Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪
অমৃত মহোৎসবে বিষমন্থন
Subhas Chandra Bose

নেতাজি ও অন্যান্য স্বাধীনতা সংগ্রামী, সবাই শুধু ভোটের ঘুঁটি

তবে কথায় বলে, শকুনের শাপে গরু মরে না! জাতীয় নায়ক সুভাষচন্দ্রকে কেন্দ্র করে রাজনীতির ঝাড়ুদারের পঙ্কিল প্রলাপ ঠিক সেটাই।

অধিনায়ক: নেতাজি, গান্ধীজি, রবীন্দ্রনাথ। দিল্লির প্রজাতন্ত্র দিবস উৎসবে সে বারের বাংলার ট্যাবলো, ২৬ জানুয়ারি ২০১৯

অধিনায়ক: নেতাজি, গান্ধীজি, রবীন্দ্রনাথ। দিল্লির প্রজাতন্ত্র দিবস উৎসবে সে বারের বাংলার ট্যাবলো, ২৬ জানুয়ারি ২০১৯

দেবাশিস ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ২০ জানুয়ারি ২০২২ ০৮:০৯
Share: Save:

ধিক্কার বোঝাতে যত রকম শব্দ ব্যবহার করা সম্ভব, প্রথমেই তার সব দিলীপ ঘোষকে দিলাম। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলা ও বাঙালির, নির্দিষ্ট ভাবে সুভাষচন্দ্র বসুর, অবদানকে আরএসএস থেকে আসা বঙ্গবাসী এই বিজেপি-পুঙ্গব যে ভাবে হেয় করার চেষ্টা করেছেন, তাতে কোনও নিন্দাবাদই তাঁর পক্ষে যথেষ্ট নয়। ঘৃণাও এখানে মুখ লুকানোর পথ পাবে না!

সবাই জেনে গিয়েছেন, নেতাজি সুভাষচন্দ্রকে নিয়ে বাংলার তৈরি প্রজাতন্ত্র দিবসের ট্যাবলো তাঁর দিল্লির প্রভুরা ছেঁটে দেওয়ার পরে ঘটনাটিকে ‘বেশ করেছে, ঠিক করেছে’ বলেছেন দিলীপ ঘোষ। পদ্ম-আশ্রিত নেতার যুক্তি, “দিল্লির লোককে এখানে ঢুকতে দেবে না, তা হলে ওরাই বা কেন দেবে?” প্রসঙ্গত এ বার নেতাজির ১২৫তম জন্মবার্ষিকী এবং স্বাধীনতার ৭৫তম বর্ষ।

তবে কথায় বলে, শকুনের শাপে গরু মরে না! জাতীয় নায়ক সুভাষচন্দ্রকে কেন্দ্র করে রাজনীতির ঝাড়ুদারের পঙ্কিল প্রলাপ ঠিক সেটাই। পাঁক তো পদ্মেরই প্রিয় ঠিকানা। শুধু ভাবতে লজ্জা হয়, এঁরা এই বাংলার মাটিতেই রাজনীতি করেন! তাই এটুকু কথা বলতে হল।

অবশ্য সঠিক বললে, বিজেপির মতো ইতিহাসকে ভোলাতে বা বিকৃত করতে অভ্যস্ত একটি সঙ্কীর্ণমনা দলের কেন্দ্রীয় পদাধিকারী হিসাবে দিলীপ ঘোষ তাঁর ‘যোগ্য’ কাজই করেছেন। পাশাপাশি এটাও প্রমাণ হয়ে যাচ্ছে, কেন্দ্রের শাসক দলের কাছে বাংলা ও বাঙালির অবস্থান আজ কোথায়। নইলে এ বারের মতো একটি তাৎপর্যপূর্ণ বছরের কুচকাওয়াজে সুভাষচন্দ্রের উপর তৈরি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ট্যাবলো কি না ‘সময় সংক্ষেপ’ করার ছেঁদো যুক্তিতে ছেঁটে দেওয়া হয়!

