Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪
school

তালাঝোলা স্কুল, স্তব্ধ শৈশব

এক দিকে শিক্ষক নিয়োগের দাবিতে আন্দোলন চলছে, অন্য দিকে শিক্ষকেরা কাজ বাঁচাতে ছুটছেন স্কুলের বিজ্ঞাপন দিতে।

সন্দীপন নন্দী
শেষ আপডেট: ১১ অক্টোবর ২০২১ ০৬:১৪
Share: Save:

গেটে ঝুলছে মস্ত তালা। পাশেই এক ঢাউস সাইনবোর্ড। তাতে তিরচিহ্ন দিয়ে লেখা, ‘নতুন স্কুল এই পথে।’ মিড-ডে মিল নিতে আসা ছাত্রীরা লাইন ধরে সে পথে হাঁটছে। সেই নতুন স্কুলের নামের ফলকের নীচে সদ্য জুড়ে-যাওয়া স্কুলের নামটি ছোট্ট করে লিখে দিয়েছেন কর্তৃপক্ষ। বাতিল স্কুলটি বন্ধ কারখানার মতো পড়ে থাকে। তার ছাত্রীরা তাদের পুরনো স্কুলের ইউনিফর্ম পরে ঘুমোতে যায়। বন্ধ স্কুলে পোকামাকড়ের উল্লাস বাড়ে। সরকারি খাতায় এমন অনেক স্কুল এখন শুধুই একটি ‘ফ্লাড শেল্টার’। ক্রমে ইট, টিন, দরজা, সব লুট হয়ে যায়। কচি গলার কলকাকলির স্তব্ধ স্মারক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে একা একটা স্কুলবাড়ি।

স্কুলে তালা পড়া শুধু শিক্ষকদের অসম্মান নয়, অশনিসঙ্কেতও। এক প্রধান শিক্ষিকা আক্ষেপ করছিলেন “আমার স্কুলের নাম শোনেননি না, কোনও দিন? শুনবেন কী করে? সব তো পান্তা ফুরানো ঘর। লিখবে কী? শীত পড়লেই ক্লাসে বসে কাঁপে। সোয়েটার নেই। বর্ষায় ভেজা জামা গায়েই শুকোয়, ছাতা নেই।” এরা হল সেই সব পরিবার, যেখানে মেয়ের জ্বর বাড়লে ওষুধের দোকানে গিয়ে বাবা বলেন, “দশ টাকার মধ্যে যা হয় একটা দেন।” এক দিকে নামীদামি ইংরেজি মাধ্যমে ছাত্রীদের ভিড়, যেখানে স্কুলের ফি বছরে দু’লাখ। অন্য দিকে সরকারি অনুদান, জলপানি দিয়েও বাংলা স্কুলের ছবিটা করুণ। কিন্তু স্কুল ফ্রি হলেই তো হল না, পড়াশোনার খরচ আছেই। এক টোটোচালক অভিভাবক জানালেন, লকডাউনের পর প্রাইভেট মাস্টার চার মাসের বকেয়া টাকা না পেয়ে বাড়ি এসে অপমান করে গিয়েছেন। তাই মেয়ের পড়া বন্ধ।

শিক্ষকরা দুঃখ করেন, লকডাউনে কত যে ছাত্রছাত্রী ঘর ছাড়ল! কেউ পরিবারকে জানিয়ে, সকলের ভাত জোগাতে। কেউ না জানিয়ে, একটু ভাল জীবনের আশায়। “ছাত্রীরা স্কুলে না এলে কী ভূতেদের পড়াব?” রেগে উঠলেন এক দিদিমণি। “পঞ্চাশ জন ছাত্র নিয়ে সেকেন্ডারি স্কুল চলে? তাই ডিআইকে বলে তালা লাগিয়ে দিলাম।” তাঁর আক্ষেপ, ছাত্রছাত্রীরা আগে ছিল স্কুলের প্রাণ। এখন তাদের মনে করা হচ্ছে স্কুলের পুঁজি। চাকরি বাঁচানোর তাগিদে বেশ কিছু বাংলা মাধ্যম সরকারি স্কুলের শিক্ষকরা স্কুল বাঁচানোর শেষ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। “মনোরম পরিবেশে সন্তানকে পড়াতে চান? দক্ষ শিক্ষক সান্নিধ্যে, সীমিত খরচে আপনার শিশুর স্বপ্ন সফলের একমাত্র ঠিকানা, নদীপার উচ্চবিদ্যালয়।” স্থানীয় কাগজের এমনই বিজ্ঞাপন দেখা যায় এখন। আগে ভর্তির বিজ্ঞাপন দিত শুধু ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলো। এখন বাংলা স্কুলও ছাত্র টানার প্রতিযোগিতায় নেমেছে।

স্কুলশিক্ষকরা পেয়েছেন এক নতুন দায়িত্ব, অতিমারির পর স্কুল খুললে পড়ুয়াদের স্কুলে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করা। এক দিদিমণির দায়িত্ব ছিল স্টেশনপাড়ার পঞ্চাশটা বাড়ি ঘুরে ছাত্রীদের স্কুলে ফিরতে উৎসাহ দেওয়া। ঘরে ঘরে গিয়ে যা পেলেন, তাতে আরও মুষড়ে পড়েছেন। নিজের হাতেগড়া মেয়েগুলোই মুখের উপর বলেছে, আর স্কুলেই আসবে না! শুধু অনলাইনেই ক্লাস করবে। তা হলে সবাই যে স্কুল খোলার দাবি নিয়ে চিৎকার করছেন? গরিব পড়ুয়াদের ভবিষ্যৎ শেষ হয়ে যাওয়ার আক্ষেপ করে হাহাকার করছেন? আসলে ঘরে বসে দুর্দান্ত নম্বর পেতে সকলের ভাল না লাগলেও, অনেক অভিভাবক-ছেলেমেয়ের কাছে ব্যবস্থাটা সুবিধেজনক মনে হচ্ছে। যারা পড়ায় আগ্রহী, শিক্ষামূলক ‘অ্যাপ’ তাদের লেখাপড়ার চাহিদা মেটাচ্ছে। স্কুল না গিয়ে, পাঠ্যবইকে অচ্ছুত রেখেও ভাল নম্বরের হাতছানি কে অগ্রাহ্য করতে পারে?

দরিদ্র বাবামায়েরাও সন্তানের মুখ চেয়ে প্রচুর খরচ করে মোবাইল ডেটাপ্যাক কিনছেন, তাতে অ্যাপ ডাউনলোড করার পয়সাও জোগাচ্ছেন। জানা গেল, দিনমজুর ঘরের এক নার্সারি ছাত্রীকে অনলাইন ক্লাসের জন্য সোনার দুল বেচে ফোন কিনে দিয়েছেন দিদা। এ সব কিছুই স্কুলকে আবশ্যিক থেকে ঐচ্ছিক করে তুলছে। এ বার হয়তো বইয়ের দোকানেও তালাঝোলা শুধু সময়ের অপেক্ষা।

এই পরিস্থিতি কি অপ্রত্যাশিত ছিল? না কি, এমন হওয়ারই ছিল? বহু দিন ধরেই সরকারি স্কুলে নাম লিখিয়ে ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করেছে বেসরকারি স্কুলে, মিড-ডে মিল শেষ না হতে ফাঁকা হয়ে যায় সরকারি স্কুল। শেখার ঘাটতি চাপা পড়ে যায় অথৈ নম্বরে। প্রত্যন্ত এলাকার স্কুলে ছাত্র বেশি, শিক্ষক কম। শহরের গা ঘেঁষাঘেঁষি স্কুলে ছাত্র কম, শিক্ষক বেশি। এক দিকে শিক্ষক নিয়োগের দাবিতে আন্দোলন চলছে, অন্য দিকে শিক্ষকেরা কাজ বাঁচাতে ছুটছেন স্কুলের বিজ্ঞাপন দিতে।

যে রাজ্যে পাঁচ-ছয় লক্ষ শিশু এখনও স্কুলের পড়া শেষ না করেই লেখাপড়া সাঙ্গ করে, সেখানে স্কুল উঠে যায় কেমন করে? “সব প্রশ্নের উত্তর হয় না, জানেন?” বললেন এক শিক্ষক।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

school Coronavirus
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE