তরুণ বয়সের পর আর সরাসরি বিদেশি গানের সুরে কথা বসাননি রবীন্দ্রনাথ। ‘অল ল্যাং সাইন’-এর সুরে ‘পুরানো সেই দিনের কথা’, ‘ইয়ে ব্যাঙ্কস অ্যান্ড ব্রিজ়’-এর সুরে ‘ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে’, অথবা ‘ব্রিটিশ গ্রেনেডিয়ার’-এর সুরে ‘কালমৃগয়া’-র ‘তুই আয় রে কাছে আয়’— সবই তাঁর একুশ-বাইশ বছরের মধ্যে করা কাজ। কিন্তু, আশৈশব শোনা পাশ্চাত্য সুর, বেটোফেন-মোৎজ়ার্ট-বাখ-ওয়াগনার, অথবা পরবর্তী কালের স্ট্রাউস বা চায়কভস্কি তাঁর মননে যে ছাপ ফেলেছিল, জোড়াসাঁকোয় একই সঙ্গে চলতে থাকা পিয়ানো আর যদুভট্টের গান যে ভাবে মিলেমিশে গিয়েছিল তাঁর সঙ্গীতবোধে, রবীন্দ্রনাথের সুর সারা জীবন বহন করেছে সেই উত্তরাধিকার। কিন্তু সে কথায় যাওয়ার আগে প্রত্যক্ষ বিদেশি সুরের কথাই বলি। চার মাত্রার গান ‘অল ল্যাং সাইন’ নিলেন তিনি, কিন্তু ‘পুরানো সেই দিনের কথা’ বাঁধলেন তিন মাত্রায়, লয় কমিয়ে দিলেন। সেই মুহূর্তে গানটা তাঁর নিজস্ব হয়ে গেল। অথবা, সেনাবাহিনীকে উজ্জীবিত করার জন্য যে ‘ব্রিটিশ গ্রেনেডিয়ার’ গানটি, তার সুর সামান্যতম না বদলেও তাকে পরিয়ে দিলেন শৃঙ্গারের আভরণ— ‘কালমৃগয়া’-য় ঋষিকুমার গাইল, “তোর হাতে মৃণাল-বালা, তোর কানে চাঁপার দুল, তোর মাথায় বেলের সিঁথি, তোর খোঁপায় বকুল ফুল।” গানের শরীর থেকে খসে গেল বারুদের গন্ধ, রবীন্দ্রনাথ তাকে স্নিগ্ধ করলেন।
লেখার শুরুতে বললাম, তরুণ বয়সের পর আর সরাসরি বিদেশি সুর নেননি রবীন্দ্রনাথ, তবে পাশ্চাত্যের সুরের চলন থেকে গিয়েছে তাঁর গানের অন্তঃপুরে। কিন্তু, তারুণ্যে প্রবেশ করার আগেই, কিশোর রবি যখন ‘ভানুসিংহের পদাবলী’ লিখছেন? তাঁর ভাষা বৈষ্ণব কবিদের, সুরের বহিরঙ্গে রয়েছে কীর্তন। কিন্তু অন্তরে? ‘গহনকুসুমকুঞ্জমাঝে’ গানটাকে যদি একটু লয় বাড়িয়ে পিয়ানোতে বাজানো যায়, নির্ভুল ফুটে উঠবে ‘ওয়াল্টজ়’-এর চলন। বলরুমে যে সুরে নাচ হয়, রাধা-কৃষ্ণকে রবীন্দ্রনাথ বেঁধেছেন সেই সুরের চলনে। এক বার নয়, বার বার। আবার, যে গান নিতান্ত ব্যক্তিগত, সেখানে নিয়ে আসছেন কীর্তনের সুর— ‘না চাহিলে যারে পাওয়া যায়’। তাঁর সুরকে কোনও প্রচলিত খাঁচায় বন্দি করতে পারা অসম্ভব। মাঝে মাঝে মনে হয়, জন লেনন যে গেয়েছিলেন, ‘ইম্যাজিন, দেয়ার’স নো কান্ট্রি’— সেই কাঁটাতারহীন বিশ্বটাই রবীন্দ্রনাথের সুরের পৃথিবী।
কী ভাবে চলত তাঁর সুরের মন, সত্যজিৎ রায় ধরতে পেরেছিলেন। ঘরে বাইরে-তে বিমলা যখন বাইরে আসছে, দীপক চৌধুরীর সেতারে তখন বাজছে ‘এ কী লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ প্রাণেশ হে’। সেতারে স্বভাবত যতখানি মিড় থাকে, এই ক্ষেত্রে তার চেয়ে কম। আর তার পরই বেজে উঠছে অর্কেস্ট্রা— চেলো, ভিয়োলা, ভায়োলিন। উদ্যাপন। প্রশ্ন হল, সত্যজিৎ এখানে এই অর্কেস্ট্রা পেলেন কী ভাবে? রবীন্দ্রনাথ তার বীজ রেখে গিয়েছিলেন বলেই পেলেন। গানের হারমোনিক প্রগ্রেশন সেই অবকাশ তৈরি করে দেয় বলেই পেলেন। প্রত্যক্ষ ভাবে তো এই গান বিদেশি সুর থেকে পাননি রবীন্দ্রনাথ। সাবিত্রী দেবীর কণ্ঠে ত্যাগরাজের সুরে বিখ্যাত ‘লাবণ্যে পূর্ণ রামা’ শুনে তার থেকে তৈরি করেছিলেন গানটি। অথচ তার কাঠামোয় নির্ভুল ভাবে ছিল বাখ, ব্রাহ্মস-এর প্রভাব। সত্যজিৎ রবীন্দ্রনাথকে এখানে ডিকোড করলেন, ডিকনস্ট্রাক্ট করলেন— কিন্তু, অর্কেস্ট্রা রেখে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথই। এমন ভাবে, যাতে আপাতদৃষ্টিতে তা ধরা না পড়ে। তাকে ধরতে প্রয়োজন হয় সত্যজিতের মতো কোনও জিনিয়াসকে। অন্য একটা গান— ‘সহে না যাতনা’— শুনে দেখুন, তার পিছনে দাঁড়িয়ে আছেন জোহান সেবাস্টিয়ান বাখ।