Advertisement
E-Paper

বাণিজ্য-যুদ্ধে ক্ষতি, কে বলল

রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ বা পারস্পরিক শুল্ক নীতির কথা ট্রাম্প তাঁর নির্বাচনী প্রচারেও উল্লেখ করেছিলেন। তাই এটা অভাবিত নয়। অযৌক্তিকও নয়।

বিশ্বজিৎ মণ্ডল

শেষ আপডেট: ০৪ মার্চ ২০২৫ ০৬:০৪
Share
Save

শঠে শাঠ্যং’-এর ধারণাটি অর্থবিদ্যার পরিসরে বহুলব্যবহৃত। অর্থাৎ, ইট ছুড়লে পাটকেলটি খেতে হবে। অস্বীকার করার উপায় নেই যে, এটাই যুক্তিবাদী মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। এই কৌশলের বাস্তবিক প্রয়োগ ঘটাচ্ছেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প— যে দেশে আমেরিকা থেকে আমদানি হওয়া পণ্যের উপরে শুল্ক যেমন, তিনি সেই দেশ থেকে আমেরিকায় রফতানি হওয়া পণ্যের উপরেও তেমনই শুল্ক বসানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এই রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ বা পারস্পরিক শুল্ক নীতির কথা ট্রাম্প তাঁর নির্বাচনী প্রচারেও উল্লেখ করেছিলেন। তাই এটা অভাবিত নয়। অযৌক্তিকও নয়। তা হলে সমস্যা কোথায়? সবাই কেন চিন্তিত?

বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা, এবং ধনতান্ত্রিক বিশ্বের প্রধান দেশগুলি বরাবরই মনে করে যে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের পরিসর যত মুক্ত হবে, তত মঙ্গল হবে গোটা বিশ্বের। কারণ, অদক্ষ উৎপাদনের বাধ্যবাধকতা থেকে দক্ষতার সরণিতে যাওয়ার একমাত্র রাস্তা বাণিজ্য সম্প্রসারণ। তা সত্ত্বেও বিভিন্ন দেশ নানা সময়ে নানা ধরনের কৌশলী বাণিজ্যনীতি প্রয়োগ করেছে সাময়িক লাভের আশায়। কেউ আমদানি শুল্ক বাড়িয়েছে, কেউ তৈরি করেছে শুল্ক-বহির্ভূত অন্যান্য বাধানিষেধ, কেউ আবার উল্টো পথে হেঁটে ডাম্পিং-এর নীতি নিয়েছে। ‘ডাম্পিং’-এর অর্থ অন্য কোনও দেশে খুব কম দামে কোনও বিশেষ পণ্য বা পরিষেবা রফতানি করা— যাতে সেই দেশের উৎপাদক প্রতিষ্ঠানের প্রভূত ক্ষতি হয়, এবং তারা শেষে পাততাড়ি গোটায়। এই সমস্যা থেকে বাঁচার জন্য সম্ভাব্য ক্ষতিগ্রস্ত দেশ পাল্টা ডাম্পিং-এর নীতি গ্রহণ করে। অর্থাৎ, তুমি যদি আমার দেশীয় অর্থব্যবস্থা ভেঙে দিতে চাও, তা হলে আমিও তোমার উৎপাদন ও কর্মসংস্থানের শেষ দেখে ছাড়ব!

কোনও দেশ যদি আমেরিকা থেকে আমদানিকৃত পণ্য বা পরিষেবার উপরে শুল্ক আরোপ করে, সে ক্ষেত্রে ট্রাম্পের ঘোষিত নীতি হল, আমেরিকাও সেই দেশের রফতানির উপরে সমপরিমাণ শুল্ক ধার্য করবে। এতে উভয় দেশের বাণিজ্য ও উৎপাদন একই ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। পর্যাপ্ত বাজারের অভাবে উৎপাদিত দ্রব্য দেশের মধ্যে পড়ে থেকে সম্পূর্ণ ভাবে নষ্ট না হলেও গুদামজাত করার ফলে উৎপাদকরা যথেষ্ট ক্ষতির সম্মুখীন হবেন। এবং ক্রমে উৎপাদন ও কর্মসংস্থান হ্রাস পাওয়ার দরুন অর্থনৈতিক বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হওয়া শুধু সময়ের অপেক্ষা। তুলনায় অদক্ষ উৎপাদন ক্ষেত্রের দিকে ধাবিত হবে শ্রম ও মূলধন। ফলত, ক্ষতি হবে দু’দিক থেকে— এক, উৎপাদন ধাক্কা খাওয়ার দরুন বাড়বে শ্রম ও পুঁজির কর্মহীনতা, যার কুপ্রভাব সুদূরপ্রসারী; দুই, দেশের সামগ্রিক দক্ষতার মাত্রা কমার ফলে অসম্ভব হয়ে উঠবে শ্রম ও পুঁজির সঠিক মূল্যায়ন। সব মিলিয়ে ভুবন জোড়া আর্থিক কল্যাণের মাত্রা আরও নিম্নমুখী হবে।

তা-ই যদি হয়, তবে তো বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার মূল উদ্দেশ্য একেবারে সমূল উৎপাটিত হওয়ার পথে। ব্যাপারটা কি সত্যিই তাই? একদমই নয়। তা হলে? আসল কথা হল ভীতি বা হুমকির কৌশল। আমেরিকার মতো দেশের কাছ থেকে এ ধরনের হুমকি আসার মূল অর্থ হল রফতানিযোগ্য দ্রব্যের জন্য অত বড় বাজার হাতছাড়া হওয়া। তাতে প্রভূত ক্ষতির সম্ভাবনা। সেই আশঙ্কাতে সবাই হয়তো এটা ভাববে যে, এর চেয়ে বাণিজ্য শুল্ক কমানোটাই শ্রেয়। এতে পারস্পরিক শুল্ক হ্রাসের সম্ভাবনা সৃষ্টি হতে পারে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থাও তো ঠিক এটাই চায়। এটাই তো বিশ্বায়নের মূল মন্ত্র।

আজকের এই বিশ্বায়িত ভ্যালু চেন বা মূল্যশৃঙ্খলের যুগে কোনও দেশেরই একেবারে ‘নিজস্ব’ উৎপাদন বলতে কার্যত কিছু নেই— রফতানি বা আমদানি, উভয় ক্ষেত্রেই। বৈশ্বিক মূল্যশৃঙ্খলের বিভিন্ন ধাপে থাকা নানা দেশের মধ্যেকার পারস্পরিক ধাপ থেকে এক জন বেঁকে বসলেই গোটা বিশ্বের উৎপাদন ও ভোগের সমন্বয় বাধাপ্রাপ্ত হবে। সেই অভিঘাত সহ্য করার মতো আর্থ-সামাজিক পরিকাঠামো কোনও দেশেরই নেই। তবে বৈশ্বিক মূল্যশৃঙ্খলে একটা মজার ব্যাপার আছে। প্রত্যেক দেশই উৎপাদনের কোনও একটা স্তরে আমদানি বা রফতানি করে। অর্থাৎ, আমি শুল্ক বসালে তার প্রভাব ঘুরপথে আমার উপরে আসবেই। তা ছাড়া, সমপরিমাণ পাল্টা শুল্কের নীতি যদি সবাই প্রয়োগ করে, তা হলে অবশেষে মূল্যসংযুক্তির পরিমাণ ধরে হিসাব করলে দেখা যাবে যে, কার্যকর শুল্কের সর্বশেষ হার হবে শূন্য। শুল্কের হার শূন্য হওয়া মানে তা উদার বাণিজ্যের চরম সীমা। তা হলে কি বাণিজ্য যুদ্ধ, পারস্পরিক-শুল্ক ইত্যাদি প্রকৃতপক্ষে গোটা বিশ্বকে প্রচ্ছন্ন হুমকির মাধ্যমে পুরোপুরি মুক্ত বাণিজ্যের দিকে নিয়ে যাচ্ছে?

বর্তমানে আমেরিকার সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য উদ্বৃত্তের পরিমাণ প্রায় ৪৫ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ, আমেরিকার সঙ্গে বাণিজ্যে ভারতের রফতানি বেশি, আমদানি কম। শুল্কের হারের তফাতের কারণেই আমাদের এখনও খানিকটা বাণিজ্য উদ্বৃত্ত রয়েছে। পারস্পরিক শুল্ক নীতির ফলে এই উদ্বৃত্ত কিন্তু কমে শূন্যে নেমে যেতে পারে। অন্য দিকে, চিনের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ প্রায় ৮৫ বিলিয়ন ডলার। পুরোপুরি মুক্ত বাণিজ্যের আবহে এঁটে ওঠার মতো দক্ষতা আমরা এখনও অর্জন করে উঠতে পেরেছি কি না, সে সন্দেহ তাই খানিক থেকেই যায়। তবে মুক্ত বাণিজ্য থেকে মুখ লুকিয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করলে সেটা হবে চরম মূর্খামি। বাস চলতেই থাকবে— আপনি না উঠলে অন্য কেউ উঠবে। কয়েক দশক আগে যেমন উঠেছিল হংকং, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান।

অর্থনীতি বিভাগ, সেন্টার ফর স্টাডিজ় ইন সোশ্যাল সায়েন্সেস, কলকাতা

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Trade War Business Tax Duty

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}