়সিদের জন্য বিনামূল্যে শিক্ষা নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছে।
শিক্ষার পর্যায়-বিভাজনে যে পরিবর্তন এনেছে এনইপি, তারও বিরোধিতা করেছে পিইপি। যেমন, স্কুলস্তরে সিমেস্টার-প্রথা অবৈজ্ঞানিক, কারণ তা পড়ুয়াদের মধ্যে জ্ঞানের গভীরতা সৃষ্টির প্রতিবন্ধক। বাৎসরিক পরীক্ষাই উপযুক্ত। সর্বোপরি, পিইপি মনে করিয়েছে যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষকের স্বাধিকারই মুক্ত জ্ঞানচর্চার অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে। এনইপি-তে শিক্ষার আমলাতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণের বীজ লুকিয়ে আছে। দেশের সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশিকা পরীক্ষা একটি কেন্দ্রীয় সংস্থা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে কেন? ‘ন্যাশনাল রিসার্চ ফাউন্ডেশন’ নামে একটি সংস্থা তৈরি করা হয়েছে গবেষণার বিষয়বস্তু, আর্থিক অনুদানের জন্য। তার মাথায় প্রধানমন্ত্রীকে বসানো হয়েছে। উদ্দেশ্য স্পষ্ট— গবেষণাকে নিয়ন্ত্রণ করা। শিক্ষায় যে কোনও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করেছে পিইপি, এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্বাধিকারকে সমর্থন করেছে।
এনইপি শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ, সাম্প্রদায়িকীকরণ ও কেন্দ্রীকরণের নীল নকশা। এই শিক্ষানীতিতে ‘ভারতীয় জ্ঞান ব্যবস্থা’র সঙ্গে একটি নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে, তা হল শিক্ষার গৈরিকীকরণ। জ্ঞানের আবার ভারতীয়ত্ব কী? তার কোনও জাতীয় সীমানা থাকে নাকি? আসলে বিজেপি, আরএসএস ও সঙ্ঘ পরিবার জ্ঞান-বিজ্ঞান সমেত ইতিহাসকে যেমন দৃষ্টিতে দেখে, ভারতীয় ঐতিহ্যের নামে তেমন ভাবেই পাঠ্যপুস্তক রচনা করছে। সমাজে এমন পরিবেশ সৃষ্টি হলে মানুষ গড়ে ওঠার প্রক্রিয়া ব্যাহত হবে। এনইপি-র বিপদ এখানেই। কিন্তু আরও বিপদ হল সমস্ত বিরোধী রাজ্য সরকার, তাদের ঝান্ডার রং যা-ই হোক না কেন, এই শিক্ষানীতিই কার্যকর করছে। এ রাজ্যও ব্যতিক্রম নয়। তাদের কাছে পিইপি-কে বিকল্প বলে তুলে ধরতে হবে।
সর্বোপরি, পিইপি-প্রণেতারা নীতির নির্মাণে সকলের অংশীদারিতে বিশ্বাসী। এই নীতির খসড়ার উপর ছয় মাস ধরে দেশের বিভিন্ন অংশের মানুষের মত সংগ্রহ করা হবে। জানুয়ারিতে ‘পিপলস পার্লামেন্ট’-এর মাধ্যমে তা চূড়ান্ত রূপ পাবে। কেন্দ্র ও রাজ্যগুলির কাছে প্রস্তাব রাখা হবে, যেন এই নীতি কার্যকর করা হয়।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)