কয়েক বছর ধরেই রাহুল গান্ধীর রাজনীতির অনেকটা জুড়ে একটিই দাবি: জাতিগণনা। তার প্রয়োজন কী? ঠিক সংখ্যা না জানলে, উন্নয়নের স্বার্থে যথাযথ নীতি নির্মাণ সম্ভব নয় আধুনিক গণতন্ত্রে। যাঁরা পিছিয়ে, তাঁদের অগ্রসর হওয়ার পথ প্রসারিত করার দায়বদ্ধতাটা নৈতিক। যার যত সংখ্যা, সেই অনুপাতে ন্যায়সঙ্গত সুযোগ পাওয়াটা ন্যায্য। জাতিগণনার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য, আদর্শগত দিক থেকে দেখতে গেলে— বিপুল সংখ্যক মানুষ যাঁরা জাতিভিত্তিক নির্যাতন ও বঞ্চনার শিকার হয়েছেন দীর্ঘকাল— তাঁদের সমান্তরালে আনা।
ভারতে শেষ পূর্ণাঙ্গ জাতি গণনা হয় ১৯৩১ সালে। স্বাধীন ভারত কেন বরাবর জাতিগণনাবিমুখ? এমন নয় যে দেশ থেকে জাতিভেদ প্রথা বিলুপ্ত; এও নয় যে নিম্নবর্গের সব মানুষ এত উন্নতি করেছেন যে জাতির প্রশ্ন নিরর্থক। অনেকের মতে জাতিগণনা আরও বিভেদ সৃষ্টি করবে। বিভেদ এমনিতেও যথেষ্ট প্রকট— রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বে, সংগঠিত কর্মক্ষেত্রে, গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায় বা উচ্চপদে। এই বিভেদ ও দূরত্ব ছাপিয়ে জাতিগণনা নতুন কোন বিভেদ গড়বে? তথ্য বিভেদ বাড়াবে, এই যুক্তি সত্য হলে শ্রেণিভিত্তিক তথ্য শ্রেণিবিভেদ, ধর্মভিত্তিক তথ্য ধর্মবিভেদ, ভাষাভিত্তিক তথ্য ভাষিক দ্বন্দ্ব বাড়াত। এদের নিয়ে তথ্য সংগ্রহে যদি রাষ্ট্রের আপত্তি না থাকে, তবে জাতি গুনতে অসুবিধা কী?
সরকারি শিক্ষা ও কর্ম সংস্থায়, তফসিলি জাতি-জনজাতির সংরক্ষণে, তাদের সংখ্যার হিসাব অনস্বীকার্য। মোট জনসংখ্যার অনুপাতে তাদের সংখ্যা কত গোনা হয়, কিন্তু উচ্চবর্ণের জাতিভিত্তিক সামাজিক অবস্থানের তথ্য সংগ্রহ হয় না। তারা যে শিক্ষা, রোজগার ও ক্ষমতার পরিসরে কতটা এগিয়ে সেটা গণনার বাইরে। আর্থ-সামাজিক পদমর্যাদা ও রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বে তাদের প্রতাপ— গণনার বাইরে। স্বাধীনতা-উত্তর ভারতে, প্রায় সব উচ্চমর্যাদার আসনই যে তাদের দখলে, সেটাও।
জাতিগণনায় কী উন্মোচিত হবে, তাতে কার ক্ষতি? হিন্দুত্বের ভিত্তি— অন্য ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ ও বিতৃষ্ণা জাগিয়ে, হিন্দু ভোট একত্রীকরণ। তাতে হিন্দু ভোট কম বিভাজিত হয়। জাতির মূলে আছে অনৈক্য ও অসমতা: জন্ম, কর্ম, জীবিকার ভিত্তিতে প্রথাগত প্রভেদ সৃষ্টি করা যা উচ্চবর্ণের স্বার্থে— উচ্চবর্ণের দ্বারা রচিত, পরিচালিত। সেই পরিপ্রেক্ষিতে, আধুনিক কালে উচ্চবর্ণের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে