এক ছিল রাজা। তার দুই রানি। ‘দুও আর সুও’। সুওরানি ছোটরানি। তাঁর বড় আদর, বড় যত্ন। সাতমহলা বাড়িতে সাতশো দাসী রানির সেবা করে, সাত সিন্দুকে ভরা সাত রাজার ধন মানিকের গহনা রানি অঙ্গে পরেন। দুওরানি বড়রানি। ‘তাঁর বড়ো অনাদর, বড়ো অযত্ন।’ ভাঙা ঘরে, ছেঁড়া কাঁথায় দিন যায়। ছেলেবেলায় গল্প শুনতে অভ্যস্ত কান সহজে বুঝে নেয়, এ হল রূপকথা। চিরচেনা এই কাহিনি অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (ছবি) ক্ষীরের পুতুল থেকে নেওয়া। যে গল্পে অচিন দেশের কোনও এক নীল মানিকের গাছে নীল গুটিপোকা নীলকান্ত মণির পাতা খেয়ে, নীল রেশমের গুটি বাঁধে, আর সেই গুটি থেকে আকাশের সঙ্গে রং মিলিয়ে নীল শাড়ি বুনে নেয় সে দেশেরই রাজার কন্যা। স্পষ্ট বোঝা যায়, ছবি লিখতেন, গল্প বলতেন তিনি। দুইয়ে মিলে আর্টিস্টের লেখা-ছবি আর আঁকা-ছবি ‘আর্ট’ হয়ে উঠত।
লেখার চলনে গল্পের বলন কেমন ভাবে ধরা পড়ে? মৌখিক সাহিত্যে গল্প বলার সুর, সুরের ওঠাপড়া, হাত-পা নেড়ে কথা বলার ভাসা-ভাসা ভাষা থাকে। ভাবের সুর, দোলনার মতো স্বরকে এক বার ঠেলা দেয়, আবার নামিয়ে আনে। সময়ের ঘনত্ব বোঝাতে টেনে টেনে বলা হয়, “দিনের পর দিন যায়/ রাজা আসে না। মাসের পর মাস যায়/ রাজা আসে না।” বাস্তবে অবন ঠাকুর হাতের লম্বা লম্বা আঙুল হাওয়ায় ভাসিয়ে চমৎকার ভঙ্গিতে ছোটদের রামায়ণ-মহাভারত, কঙ্কাবতী, ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমীর গল্প শোনাতেন। দুঃখে কাঁদাতেন, হাসিতে হাসাতেন। বুঝতেন, ছোটরা ছবি দেখে। কথার সে ছবি কতকটা সিনেম্যাটিক, অনেকটা অ্যানিমেটিক। শকুন্তলা-র গদ্যে ভিজে কাদায় পড়ে পড়ে ঠান্ডা হওয়া মোষ তাড়া খাওয়ামাত্র শিং উঁচিয়ে ঘাড় বেঁকিয়ে গহন বনে পালাতে শুরু করে কথার চলমান রূপ দেখায়।
ছোটদের সঙ্গে কথোপকথনের জন্য অবন ঠাকুর প্রশ্ন-উত্তরের ধরন ব্যবহার করতেন। শকুন্তলার গল্পের একটা অংশ: “তারপর কী হল? দুঃখের নিশি প্রভাত হল,... আর কী হল? বনপথে রাজা-বর কুঞ্জে এল। আর কী হল? পৃথিবীর রাজা আর বনের শকুন্তলা— দুজনে মালা-বদল হল।” গদ্যের এই স্টাইল কি রপ্ত করতে হয়েছিল তাঁকে? কতকটা অনায়াসে এসেছিল। ঠাকুরবাড়ির ছাদে গল্পের আসর বসত, গরমের সন্ধেয় পড়া শেষে গল্প শুনত ছোটরা। তবে অবনীন্দ্রনাথ চমৎকার মুখে মুখে গল্প করতে পারতেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর এই বিরল গুণটি চিনেছিলেন, তাঁর উৎসাহ পেয়ে অবনীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন শকুন্তলা, ক্ষীরের পুতুল-এর মতো প্রথম দিকের বইগুলি। পরে বর্ণনাত্মক ভঙ্গিতে রাজকাহিনী, আর আলোর মতো নির্ভার গদ্যে নালক লিখেছিলেন। ছবিকে যেমন বারে বারে ধুয়ে রংকে শক্ত করে বসিয়ে নিতেন, তেমন ভাবে নালক বা পথে বিপথে-তে যেন গদ্যের ওয়াশ পদ্ধতি তাঁর।
