E-Paper

হাজার বছর খেলা করে

এই সেই ঋতু, যাকে হেমন্ত বলে ডাকি। যাকে মুখোপাধ্যায় বিখ্যাত করেছেন সুরে, জীবনানন্দ খুঁজে নিয়েছেন তাঁর আর্ত চেতনার আয়নার মতো করে। যে আয়না ক্ষণস্থায়ী, ভঙ্গুর, অভিমানী, রহস্যময়, পাতা ঝরার প্রতিবিম্ব দেখায়।

অগ্নি রায়

শেষ আপডেট: ২৫ অক্টোবর ২০২৫ ০৫:৩৯

ধুলো ঝেড়ে মাঠে ব্যাট-উইকেট নামানোর দিন এসে গেল। ধানী-রং ঘাঘরি আর মেঘরং ওড়না পরার বেলা শেষ আকাশের। কিন্তু চলে যাওয়ার পরেও ঋতু তো কিছু দিন অবধি তারবাসনাবিলাসের দাগ রেখে যায়। একটা সময়ের পর তার স্থায়ী বিসর্জনের বেলা আসে। বর্ষা ও শীতের মাঝের সেই নাতিদীর্ঘ সাঁকোটি মুড়ে যেতে থাকে পলকা কুয়াশায়। প্রোমোটারতন্ত্রের পূর্ববর্তী পাড়ার মাঠ ঘাট বাদাড়ে হিম পড়ে।

এই সেই ঋতু, যাকে হেমন্ত বলে ডাকি। যাকে মুখোপাধ্যায় বিখ্যাত করেছেন সুরে, জীবনানন্দ খুঁজে নিয়েছেন তাঁর আর্ত চেতনার আয়নার মতো করে। যে আয়না ক্ষণস্থায়ী, ভঙ্গুর, অভিমানী, রহস্যময়, পাতা ঝরার প্রতিবিম্ব দেখায়। আর কোন ঋতুর সঙ্গেই বা এমন সরাসরি বিরহযোগ? বসন্ত দেয় অবিমিশ্র প্রেম আর রং, ফোটায় দেহজ কুসুম। শীতকে পায় পিকনিকের টায়ারে উড়ে যাওয়া ধুলো, ক্রিকেটের কারুসাজ, মাফলারে ঢেকে রাখা আতুর টনসিলের মতো ভালবাসা। শরতে নীল ঘুড়ির মতো উড়তে থাকা আকাশে উৎসব মানায় ভাল। বর্ষার ছাঁট ফিরিয়ে দেয় বাল্যকালের ফুটবল মাঠ, প্রথম প্রেম আর রবিঠাকুরের গান। গ্রীষ্মের রুদ্ররূপে, যন্ত্রণার সঙ্গে মিলে থাকে বৈশাখী ঝড়ের বেড়া ভাঙার ছন্দ।

তুলনায় এই কার্তিক মাসের বিষণ্ণতা— কেবলই ছেড়ে যাওয়ার কথা বলে। মনে হয়, পশ্চিম যে ভাবে অভিনন্দিত করেছে ‘অটাম’ আর ‘লেট-অটাম’ সোনাটা-কে, বাংলা কবিতায় হেমন্ত সে ভাবে বন্দিত কি? সে হোক বা না হোক, বাংলার ক্যালেন্ডারে শরৎ ও শীতের মাঝে অনিবার্য ভাবেই জীবনানন্দ রয়ে গিয়েছেন। তা শুধু এই কারণেই নয় যে কার্তিক তাঁর মৃত্যুমাস। তার কারণ, কার্তিক অবং অগ্রহায়ণ রচনা করেছে তাঁর কবিজন্মকে সবচেয়ে বিশ্বস্ত ভাবে। বসন্ত, বর্ষায় রবীন্দ্রনাথের তোলপাড়, এমনকি দক্ষিণ এশিয়ার রৌদ্রের তাণ্ডবকে তিনি মৌনী তাপসের রূপ দিয়েছেন অজস্র গানে।

কিন্তু হেমন্তে থেমে গিয়েছেন অঙ্গুলিমেয় কিছু গান রচনা করেই। কেন? তাঁর উত্তর নিহিত রয়েছে সম্ভবত ওই গুটিকয়েক গানের একটির চরণে— ‘সে দিন আমায় বলেছিলে আমার সময় হয় নাই—/ ফিরে ফিরে চলে গেলে তাই/... আজি এল হেমন্তের দিন/ কুহেলীবিলীন, ভূষণবিহীন...।’ এ কুহেলি-মাখা আড়ম্বরের বসনহীন এক ঘন চক্কর, যা ফিরে-যাওয়া, ছেড়ে-যাওয়াদের মনে করিয়ে দিতে থাকে ক্ষণে ক্ষণে। হিমের রাতে আকাশের দীপগুলিকে যে হেমন্ত আঁচল দিয়ে আড়াল করে দিতে পারে, তার নাগাল পাওয়া বড় সহজ নয়।

অথচ এই পাতা ঝরার অটাম সোনাটা-কে হর্ষের সঙ্গে বরণ করেছেন পশ্চিমের কবিরা, কারণ সেখানে হেমন্ত মনোহর, তার পর শীত নিষ্ঠুরতম ঋতু। জন কিটস-এর চোখে হেমন্ত ‘সিজ়ন অব মিস্টস অ্যান্ড মেলো ফ্রুটফুলনেস’, শেক্সপিয়রের সনেটে হলুদ পাতা ঝরার জয়গান। ওয়েলস-এর কবি গিলিয়ান ক্লার্ক-এর কথায়, ‘হোয়েন দেয়ার টাইম কামস দে ফল/ উইদাউট উইন্ড, উইদাউট রেন,/ দে স্লিপ থ্রু দ্য ট্রি’জ় মসলিন/ ইন আ স্লো ফার্মেন্টেশন।’

তবুও বাংলার মানুষের জীবনেও হেমন্ত মানে শুধুই তো, ‘কণ্ঠে তোমার বাণী যেন করুণ বাষ্পে মাখা’ নয়। সুখ-দুঃখ মেশানো কবিতার মতো বয়ে চলেছে তা আবহমান। হেমন্তের শুরু অনটনের হলেও শেষের দিকে তা সমৃদ্ধির বাতাসই তো বয়ে আনে। সুদূরকাল থেকেই হেমন্ত আসা মানে, ‘আয় রে সবে কাস্তে হাতে আয় রে কাটি ধান’। ধান কাটা, ধান মাড়াই ও ধান ভানার উৎসব। কবি নরেশ গুহ লেখেন, “জীবনানন্দের কবিতা পড়তে পড়তে অজান্তে কখন আমরা সেই রূপসী হেমন্তের প্রেমে পড়ে যাই। ভেবে অবাক লাগে, কৃষির সোনার কৌটোতে আমাদের প্রাণের ভ্রমরটি যদিও ভরে রাখা আছে তাহলেও ফলন্ত ধানের ঋতু হেমন্তের গাথা বাংলা কবিতায় একরকম ব্যতিক্রম বললেই চলে। শুধু কি দৃশ্যের? গন্ধের, শস্যের, আলস্য-পূর্ণতা-বিষাদের করুণতামাখা লাবণ্যময়ী ঋতু হেমন্ত। হেমন্তের গভীর গম্ভীর রূপ কীটস-এরও প্রাণ ভুলিয়েছিল। শেষ পর্বে জীবনানন্দের কাব্যে যখন জন্মান্তর ঘটেছে, হেমন্ত তখনো তাঁর উপকরণ হয়েছিল, তার ব্যবহার যদিও তখন ভিন্ন। হেমন্ত প্রথমত শস্যের, তৃপ্তির, বিরতির ঋতু।”

হিমঋতু হেমন্তকে সবচেয়ে বেশি গৌরবান্বিত করেছেন জীবনানন্দই। কবি হেমন্তকে দেখেছেন কামে-প্রেমে, বিয়োগে, অবসানে এবং ফসলে। “প্রথম ফসল গেছে ঘরে/ হেমন্তের মাঠে-মাঠে ঝরে/ শুধু শিশিরের জল;/ অঘ্রানের নদীটির শ্বাসে/ হিম হ’য়ে আসে/ বাঁশপাতা-মরা ঘাস-আকাশের তারা;/ বরফের মতো চাঁদ ঢালিছে ফোয়ারা;/ ধানক্ষেতে-মাঠে/ জমিছে ধোঁয়াটে/ধারালো কুয়াশা...।”

হেমন্তের মধ্যে এক অনন্ত মায়াজল ঝরে যেতে দেখেছেন এই কবি, যাঁকে আমরা দেখি হিমের পতন হিসাবে। আর তাঁর সেই দেখায় পূর্ণতার সঙ্গে বিসর্জন যেন জায়গা বদলাবদলি করে নেয়, যখন তিনি উচ্চারণ করেন, “হেমন্ত ফুরায়ে গেছে পৃথিবীর ভাঁড়ারের থেকে;/ এ-রকম অনেক হেমন্ত ফুরায়েছে/ সময়ের কুয়াশায়;/ মাঠের ফসলগুলো বার-বার ঘরে/ তোলা হ’তে গিয়ে তবু সমুদ্রের পারের বন্দরে/ পরিচ্ছন্নভাবে চ’লে গেছে।”

জীবনানন্দ যে জিন-গত সূত্রেই ছিলেন হেমন্ত-আচ্ছন্ন, তার পরিচয় আমরা পেয়েছি তাঁর বোন সুচরিতা দাশের কথায়। বিক্রমপুরের গাউপাড়া গ্রামের বর্ধিষ্ণু পরিবারের মুনশিবাড়ির এক ব্যক্তিকে বলা হত পরি-পাওয়া লোক। হেমন্তে তাঁকে ভোরবেলা দেখা যেত শিশির-ঝলমল ধানখেতের পাশের ঘাসে, দিব্যি আরামে শুয়ে আছেন। ঠোঁটের কোণে এক অদ্ভুত হাসি আধফোটা হয়ে ঝুলে রয়েছে। যেন তিনি কিছু দেখে ফেলেছেন, যা অজ্ঞেয়, যা তিনি বলে কাউকে বলে বুঝিয়ে উঠতে পারেননি রাতে। নিজেই তাই মজে রয়েছেন। তাঁর সেই ঘাসবিছানায় ছড়ানো থাকত কাঁচা লবঙ্গ, এলাচ-দারুচিনি।

সে এক অলৌকিক নির্জন স্বর্গ থেকে তিনি জেগে উঠতেন, আচমকা অতর্কিত অট্টহাস্য করে উঠতেন কখনও! তাঁর সেই হাসির মর্ম কেউ বুঝতে পারত না, আড়ালে ফিসফিস করে আলোচনা চলত। মুনশিবাড়ির দাশগুপ্ত পরিবারের সর্বানন্দ দাশগুপ্ত কার্যোপলক্ষে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে চলে এলেন বরিশাল। অনেক পরে যাঁর বড় নাতির দৌলতে ধানসিড়ি নদীর দেশ বলে যে বরিশালকে চিনবে বাংলা কবিতার পাঠক।

জীবনানন্দের বোন সুচরিতা দাশের জবানিতে রয়েছে, “সেই শিশির ঝরা ধানের গন্ধে ভরা হেমন্তের রাতে, গাছের পাতারা যখন হলুদ হয়ে এসেছে, জোনাকির আলোয় দূরের মাঠ বন যখন ঝিলমিল, তখন নতুন করে সেই পুরনো গল্পের পাণ্ডুলিপির আয়োজন চলছে আজ। আজ আর আমাদের পূর্বপুরুষেরা সেই গল্পের নায়ক নন, তাঁরা জোছনা মোছা রাতে শিশিরে ধানের দুধে ভিজে ভিজে হাওয়ায় শরীরে স্বপ্নময় পরীদের বস্তুগত, আজ যিনি... পৃথিবীর ভালবাসায় চিরতরে যতি টেনে স্বপ্নের পরীদের হাতে নিঃশেষে তুলে দিলেন নিজেকে, তাঁর শয্যায় কাঁচা লবঙ্গ, এলাচ, দারুচিনি থাকবে না ছড়ানো, থাকবে তাঁর কাব্যে দূরতর সায়াহ্নের সমীপবর্তী সবুজার্দ্র দ্বীপের দারুচিনি লবঙ্গ এলাচের রহস্যময় ধূসর ইশারা।”

এমনই এক কার্তিক মাসে জীবনানন্দের শ্মশানযাত্রীদের মধ্যে এক জন, কবি অরবিন্দ গুহ লিখেছিলেন, শ্মশানে যাওয়ার পথেই নাকি পড়েছিল সেই জায়গাটি, যেখানে দুর্ঘটনা ঘটেছিল। ট্রামলাইনের সেই জায়গা জুড়ে ঘাস— শাণ বাঁধানো কলকাতায় তাঁর মৃত্যুর মঞ্চ প্রস্তুত করেছিল— যে ঘাসের প্রতি জীবনানন্দের টান ছিল আমরণ। দমফাটা অট্টহাসিকে ঠোঁটে চেপে শুয়ে, পরি-পাওয়া তাঁর পূর্বপুরুষের মতো যেখানে তিনি শুয়ে ছিলেন হেমন্তের সন্ধ্যায়। যেখানে হাজার বছর খেলা করছে অন্ধকারে। জোনাকির মতো।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Dewy Season Literature song Poetry jibananda das Hemanta Mukherjee

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy