E-Paper

আমাদের ভাবাবেগ জিন্দাবাদ

যে কথাটা আজকের দেশে ‘উন্মত্ত বিক্ষোভ’-এর চোটে প্রায় হারাতে বসেছে, তা হল এই গানকে জাতীয় গান করে তোলার পিছনে রবীন্দ্রনাথের অবদানই কিন্তু প্রধান।

সেমন্তী ঘোষ

শেষ আপডেট: ০৯ নভেম্বর ২০২৫ ০৫:৩৬
বহুবলধারিণী: জাতীয় কংগ্রেস অধিবেশনের প্রারম্ভে বন্দে মাতরম্ গান, জয়পুর, ১৯৪৮

বহুবলধারিণী: জাতীয় কংগ্রেস অধিবেশনের প্রারম্ভে বন্দে মাতরম্ গান, জয়পুর, ১৯৪৮

সালটা ১৯৩৭। রবীন্দ্রনাথ চিঠি লিখলেন বুদ্ধদেব বসুকে: ‘‘বন্দে মাতরম্ ব্যাপারটা নিয়ে বাঙালি হিন্দু সমাজে যে উন্মত্ত বিক্ষোভের আলোড়ন উঠেছে, আমার বুদ্ধিতে এ আমি কখনো কল্পনাও করিনি। গালিগালাজ জিনিসটা চিরপ্রত্যাশিত— বাংলাদেশে যখন জন্মেছি তখন কটূক্তির হিল্লোল উঠলেই অনুভব করি স্বদেশী হাওয়া সেবন করছি। এ নিয়ে কোনোদিন নালিশ করিনি। আমার দুঃখিত হবার দিন গেছে, কিন্তু বিস্মিত হবার বোধশক্তি এখনো ভোঁতা হয়ে যায়নি।’’

বাক্যগুলি পড়ে অজানতেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়তে হয়। ভাগ্যিস এ চিঠি লেখার চার বছরের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ চলে গিয়েছেন! নয়তো ‘কটূক্তির হিল্লোলে’ আর ‘স্বদেশী হাওয়া’র ঝোড়ো ঝাপটায় বোধহয় তাঁর শ্বাসরোধ হয়ে যেত। যেমন আজ হচ্ছে আমাদের অনেকেরই। প্রধানমন্ত্রী মোদী বলেছেন, বন্দে মাতরম্ গানের একটা অংশ কাটার পক্ষে মত দিয়েছিলেন যাঁরা, দেশভাগের বীজ বপন করেছেন তাঁরাই। আরও স্পষ্ট করে বলেছেন বাঙালি বিজেপি নেতা, ‘কত দিন আর রবীন্দ্রনাথ ধুয়ে জল খাবেন?’ আজকের এই ‘বাঙালি হিন্দু সমাজের উন্মত্ত বিক্ষোভের আলোড়ন’-এর মধ্যে ভাগ্যিস তিনি নেই!

অথচ তাঁর সে দিনের মতটা মোটেই কিছু অ-সাধারণ ছিল না, সাধারণ বোধেরই বিষয় ছিল। কী বলেছিলেন তিনি? প্রসঙ্গ ছিল— কংগ্রেস সভায় বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বন্দে মাতরম্’ গান গাওয়া উচিত কি না। মুসলমানদের পক্ষ থেকে আপত্তি উঠেছিল এই গানকে জাতীয় মঞ্চে গাওয়ার বিরুদ্ধে, কেননা এই গানের প্রথম দুই স্তবকের পর নানা পৌত্তলিক শব্দে দেশমাতার আরাধনা হয়েছে, কিন্তু পৌত্তলিকতা কিংবা দেশকে মাতা কল্পনা, দু’টিই ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধ। তা ছাড়া, বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠ উপন্যাসে গানটির ব্যবহার যে প্রসঙ্গে, সেখানে শত্রুরূপে দেখানো হয়েছে মুসলমানদেরই, অর্থাৎ রিপুদলবারিণী মাতা-কে আহ্বানের মধ্যে ‘রিপু’ অর্থাৎ শত্রু বলতে তাঁদেরই বোঝানো হচ্ছে, এমনটাই সিদ্ধান্ত করছিলেন তাঁরা। অন্য দিকে, কংগ্রেসের দিক থেকে জেদ— পুরো গানই রাখতে হবে, মুসলমান দাবির কাছে মাথা নত করা চলবে না। এই বিষম সঙ্কটে পড়ে জওহরলাল নেহরু আর সুভাষচন্দ্র বসু যখন এলেন রবীন্দ্রনাথের মত নিতে, বিবেচনা করে কবি বললেন, গানটির প্রথম দুই স্তবক গাওয়া হোক, বাকিটা নয়!

ব্যাস, আর যায় কোথা। পত্রপত্রিকায় বিরোধিতা তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল, তীব্র নিন্দা দিকে দিকে, লেখক-সাহিত্যিকরা কলকাতায় সভাও ডাকলেন এ নিয়ে। সেই সভায় প্রবাসী পত্রিকার সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়কে ভার দেওয়া হল, লিখিত প্রতিবাদ গান্ধীজির কাছে পৌঁছে দিতে। বুদ্ধদেব বসু বা ব্রাহ্ম ধর্মাবলম্বী রামানন্দরা যে এ বিষয়ে বিশেষ সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলেন, এইটুকুই বলে দেয়, গোঁড়া হিন্দুত্ববাদীদের বাইরেও অনেকে রবীন্দ্রনাথের এই সিদ্ধান্তের মানতে পারেননি। উদারমতে বিশ্বাসী মানুষদেরও মনে হয়েছিল, এমন ঐতিহাসিক গান, জাতীয় আন্দোলনের সঙ্গে যা অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িয়ে, তার কয়েকটি কথাকে আলাদা করে তুলে আঘাত পাওয়ার পরিস্থিতিকে পাত্তা দেওয়া কেন। পৌরাণিক কোনও দেবদেবীর নাম থাকা মানেই কি তা হিন্দুত্ব-দোষে বর্জনীয়? তা ছাড়া, বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছিলেন সপ্ত কোটি, পরে ১৯০৫ সালে সরলা দেবীর পাঠান্তরে যা দাঁড়ায় ‘ত্রিংশ কোটি’ কণ্ঠ কলকলনিনাদকরালে, তাতেও কি সত্যিই মুসলমানদের বাদ দেওয়ার বাসনা ছিল? মুসলমান নেতাদের অপছন্দ কি বাধ্যত মেনে নিতেই হবে, ওঁদেরও কি মেনে নেওয়া এবং ছেড়ে দেওয়ার অভ্যেস করতে হবে না? সেই সময়কার আনন্দবাজার পত্রিকা কঠোর সমালোচনা করেছিল— কোনও বিশেষ সমাজের এই ‘শুচিবায়ুগ্রস্ততা’ নিয়ে কি এগোনো যাবে কোথাও?

বাস্তবিক, রবীন্দ্রনাথও মনে করতেন না, বন্দে মাতরম্-এর ওই বিতর্কিত স্তবকগুলিতে অত কিছু পৌত্তলিকতা রয়েছে। যে কথাটা আজকের দেশে ‘উন্মত্ত বিক্ষোভ’-এর চোটে প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে, তা হল এই গানকে ‘জাতীয় গান’ করে তোলার পিছনে রবীন্দ্রনাথের অবদানই কিন্তু প্রধান। ১৮৭৫ সালে লেখা এই কবিতা, কয়েক বছর পর আনন্দমঠ উপন্যাসে তা অন্তর্ভুক্ত হয়। সেখান থেকে তুলে নিয়ে এই কবিতাকে গানের সুর দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথই, বঙ্কিমচন্দ্রকে শুনিয়ে সন্তুষ্ট করতে পেরেছিলেন। রবীন্দ্রনাথেরই জন্য ১৮৯৬ সালের কংগ্রেস অধিবেশনে এই গান সমবেত কণ্ঠে উদাত্ত আবেগে গাওয়া হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথই এই গান স্বদেশি আন্দোলনের সমার্থক করে তুলেছিলেন। রবীন্দ্রনাথই সেই সময়ে ভাগ্নি এবং রাজনৈতিক নেত্রী সরলা দেবীকে বলেছিলেন, যতটা সুর দিয়েছেন তিনি, বাকি স্তবকগুলিতেও সুর দিতে।