কথনরীতিতে ধ্বনির গুরুত্ব। আলোর ফুলকি বইয়ে পশুপাখির কথার মর্ম বুঝে চমৎকার ধ্বনিভাষা লিখেছিলেন। সে ভাষায় শালিকছানারা ‘ব্রীক্ ইঁট, ব্রীজ পুল, স্কুল ইস্কুল’ বলে বলে পড়া মুখস্থ করে। ঘুঘুপাখি আদর করে ‘বুবু ওঠো দেখি ম্ ম্’ বলে বৌকে ঘুম থেকে তোলে। ভূতপত্রীর দেশে লেখার সময় থেকে কথাকে কবিতার সাজ পরাতেন: “হুম্পাহুমা/ পালকি চলেছে/ বনগাঁ পেরিয়ে/ ধপড়ধাঁই...” পরের দিকে ঘরোয়া, আপন কথা, জোড়াসাঁকোর ধারে-র মতো স্মৃতিকথাধর্মী লেখায় কথক অনেকটা ‘ফাংশনাল রোল’ নিয়েছিলেন। তাঁর শিল্পকথার অধিকাংশই ‘লেকচার’ধর্মী।
১৯২০-র পর থেকে এক নতুন রীতিতে মজেছিলেন, লেখার মাধ্যমে নিজের মুখোমুখি বসার মজা নিতে চাইছিলেন। দ্বৈরথের এক দিকে ‘অবু’, অন্য দিকে চাঁইদাদার মতো চরিত্রেরা। পু্ঁথিগুলি সর্বপ্রকারে তাঁর এই প্রবণতা উস্কে দিয়েছে। মারুতির পুঁথি, চাঁইবুড়োর পুঁথি-তে শব্দ বাজানোর, আশ্চর্য খেলা ভাঙার খেলায় মজেছিলেন। এক দিকে ‘বড়দাড়ুলু দাড়ুলু নাইডু, বড়দাড়ুলু চড়লু নাইডু’ শব্দে মাদ্রাজি মেলের চলার গম্ভীর ছন্দ লিখেছেন, অন্য দিকে মন্দোদরীর সঙ্গে মিলিয়ে ঘণ্টোদরী, কণ্ঠোদরী, ভগ্নোদরী বা জাঙ্গুলী, লাঙ্গুলী দলভুলীর মতো এলোমেলো শব্দের জোয়ারে গা ভাসিয়েছেন। কথকতার প্রতিস্পর্ধী করে তুলেছেন কথকতাকে, যে কখনও সিরিয়াস, কখনও নিজেরই হাসির খোরাক!
রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে জীবনের প্রথম পর্বে ছিল লেখা, পরে আঁকা। অবনীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে উল্টো। প্রথমে আঁকা, পরে লেখা। এক সময় ছবি আঁকায় ‘ডিফিকাল্টি ওভারকাম’-এর আনন্দ পাচ্ছিলেন না বলে মন দিয়েছিলেন যাত্রাপালা লেখায়। গদ্য লেখার শৈলীতে প্রথম দিকে ছিলেন এক রকম। ক্ষীরের পুতুল-এ দিব্যচক্ষু প্রসঙ্গে প্রচ্ছন্ন, আর্টিস্টের চোখ ফোটার শিল্পদর্শন। ছড়া-দুনিয়ার ন্যাজঝোলা টিয়ে, গোল-চোখ বোয়ালমাছ, ছেলের পাল, মেয়ের দলে ভরা ষষ্ঠীতলা থেকে দিব্যচক্ষুর ম্যাজিকে পছন্দের খোকাকে চিনিয়ে দেওয়ার মধ্যে ছিল স্বপ্ন ধরার সারকথা। কিন্তু শেষের দিকের গদ্যে তাঁকে খুঁজলে খাপছাড়া বেমানান লাগে: কেন এমন গদ্য লিখছেন যেখানে প্লটের ছিরিছাঁদ নেই, কোলাজের মতো কয়েকটা ঘটনা সাজানো! পুঁথি-পালা-কথকতা কি আলস্যচর্চা হয়ে উঠেছিল শেষে?
অবনীন্দ্রনাথ বলতেন, পুঁথি-পালা তাঁকে গভীর রসের সন্ধান দিয়েছে। আপাত-অযতনের ফসল মনে হলেও এগুলি হল নিজস্ব প্রকরণ, আজীবন যে শিকড়ের খোঁজ তিনি চালিয়ে গেছেন। কল্পনার হিস্টিরিয়া বইতে শঙ্খ ঘোষ দিগ্নির্দেশ দিয়েছেন, পুঁথিগুলি অবনীন্দ্রনাথের অবসরের জগৎ হলেও তার মধ্যে তিনি সমবায়ের আনন্দ পেয়েছিলেন। নিম্নবর্ণের হিন্দু-মুসলমান সংস্কৃতির প্রতি তিনি জিজ্ঞাসু ছিলেন; রূপকথা, কিস্সা সাহিত্য, ইসলামি পুঁথি সংগ্রহ করতেন। খুদ্দুর যাত্রা-র রুল-টানা খাতায় রাম-রাবণের যুদ্ধবর্ণনার পাশে খবরকাগজ থেকে কেটে নাগাবাহিনীর ছবি সেঁটে দিতেন। ছেলেমানুষিতে মিলতে চাইতেন সাধারণের সঙ্গে। আবার অস্বীকার করেননি শিল্পসঙ্কটও, উল্টোপাল্টা শব্দ ব্যবহার করে ভাষা প্রকাশের বিপর্যস্ত আদর্শ রাখতে চেয়েছেন। সেও এক আর্ট!
বাংলা বিভাগ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)