সরব হয়ে নিজেদের অধিকার দাবি করাটা সংবিধানসম্মত। সহস্র বছর ধরে যাঁরা অবহেলিত, তাঁদের ক্ষোভ যুক্তিহীন নয়। হিন্দুত্ব হল সেই প্রলেপ যার তলায় আপাতভাবে এই বিভেদ ঢাকা পড়ে ধর্মের দোহাইয়ে— পরধর্মকে শত্রু ঠাওরে। গোনাগুনি শুরু হলেই সেই প্রলেপের নীচ থেকে যেই না অনুপাতহীনতা ও অসামঞ্জস্যের আখ্যান উঠে আসবে, তা থেকে প্রমাণ হবে, বঞ্চনা আজও বর্তমান। ধর্মীয় রাজনীতির কারবারিদের পক্ষে তা বিপজ্জনক। অসম সুবিধা ও অসম ক্ষমতার ছবি সৎ ভাবে তুলে ধরলে আরও সুযোগ, সংরক্ষণ সম্প্রসারণের দাবি উঠবে— শুধু অতি-সীমিত সরকারি পদে নয়, সর্বক্ষেত্রে। দাবি উঠবে অধিক প্রতিনিধিত্বের।
ঔপনিবেশিক কাল থেকে কারা আধুনিক শিক্ষা-সংস্কৃতিতে একচ্ছত্র রাজ করেছে? কাদের হাতে শিক্ষার আলোকপ্রাপ্তির অধিকার ও নিয়ন্ত্রণ ছিল, কারা তা সহজেই আধুনিক চাকরি ও সম্পদে রূপান্তরিত করতে সক্ষম হয়েছে? উত্তর এতটাই স্পষ্ট যে, এর জন্য কোনও সমীক্ষার প্রয়োজন নেই। আজ যাঁরা জোরগলায় বলেন জাতি তাঁদের কাছে অর্থহীন, তাঁদেরও ভাবনার পশ্চাতে দেখা যেতেই পারে (উচ্চ)জাতিগত প্রতিপত্তির রূপান্তরকরণ। উচ্চবর্ণের উচ্চ স্তর ও তার বিশেষ অধিকার কাজে লাগিয়ে আজ আমরা বলি আধুনিকতা, মেধা, যোগ্যতা— এ সবই আমাদের; আমরাই বৈধ, ওরা আমাদের জায়গা দাবি করলে আমাদের বর্জ্য সামলাবে কে? পদদলিতেরা কোন অধিকারে আমাদের সঙ্গে একাসনে বসবে, বসলেও ওরা সবাই ‘কোটা’, ‘অযোগ্য’। সংখ্যা গুনলে, এই অপ্রিয় সত্যটি উন্মোচিত হবে। সত্য অদৃশ্য থাকলে শোষণ, শাসন ও অসাম্যের ভিত্তি বহাল থাকে। আম্বেডকরের ভাষায়, কেউ প্রবেশাধিকার বন্ধ করে, আর কেউ প্রবেশাধিকার বন্ধ পায়। অসাম্যের ছবিটা সংখ্যার হাত ধরে উন্মোচিত হলে সেই দরজা ভাঙার দাবি উঠবে। ক্ষমতাশালী ও সম্পদের অধিকারী উচ্চবর্ণের তা কাম্য নয়।
১৯৪৭-এ ক্ষমতার হস্তান্তর হলেও ক্ষমতার পুনর্বণ্টন হয়নি। জমির মালিক, সাংস্কৃতিক দিগ্গজ, বুদ্ধিজীবী, রাজনৈতিক নেতৃত্ব, ভদ্রলোক, নবজাগরণের পুরোধা, কেউই শক্তির ভারসাম্য নষ্ট করতে চাননি— জাতিগত ও শ্রেণিগত স্বার্থ বজায় রাখার তাগিদে। তাঁরা যে প্রায় সকলেই উচ্চবর্ণের, সেটি নেহাত কাকতালীয় নয়। কেউই জাতিসূত্রে প্রাপ্ত ক্ষমতা ও সম্পদ হাতছাড়া করতে চাননি বা ভাগাভাগি করে নিতে চাননি ‘নিচু’ জাতির মানুষের সঙ্গে, শ্রমিকের বা মহিলাদের সঙ্গে। এই সত্য স্বীকার করলে সমাজে আধিপত্য ও শোষণ বজায় থাকবে না। সংখ্যার আয়না তাই আমাদের কাছে অসহ্য।
সমাজতত্ত্ব বিভাগ, শিব নাদার বিশ্ববিদ্যালয়।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)