এর পরেও ভোট আসবে। এঁদের মুখে আবার ‘বঙ্গাল’-এর জন্য, এখানকার মানুষের জন্য, মনীষীদের জন্য আবেগময় ভাষণ শোনা যাবে। তাতে ভোটের চিঁড়ে কতটা ভিজবে, সেটা পরের কথা। কারণ সেই ধাঁধা বড় সহজ নয়। তবে এ কথা বলতেই হবে, বাংলার পক্ষে নেতাজির ‘অবমাননা’ সহজে ভুলে যাওয়া কঠিন।

তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেওয়া হয়, প্রধানমন্ত্রীকে মুখ্যমন্ত্রীর চিঠি, বিভিন্ন মহলে প্রতিবাদ ইত্যাদির পরিপ্রেক্ষিতে কেন্দ্র আগের সিদ্ধান্ত বদলে ফেলল, তা হলেও মূল বিষয়টি একই থাকে। কারণ ‘চাপে’ পড়লে হয়তো সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করা যায়। কিন্তু মানসিকতার হেরফের ঘটে না।

গত ডিসেম্বরের কথাই মনে করা যাক। স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর উদ্‌যাপনের জাতীয় কমিটিতে এই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আছেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী কমিটির মাথায়। সেখানে মোদীর ডাকা ভার্চুয়াল বৈঠকে অন্য কয়েকটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা বলার সুযোগ পেলেও বক্তার তালিকায় নামই ছিল না বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর। তিনি নিছক শ্রোতা হয়ে বসে থাকলেন।

কারা সেখানে বলেছেন, সেটা আলোচ্য নয়। প্রশ্ন হল, স্বাধীনতা উৎসব উদ্‌যাপনের প্রস্তুতি বৈঠকে বাংলার বক্তব্য জানানোর সুযোগ থাকবে না কেন? এটা তো, এক অর্থে, স্বীকৃতিও। স্বাধীনতা আন্দোলনে বাংলার ভূমিকা কী, সে কথা নতুন করে বুঝিয়ে বলার জন্য আজ, পঁচাত্তর বছর পরে, একটি অক্ষর ব্যয় করা মানেও জাতীয় অপমান। কারণ প্রত্যেক ভারতবাসীর তা জানা।

আরও বড় কথা হল, যাঁরা দেশ চালাতে বসেন, বাংলার সেই গৌরবময় ইতিহাস সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান থাকা তাঁদের পক্ষে বাধ্যতামূলক। তবু বাংলাকে সেখানে কার্যত ব্রাত্য করে রাখা হয়েছিল। নানা ভাবে রাখা হচ্ছে। নেতাজি-ট্যাবলো তাতে সাম্প্রতিক সংযোজন।

রাজনীতির বিভিন্ন পরতে প্রায় সর্বদাই কিছু না কিছু ‘অপকৌশল’ দেখতে আমরা অভ্যস্ত। যেখানে ভাল-মন্দের ঊর্ধ্বে প্রাধান্য পায় ক্রূর দলীয় স্বার্থ। দলমতনির্বিশেষে এটা এখন বাস্তব। তবে এমন কতকগুলি বিষয় থাকে, ব্যক্তি থাকেন, যেখানে সবার আবেগ, সংবেদনা একই সুরে বাঁধা। অন্তত সেটাই থাকা উচিত।

স্বাধীনতার ইতিহাস আমাদের সেই পরম গর্বের সম্পদ। স্বাধীনতা আন্দোলনের পুরোধারা তারই ব্যক্তিরূপ। রাজনীতি কতটা কদর্য স্তরে নামলে সেই দেশনেতাদের নিয়েও ন্যক্কারজনক টানাপড়েন হয়, স্বাধীনতার ‘অমৃত মহোৎসব’ উদ্‌যাপনের বছরে দেশ তার সাক্ষী হল।

আমরা কিন্তু দেখেছি, গত বছর রাজ্যে বিধানসভা ভোটের ঠিক আগে নেতাজি সুভাষচন্দ্র দিল্লির শাসকদের কাছে বিশেষ ‘মাহাত্ম্যপূর্ণ’ হয়ে উঠেছিলেন। শুধু তা-ই নয়, সেই সময় ভোটের বাজার ‘ধরতে’ এক একটি জেলার, এক একটি গোষ্ঠীর, এক একটি সম্প্রদায়ের নেতাদের নাম কাগজে লিখে এনে মঞ্চে দাঁড়িয়ে তাঁদের ‘স্মরণ’ করতেন নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহেরা। আসলে ‘বোঝাতে’ চাইতেন, তাঁরা কত বেশি ‘বাংলার’!