কিন্তু তবুও কেন ১৯৩৭ সালে তিনি এই মত দিলেন? কেননা তিনি বুঝেছিলেন, সময়টা অনেক পাল্টে গিয়েছে ইতিমধ্যে। গান তো কেবল গান নয়, তার একটা আকাশও থাকে। ১৯০৫ সালের স্বদেশি আন্দোলন ও তার পরবর্তী সময়ে এই গান গাওয়া হত যখন, আকাশটা ছিল তুলনায় পরিষ্কার। ক্রমে যখন যুগান্তর-অনুশীলন দল এই গানকে তাদের মন্ত্র বানিয়ে নিল, এর সঙ্গে মিশতে শুরু করল নানা হিন্দু আচারের ঘটা, তখন থেকেই গানটির সেই অদৃশ্য আকাশে ঘন ভারী মেঘ জমা শুরু হল। এই সময়ে এক দিকে জোর পেল হিন্দুবাদী জাতীয় কার্যক্রম— যা থেকে রবীন্দ্রনাথ নিজেকে সরিয়ে নিলেন সচেতন ভাবে। অন্য দিকে তৈরি হল মুসলিম লীগ নামে রাজনৈতিক দল, যার পর পরই মর্লে-মিন্টো সংস্কার দুই ধর্মসমাজকে পৃথক নির্বাচনী ব্যবস্থা ‘উপহার’ দিয়ে চিরপৃথক করে দিল। মজা হল, ১৯২০-র দশকের আগে কিন্তু ভারতে ‘সাম্প্রদায়িক’ কথাটাও মন্দ অর্থে ব্যবহার হত না, তার অর্থ ছিল ‘সম্প্রদায়-বিষয়ক’— আকাশটা তখন এতই অন্য রকম। ১৯৩৭ সালে বন্দে মাতরম্ নিয়ে যখন এত তর্কাতর্কি, তখন সবে প্রথম বার দেশ জুড়ে প্রাদেশিক নির্বাচন হয়েছে। কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ সরাসরি নির্বাচনী আঙিনায় প্রতিযোগী রূপে অবতীর্ণ হয়েছে। বাংলায় হাওয়া বইছে কংগ্রেসেরই দিকে, তা বুঝে নিয়ে কংগ্রেস থেকে বলা হল, অধিবেশনে বন্দে মাতরম্ গাইতে হবে সকলকেই। তাতেই ঘোর আপত্তি তুললেন মুসলমান নেতারা।

এই পরিস্থিতিতে সাধারণ বোধ থেকেই রবীন্দ্রনাথের মনে হয়েছিল, তিনি বা তাঁরা কী ভাবছেন, সেটাই শেষ কথা হতে পারে না। ভারতের মতো বহুসমাজ বহুসংস্কৃতি বহুধর্মের দেশে, অন্যরা কী ভাবছেন, সেটাও মন দিয়ে শোনা ও বিবেচনা করা উচিত। বিবেচনায় যদি মনে হয়, তার মধ্যে কিছুমাত্র যুক্তি আছে, তবে সেই অন্য যুক্তি মানতে দ্বিধা থাকা উচিত নয়। বুদ্ধদেব বসুকে লেখা ওই চিঠির পরের লাইনগুলি দেখা যেতে পারে এই সূত্রে।

“তর্কটা হচ্ছে এ নিয়ে যে ভারতবর্ষে ন্যাশনাল গান এমন কোনো গান হওয়া উচিত যাতে একা হিন্দু নয়, কিন্তু মুসলমান, খ্রীষ্টান, এমনকি ব্রাহ্মও— শ্রদ্ধার সঙ্গে ভক্তির সঙ্গে যোগ দিতে পারে। তুমি কি বলতে চাও ‘ত্বং হি দুর্গা’, ‘কমলা কমলদলবিহারিণী’, ‘বাণী বিদ্যাদায়িনী’ ইত্যাদি হিন্দু দেবী নামধারিণীদের স্তব, ‘যাদের প্রতিমা পূজি মন্দিরে মন্দিরে’, সার্বজাতিক গানে মুসলমানদের গলাধঃকরণ করতেই হবে। হিন্দুদের পক্ষে ওকালতি হচ্ছে এগুলি আইডিয়া মাত্র। কিন্তু যাদের ধর্মে প্রতিমাপূজা নিষিদ্ধ, তাদের কাছে আইডিয়ার দোহাই দেবার কোনও অর্থই নেই।”

সোজাসরল কথা। দেশের ভাবনায়, দেশের কাজে সবাইকে চাই, এই যদি প্রাথমিক শর্ত হয় (রবীন্দ্রনাথরা, জওহরলাল-সুভাষচন্দ্ররা এমনই ভাবতেন, যদিও আজ তা প্রাথমিক কেন, কোনও শর্ত হিসাবেই গণ্য নয়)— তা হলে জাতীয় বা ন্যাশনাল গান হিসাবে এমন কিছুই রাখা ভাল, যাতে কারও মনে আঘাত লাগার পরিস্থিতি তৈরি না হয়।

অতটা সোজাসরল না হলেও, আরও দুটো জরুরি কথা ওঠে। প্রথমত, বন্দে মাতরম্-এর শেষের স্তবকগুলি নাহয় বাদ গেল, কিন্তু প্রথম দু’টি স্তবক তো রইল— তাতেও কি মাতৃরূপের আরাধনা নেই? মুসলমান ভারতীয়দের তাতেও আঘাত লাগার কথা, কিন্তু কেন রবীন্দ্রনাথ প্রথম দু’টি স্তবক গাইতে নিষেধ করলেন না? এর উত্তরটা সহজেই অনুমেয়। স্বাধীনতা আন্দোলনের স্মৃতিধন্য, শহিদের রক্তধন্য এই গান নিয়ে একটা সমঝোতায় আসতেই হবে— কিছুটা রেখে কিছুটা ছেড়ে— রবীন্দ্রনাথ বা নেহরুরা জানতেন সেটা। সে জন্যই স্বাধীনতার পরও কংগ্রেস অধিবেশন শুরু হত এই গান দিয়েই।

দ্বিতীয়ত, প্রধানমন্ত্রী মোদী ও তাঁর মিত্রোঁদের আজ জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছে করে, হঠাৎ বন্দে মাতরম্-এর পুরো গানটা গাইতেই বা হবে কেন, যেখানে জনগণমন অধিনায়ক জয় হে-র পুরো গানটি কখনও গাইতে শোনা যায় না? না কি, জনগণমন-র পরের স্তবকে হিন্দু-বৌদ্ধ-শিখ-জৈন-পারসিক-মুসলমান-খ্রিস্টানি আছে বলে অতটা গাওয়ার কোনও দরকার নেই, আর বন্দে মাতরম্-এ দুর্গাবন্দনা আছে বলে সেটা গাইতেই হবে?

তৃতীয় একটা কথাও আছে বইকি। হিন্দু রক্ষণশীলরা তখন এঁড়ে জেদাজেদি করছিলেন, কিন্তু পাশে বুদ্ধদেব-রামানন্দের মতো মুক্তবুদ্ধির মানুষরাও ভেবেছিলেন— ‘ভাবাবেগ’-এ এত সহজে আঘাত লাগবে কেন। সে দিন এ কথা ভাবা যেত, বলা যেত। কিন্তু সময়ের আকাশ যে ভাবে পাল্টেছে, তাতে আজকের ভারতে কি আমরা আর ও সব বালখিল্য প্রশ্ন তুলতে পারি? আমরা তো জানি, কয়েকশো বছর আগে তৈরি মন্দির-মসজিদ নিয়ে আজও ভাবাবেগ কেমন আঘাত-জর্জরিত। ঐতিহাসিক সৌধ কেমন জনতার ভাবাবেগে চুরমার করা যায়, কত মানুষের প্রাণ যায়। ভাবাবেগ-এর সপক্ষেই আদালতের বাণী বর্ষিত হয়। তার পর কি আর এ সব প্রশ্ন সাজে?

না কি, নিজের ভাবাবেগে আঁটিসাঁটি, পরের ভাবাবেগে দাঁতকপাটি? আমরা সংখ্যায় বেশি বলে আমাদের ভাবাবেগ জিন্দাবাদ। যারা সংখ্যায় কম, তাদের ভাবাবেগ বাক্সবন্ধ থাক? এই না হলে গণতন্ত্রের দেশ!

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Nationalism Congress Rabindranath Tagore Bankim Chandra Chattopadhyay Bengali

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy