উদয়ন পণ্ডিত ‘হিতোপদেশ’ পড়াচ্ছিলেন পাঠশালায়। কিন্তু হিতোপদেশে কার হিত, সেটাই তো গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। শিক্ষামন্ত্রী এসে প্রথমে পাঠ বদলালেন, ছাত্রদের পড়ানো হল ‘হীরকের রাজা ভগবান’। তার পর পাঠশালা হল বন্ধ। শিক্ষালয় নিয়ে শাসকের সংশয়, ভয় এবং ফলত শিক্ষাঙ্গনে কর্তৃত্ববাদী হস্তক্ষেপের এ যেন এক আবহমান চিত্ররূপ। তার প্রকাশভঙ্গি দেশভেদে, কালভেদে বদলায় যদিও। শাসক কখনও শিক্ষালয়ের সরাসরি দখল চান; কখনও চান আনুগত্য।
যেমন, ডোনাল্ড ট্রাম্প দীর্ঘ দিন ধরেই আমেরিকার অভিজাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলির বিরুদ্ধে খড়্গহস্ত। তাঁর দাবি, প্রতিষ্ঠানগুলি আমেরিকার নীতির সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ মতাদর্শ প্রচার করে। ২০২৪-এর নির্বাচনী প্রচারের সময় তিনি কর, জরিমানা এবং আইনি পদক্ষেপের মাধ্যমে এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলির ভাঁড়ারে থাকা সুবিশাল ব্যক্তিগত অনুদান হ্রাসের প্রতিশ্রুতি দেন। ট্রাম্পের ভাইস প্রেসিডেন্ট জে ডি ভান্স আবার ২০২১-এ ‘শত্রু’ বলেই চিহ্নিত করেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে। অবশ্য, এই প্রবণতার সূত্রপাত তাঁদের হাত ধরে নয়— আমেরিকার রাজনীতিতে তাঁদের প্রাদুর্ভাবের বহু আগে, ১৯৭২ সালের ডিসেম্বরে ওভাল অফিসে হেনরি কিসিঞ্জার এবং আলেকজ়ান্ডার হাইগ জুনিয়রের সঙ্গে একটি কথোপকথনে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের ‘শত্রু’ বলে দাবি করেছিলেন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন।
এই শত্রু-বিজয় সম্পন্ন না হলে আমেরিকান সমাজের উপর ট্রাম্পের নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণ হয় না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলির অনুদান আটকে, বিবিধ চাপ সৃষ্টির মাধ্যমে তাদের নিয়ন্ত্রণে আনার তাই চেষ্টা চলে। কলাম্বিয়ার মতো ধনী প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয়ও সেই চাপের কাছে মাথা নোয়াতে বাধ্য হয়েছে। রুখে দাঁড়িয়েছে কেবল আমেরিকার প্রাচীনতম এবং ধনীতম বিশ্ববিদ্যালয়— হার্ভার্ড (ছবি)। প্রতিশোধ হিসাবে ট্রাম্প প্রশাসন হার্ভার্ডের বিপুল সরকারি অনুদান আটকে দিয়েছে, তাদের ‘ট্যাক্স-ফ্রি স্টেটাস’ পাল্টে দেওয়ার হুমকি দিয়েছে, এমনকি হার্ভার্ডের বিদেশি ছাত্র ভর্তির ক্ষমতাও কেড়ে নিতে চেয়েছে। হার্ভার্ড আদালতে গিয়েছে তাদের ‘অ্যাকাডেমিক ফ্রিডম’ রক্ষার্থে। এক দীর্ঘমেয়াদি জমাটি আইনি লড়াই হয়তো বিশ্ববিদ্যালয়ের বৌদ্ধিক স্বাধীনতার ক্ষেত্রে সরকারি হস্তক্ষেপের লক্ষ্মণরেখা আঁকতে সাহায্য করতে পারে পৃথিবীর অন্যত্রও।
প্রশ্ন হল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্বাধীনতা; এবং সেখানে যাঁরা পড়ান, গবেষণা করেন, পড়েন, তাঁদের স্বাধীনতার চরিত্র কী? রাষ্ট্রশক্তির রক্তচক্ষুই কি সেই স্বাধীনতার পথে একমাত্র বাধা? সেই স্বাধীনতার সীমাগুলিই বা কী? ইতিহাস সাক্ষী— ক্ষমতার সঙ্গে জ্ঞানচর্চা ও শিক্ষালয়ের বার বার সংঘাত বেধেছে। মধ্যযুগের ইউরোপে যেমন গির্জার ধর্মতত্ত্বের সঙ্গে সহমত না হলে নিপীড়িত হওয়ার সম্ভাবনা থাকত পণ্ডিতদের। আধুনিক পর্বে সে পরিস্থিতি পাল্টেছে, বিশেষত উনিশ শতকের গোড়ায় জার্মান দার্শনিক উইলহেলম ভন হামবোল্ট বার্লিনে নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করার পর থেকে। পরবর্তী পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলির প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নির্ধারণের ক্ষেত্রে হামবোল্টিয়ান মডেলের বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের স্বাধীনতা এবং গবেষণা ও শিক্ষাদানের একীকরণের মতো মৌলিক নীতিগুলি তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব ফেলেছে।
২০০৫-এ নিউ ইয়র্কের কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে অনুষ্ঠিত হয় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্টদের প্রথম বার্ষিক ‘গ্লোবাল কলোকিয়াম’। সেখানে ‘শিক্ষার স্বাধীনতা’-কে সংজ্ঞায়িত করা হল ‘কোনও রকমের হস্তক্ষেপ বা শাস্তি ছাড়াই সত্য এবং বোধগম্যতার অনুসন্ধান... অবশ্যই স্কলারদের অনুসন্ধানের নিয়ম ও মানদণ্ডের সাপেক্ষে গবেষণা পরিচালনা, শিক্ষাদান, কথা বলা এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা’ হিসাবে। সমস্যা হল, এক জনের কাছে যা সত্য, অন্যের কাছে তা নয়। আর, সেখানেই সংঘাত।
পাশাপাশি, অতীতের তুলনায় বৈশ্বিক শিক্ষাক্ষেত্র পাল্টেছে আরও এক ভাবে। দুনিয়া জুড়েই এখন গবেষণাপত্র ছাপানো, এবং তার সংখ্যা ও গুণমানের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিয়োগ, চাকরি পাকা হওয়া, পদোন্নতি, বেতন বৃদ্ধি, গবেষণার অনুদান এবং বিবিধ পেশাদারি সম্মাননা জড়িয়ে আছে ওতপ্রোত। আবার, যে সংস্থাগুলি গবেষণার জন্য অনুদান দেয়, তাদের কোন বিষয়ে আগ্রহ, সেটাই অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণ করে গবেষণার অভিমুখকে। ও দিকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলিও জাতীয় বা আন্তর্জাতিক র্যাঙ্কিং-তালিকা নিয়ে যথেষ্ট উদ্বিগ্ন। এ সবের ক্ষেত্রেও গবেষণাপত্র প্রকাশনায় রয়েছে প্রভূত গুরুত্ব। এ পথেই তৈরি হয় আজকের শিক্ষাব্যবস্থার নির্ণায়ক ‘পাবলিশ অর পেরিশ’ সংস্কৃতি। টিকে থাকার একমাত্র মন্ত্র সেখানে ক্রমাগত গবেষণাপত্র ছাপিয়ে যাওয়া। এই সংস্কৃতির দাপট কতখানি, টের পেয়েছিলেন ২০১৩ সালের নোবেলজয়ী ব্রিটিশ পদার্থবিদ, হিগ্স বোসন-খ্যাত পিটার হিগ্স— যথেষ্ট গবেষণাপত্র প্রকাশ না করায় ১৯৮০ সালে ইউনিভার্সিটি অব এডিনবরা থেকে নিজের চাকরিটি প্রায় খোয়াচ্ছিলেন তিনি। সে বছরই নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন পাওয়ায় কোনও ক্রমে চাকরি বাঁচে! আজকের ‘শিক্ষালয়’-এর ‘স্বাধীনতা’র এও এক রূপ বইকি।
আবার বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ানোটাও আজ পূর্বনির্ধারিত একটা কাঠামোর মধ্যে সীমাবদ্ধ। ১৬তম কিংবা ২০তম ক্লাসে কী পড়ানো হবে, সেটাও ছকে দেওয়া থাকে অনেক ক্ষেত্রে। শিক্ষকের ‘স্বাধীনতা’ নেই ছক ভাঙার। বিষয়বস্তু ইচ্ছেমতো বদলানোটাও ‘অ্যাকাডেমিক স্বাধীনতা’ নয়। অন্য দিকে, অ্যাকাডেমিক বাক্স্বাধীনতাও অনেকাংশেই সীমিত। অ্যাকাডেমিক বক্তৃতা আর পাবলিক স্পিচের মধ্যেও রয়েছে বিস্তর ফারাক। যা খুশি বলার স্বাধীনতা শিক্ষাঙ্গনে নেই। অ্যাকাডেমিক দৃষ্টিভঙ্গিও প্রায়শই সমগোত্রীয়দের পর্যালোচনার বিষয়, কষ্টিপাথরে তা যাচাই হতে থাকে ক্রমাগত। অ্যাকাডেমিক স্বাধীনতা তাই কখনওই যথেচ্ছ নয়। এই যেমন হার্ভার্ড বিজ়নেস স্কুলের আচরণবাদী অর্থনীতির অধ্যাপক ফ্রান্সেসকা জিনো-কে বরখাস্ত করা হল, তথ্য বিকৃত করে তার সাহায্যে গবেষণাপত্র লেখার অপরাধে। মনে রাখা ভাল, রাষ্ট্রনায়ক থেকে সোশ্যাল মিডিয়ার তারকা, এই অপরাধে আজ অনেকেই অপরাধী— তাঁদের যদিও শাস্তি হয় না।
আবার ভেবে দেখলে বোঝা যাবে, অ্যাকাডেমিক স্বাধীনতা ততটাই হওয়া সম্ভব যতটা সেই সময়কালে সংশ্লিষ্ট দেশের রাজনীতি এবং সমাজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিকে দিতে চাইবে। যেমন, সমাজবিজ্ঞান এবং জেনেটিক্স-সহ গবেষণার বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রকে ১৯৩০-এর দশকে সোভিয়েট ইউনিয়নে ‘বুর্জোয়া ছদ্মবিজ্ঞান’ হিসাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। আবার ১৯৫০-এর দশকে ম্যাকার্থিজ়মের সময়, কমিউনিজ়মের ভূতের ভয়ে অ্যাকাডেমিক স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের বিস্তর অভিযোগ উঠেছে আমেরিকায়। এ ছাড়া পৃথিবীর নানা প্রান্তে যে বিভিন্ন সময়ে অ্যাকাডেমিক স্বাধীনতার রশি ধরে টান দিয়েছে প্রশাসন এবং রাজনীতি— দিয়ে চলেছে— সে কথা বলা বাহুল্য।
উড়ন্ত ঘুড়ির স্বাধীনতা ঠিক কী? ঘুড়ি সাবলীল ভাবে উঁচুতে ওড়ার অর্থ, লাটাইধারী ব্যক্তিটি তাকে উড়তে দিয়েছে সুতো ছেড়ে। কিন্তু সেই ব্যক্তিই যদি বিশ্বাস করে যে, ঘুড়িটির আচরণ অনভিপ্রেত— তাকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা সে করবেই। গণতন্ত্রে তারও অবশ্য টিকি বাঁধা থাকে কোথাও। থাকে বিচার বিভাগ, পর্যায়ক্রমিক নির্বাচন। থাকে বলেই অমিত শক্তিশালী ট্রাম্প প্রশাসনের বিরুদ্ধে আদালতে যেতে পারে হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি, এবং আদালত হার্ভার্ডের আন্তর্জাতিক ছাত্র ভর্তির সরকারি নিষেধাজ্ঞায় আপাত-স্থগিতাদেশও দেয়।
এক দিকে স্বাধীনতার নিশ্চিত নিরাপত্তার আড়ালে কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজকর্ম যে দেশ কিংবা সমাজের সুস্থিতির পক্ষে ক্ষতিকর নয়, তাও নিশ্চিত করা প্রয়োজন নিশ্চয়। আবার ২০২২-এ হিউস্টন ল রিভিউ-তে প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে, ইয়েল ল স্কুলের অধ্যাপক কিথ হুইটিংটন বলছেন, সত্য-অনুসন্ধান এবং মানুষের জ্ঞানের অগ্রগতি ও প্রচারের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়গুলির প্রয়োজন স্কলার এবং শিক্ষকদের অ্যাকাডেমিক স্বাধীনতার জমাটি সুরক্ষা। সামাজিক-রাজনৈতিক পরিবর্তনের সঙ্গে শিক্ষালয়ের স্বাধীনতা এবং রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের সীমান্ত ক্রমাগতই পুনর্নির্ধারিত হতে থাকে। উদয়ন পণ্ডিতদের লড়াইও চলতেই থাকে। বাস্তবানুগ ভাবে। তাদের সাহায্যের জন্য অবশ্য কোনও গুপী-বাঘা নেই।
রাশিবিজ্ঞান বিভাগ, ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট, কলকাতা
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)