২০২১-এর ২৩ জানুয়ারি ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল প্রাঙ্গণে সুভাষচন্দ্রের ১২৫তম জন্মোৎসব পালনের জমকালো অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এসেছিলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। দিনটি গোটা দেশে ‘পরাক্রম দিবস’ হিসাবে পালন করার কথা ঘোষণা করে তিনি সে দিন মনে করিয়ে দেন, নেতাজি ব্রিটিশের কাছে ভিক্ষে করে স্বাধীনতা পেতে চাননি। তিনি আপন শক্তিতে স্বাধীনতা অর্জন করার ডাক দিয়েছিলেন।

এক অদ্ভুত সমাপতনে আজ মোদীর সরকার নেতাজির উপর তৈরি বাংলার ট্যাবলো বাতিল করে দেওয়ার পরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বললেন, “আমরা কারও কাছে ভিক্ষে চাইছি না। কারও করুণাও চাইছি না। কিন্তু স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসকে যারা অবজ্ঞা ও অবহেলা করে, জাতি তাদের কখনও ক্ষমা করবে না।”

গত বছর নেতাজির জন্মোৎসব উপলক্ষে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের ওই সরকারি অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বক্তব্য শুরু করার মুহূর্তে ‘আমন্ত্রিত’দের মধ্য থেকে একদল
‘রামভক্ত’-এর উচ্চকণ্ঠের নিনাদ শোনা যায়। তাকে কেন্দ্র করে মুখ্যমন্ত্রীর উষ্মা এবং বক্তৃতা না-করার ঘটনা ছিল সে দিনের আর এক তাৎপর্যপূর্ণ সংযোজন। প্রধানমন্ত্রী সে দিনও নীরব দর্শক হয়ে বসে ছিলেন। কোনও হস্তক্ষেপ করেননি। ফলে সে দিনও বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর কথা বলা হয়ে ওঠেনি।

একের পর এক এই ধরনের ঘটনার পরেও কি মেনে নিতে হবে, এর পিছনে কোনও রাজনীতি নেই? বরং যাঁরা সেটা বোঝাতে চান, তাঁদের উদ্দেশ্য নিয়েই প্রশ্ন তোলার যথেষ্ট অবকাশ আছে। কারণ ঘটনা হল, বাংলা ছাড়াও ট্যাবলো-কোপে এ বার আরও দুই রাজ্য তামিলনাড়ু ও কেরল। গত ভোটে ওই দুই রাজ্যেও বিজেপি হেরেছে।

মোদী-জমানায় বাংলার ট্যাবলো বাতিল হওয়ার নজির অবশ্য আছে। ২০২২ পর্যন্ত ধরলে চার বার এমন হয়েছে। ২০১৪-র মে মাসে মোদী ক্ষমতায় আসার পরেই ’১৫ সালে রাজ্যের ট্যাবলো বাতিল হয়। বিষয় ছিল ‘কন্যাশ্রী’। ২০১৮-তে দিল্লি ফের বাতিল করে দিল ‘একতাই সম্প্রীতি’ শীর্ষক ট্যাবলো। ২০২০-তে যে ট্যাবলোটি বাতিল হয় সেখানে জল সংরক্ষণ, সবুজ সংরক্ষণ ইত্যাদির সঙ্গে ‘কন্যাশ্রী’র উল্লেখ করা হয়েছিল। ওগুলির পিছনে রাজনীতির যুক্তি নাহয় বোঝা যায়।

এ বার তো বাতিলের খাতায় পড়ে গেলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু! মনের বিদ্বেষ-বিষ লুকোতে এখন বলা হচ্ছে, সময়ের কারণে সব রাজ্যকে সব বছর সুযোগ দেওয়া যায় না। তাই পশ্চিমবঙ্গ এ বার বাদ পড়েছে। তথ্য বলছে, এই যুক্তিও অসার। কারণ গত পাঁচ-সাত বছরে মোদী-শাহের গুজরাত এক বারও এমন ছাঁটাইয়ের তালিকায় পড়েনি।

আর ছাঁটাই যদি করতেই হয়, তা হলেও তা কি রাজ্যের নাম দেখে হবে, না কি বিষয় বিবেচনায়? স্বাধীনতার ৭৫ বছর ও নেতাজি সুভাষচন্দ্রের ১২৫ বছর এক সঙ্গে পেয়েও যাঁদের সেই ‘চেতনা’ জাগল না, ইতিহাস তাঁদের মার্জনা করতে পারবে তো!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Subhas Chandra Bose Netaji mahatma gandhi
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE