E-Paper

দুঃসাহস, না কি দুরভিসন্ধি

অগস্ট মাসে, বিজেপির জাতীয় ও রাজ্য নেতৃত্ব বাংলা আর বাংলাদেশি দু’টি পৃথক ভাষা বলে এক ভাষাতাত্ত্বিক আবিষ্কারের কথা ঘোষণা করেন।

স্নিগ্ধেন্দু ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ০৮ নভেম্বর ২০২৫ ০৫:৩৩
প্রতিবাদী: অসমে ‘আমার সোনার বাংলা’ গাওয়ার জন্য কংগ্রেসকর্মীর বিরুদ্ধে দেশদ্রোহের মামলার প্রতিবাদে শামিল বিশ্বভারতীর বাম পড়ুয়ারা।

প্রতিবাদী: অসমে ‘আমার সোনার বাংলা’ গাওয়ার জন্য কংগ্রেসকর্মীর বিরুদ্ধে দেশদ্রোহের মামলার প্রতিবাদে শামিল বিশ্বভারতীর বাম পড়ুয়ারা।

আজ থেকে পাঠশালা বন্ধ’। হীরকের শিক্ষামন্ত্রীর সেই অবিস্মরণীয় নির্দেশিকার মতোই বিজেপি নেতৃত্ব জানিয়ে দিয়েছেন, ‘আমার সোনার বাংলা’ এখন থেকে বিদেশি সঙ্গীত। পশ্চিমবঙ্গে দেশবিরোধী শক্তির শাসন চলছে বলে এই গান গাওয়া যাচ্ছে। অসম বিজেপি শাসনে, তাই সেখানে গাওয়া যাচ্ছে না।

এর আগে, অগস্ট মাসে, বিজেপির জাতীয় ও রাজ্য নেতৃত্ব বাংলা আর বাংলাদেশি দু’টি পৃথক ভাষা বলে এক ভাষাতাত্ত্বিক আবিষ্কারের কথা ঘোষণা করেন। সম্প্রতি অসমের শ্রীভূমি জেলায় এক প্রবীণ বাঙালি কংগ্রেসকর্মী বিধুভূষণ দাস দলীয় অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি গাওয়ায় সে রাজ্যের বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী হিমন্তবিশ্ব শর্মা তাঁর বিরুদ্ধে দেশদ্রোহের মামলা করার নির্দেশ দেন, ‘বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত’ গাওয়ার অপরাধে।

১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গের প্রেক্ষিতে রচিত এই গান বাঙালি পরিচয়গত আবেগের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থান করে। সেটা অসমের মুখ্যমন্ত্রী না জানতেও পারেন। কিন্তু বঙ্গ বিজেপির অন্যতম মুখপাত্র সজল ঘোষ ভারতের মাটিতে ‘আমার সোনার বাংলা’ গাওয়া চলবে না বলে বিবৃতি দেওয়ার পর স্পষ্ট হয়, বাংলা ভাষার মতোই রবীন্দ্রনাথকে ভাগ করাও তাঁদের দলগত অবস্থান। সপ্তাহ গড়ালেও এই বক্তব্যের বিরোধিতা করে বিজেপি রাজ্য নেতৃত্ব কোনও বিবৃতি দেননি। অসম নেতৃত্বও ভুল স্বীকার করেননি।

ভাষা ভাগ বা রবি-ভাগ অবশ্য শুধু এঁরা চান না। পূর্ব বাংলার মুসলিম মৌলবাদী শক্তি সেই পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকেই বাংলা ভাষাকে হিন্দু-ঘেঁষা বা অ-মুসলমানি বলে বাতিল করার চেষ্টা করেছে। রেডিয়োতে রবীন্দ্রসঙ্গীতের সম্প্রচার বন্ধ করেছে পাকিস্তান সরকার। রবীন্দ্রনাথ বা বাংলা ভাষা ভাঙেনি, কিন্তু পাকিস্তান ভেঙে গেছে।

গত বছর অগস্টে, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর যখন বাংলাদেশের মুসলিম মৌলবাদী শক্তিগুলি প্রকাশ্যে দাপাদাপি শুরু করে, তখনও এক দফা দাবি ওঠে দেশের জাতীয় সঙ্গীত বদলানোর। কারণ তাদের মতে রবীন্দ্রনাথ হিন্দু ও ভারতীয়, তাই তাঁর সৃষ্টি একটি ইসলামি রাষ্ট্রের জাতীয় সঙ্গীত হতে পারে না। যদিও রবীন্দ্রনাথ ব্রাহ্ম ছিলেন, সে তথ্য মৌলবাদী শক্তির কাছে অপ্রয়োজনীয়।

সে ভাবেই, ‘আমার সোনার বাংলা’ বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে গৃহীত হওয়ার ছয় দশক আগে থেকেই সব বাঙালির গান। কিন্তু মৌলবাদী শক্তির কাছে এই সত্য অপাঙ্‌ক্তেয় শুধু নয়, অস্বস্তিকরও বটে। আর বাঙালির কাছে? ২০২৪-এ বাংলাদেশে জাতীয় সঙ্গীত বিতর্কের মাঝেই একটি ভাইরাল ভিডিয়ো দেখিয়েছিল, মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে পাকিস্তানে আটকে পড়া এক বাঙালি মুসলমান কী ভাবে আজও পাকিস্তান ভঙ্গের প্রেরণাদায়ী এই সঙ্গীত সঙ্গোপনে বুকে ধরে রেখেছেন।

এমনকি, বাংলার মন জয় করতে, নরেন্দ্র মোদীও বাংলায় এসে তাঁর ভাঙা উচ্চারণে ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ বলে বক্তৃতা শুরু করেছিলেন। কিন্তু মুখ আর মুখোশের পার্থক্য ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে। উঠতই। কারণ বাঙালি হিন্দু সমাজের যে অংশটা রামমোহন-বিদ্যাসাগরদের প্রগতিশীলতার চরম বিরোধিতা করেছিল, সেই রক্ষণশীল অংশই বিজেপির অনুপ্রেরণা।

রামমোহন, বিদ্যাসাগর থেকে লালন ফকির, বাংলার উদার প্রগতিশীল ধারার উজ্জ্বল সব ব্যক্তির সংশ্লেষ ঘটেছিল রবীন্দ্রনাথে। যে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “অবিচলিত সনাতন প্রথার বড়াই যদি কেহ করিতে পারে তবে সে পশুপক্ষী কীটপতঙ্গ, মানুষ নহে,” তাঁকে হজম করা সনাতনী হিন্দুত্ববাদীদের পক্ষে কী ভাবে সম্ভব?

বস্তুত, ভারতে এক বাঙালি হিন্দুকে রবীন্দ্রনাথের গান গাওয়ার জন্য দেশদ্রোহীর তকমা দেওয়াটা একটু আশ্চর্য ঠেকতে পারে। বিজেপি তো হিন্দুদের পক্ষে। অসমিয়া জাতীয়তাবাদ চাইত হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সব বাঙালির বিতাড়ন। সব্বাই বাংলাদেশি। বিজেপি ও সঙ্ঘ পরিবার অসমে দাঁড়িয়ে বলেছে, হিন্দুদের আমাদের জায়গা দিতে হবে, শুধু মুসলমানদের তাড়াব। এবং তার পরেও রাজনৈতিক আধিপত্য বজায় রেখেছে। অসমে আসলেই অসমিয়া জাতীয়তাবাদের উপর হিন্দু জাতীয়তাবাদের একটা জয় হয়েছে, অন্তত সাময়িক।

তবু হিমন্তবিশ্ব কয়েক মাস আগে বলেন, আগামী জনগণনায় যাঁরাই নিজেদের মাতৃভাষা বাংলা হিসাবে উল্লেখ করবেন, সরকার তাঁদের বাংলাদেশি হিসাবে ধরে নেবে। উনি কি জানতেন না, অসমের বাঙালি হিন্দুরা— তাঁদের সবাই তো ‘বাংলাদেশি’ নন— বাংলাকেই মাতৃভাষা লিখবেন? এই অসমেরই শিলচরে পুলিশের গুলিতে এগারো জন বাঙালি বিক্ষোভকারীর মৃত্যু হয় ১৯৬১ সালে। সবাই হিন্দু। স্থানীয় বাঙালিরা আজও সে দিন ‘ভাষা শহিদ দিবস’ হিসাবে পালন করেন। তাঁরা বাংলাকে মাতৃভাষা হিসাবে উল্লেখ করবেন না? গাইবেন না ‘আমার সোনার বাংলা’?

বস্তুত, এর অর্থ, বাঙালি হিন্দুদের অসম আশ্রয় দেবে তাঁরা বাংলাদেশি হলেও, কিন্তু তাঁদের বাঙালিপনা ছাড়তে হবে। তাঁরা সে রাজ্যে বা এ দেশে জায়গা পাচ্ছেন হিন্দু হিসাবে, হিন্দু পরিচয়ের জন্য। তাঁদের বাঁচাবে হিন্দুত্ববাদ, বাঙালি জাতীয়তাবাদ নয়। মুখ্য বার্তা— বাঙালি আবেগ ছাড়তে হবে।

অতএব আঘাত রবীন্দ্রনাথের উপর। বাঙালি আবেগ বিজেপির জন্য বিপজ্জনক। বাঙালি আবেগ ‘ধর্মকারার প্রাচীরে বজ্র’ হানে, কারণ বাঙালি সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে আর্য, অনার্য, মোঙ্গোলয়েড, মুন্ডা, কোল, বৈদিক, বৌদ্ধ, ইসলামি ও আরও নানান সংস্কৃতির সংমিশ্রণে। আর বিজেপি তথা সঙ্ঘ পরিবার চায়, বাঙালি তার ভাষা-সাংস্কৃতিক আবেগ ছেড়ে আর্যাবর্ত অর্থাৎ উত্তর ও পশ্চিম ভারতের বৈদিক হিন্দুত্ববাদী আবেগ আঁকড়ে ধরুক।

ঠিক এই কারণেই কেন্দ্রীয় সরকার পশ্চিমবঙ্গের নাম বদলে শুধু বাংলা বা বঙ্গ করার অনুমতি দিচ্ছে না। বাংলাদেশ নামে একটি দেশ আছে, তাই নাম বাংলা হলে বিভ্রান্তি হতে পারে, এ ধরনের যুক্তির কোনও গ্রহণযোগ্যতা নেই। কারণ, পাকিস্তান ও ভারত দু’দেশেই পঞ্জাব আছে, কোনও বিভ্রান্তি হয়নি। বিজেপি কি পঞ্জাবের নাম বদলে পূর্ব পঞ্জাব রাখার দাবি জানায়? না। পাকিস্তানের পঞ্জাবে গুজরাত বলে একটি শহরও আছে। তা হলে রাজ্যের নাম বাংলা হলে বিজেপির আপত্তি কিসে?

আসলে, দেশভাগের ইতিহাস ও দেশভাগ-পরবর্তী পূর্ববঙ্গে হিন্দুদের উপর অত্যাচারকে বিজেপি এবং রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ (আরএসএস) পশ্চিমবঙ্গে অন্য যে কোনও কিছুর চেয়ে বেশি বাঁচিয়ে রাখতে চায়। বাংলাদেশের সঙ্গে, সেখানকার রাজনীতি না হলেও অন্তত সংস্কৃতির সঙ্গে, এ-পার বাংলার যে টান রয়ে গেছে, সেই নাড়ির যোগ ছিন্ন করাই তাঁদের দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য। আর এই নাড়ির টানের প্রাণকেন্দ্রে আছেন রবীন্দ্রনাথ। ও-দেশে মৌলবাদ-বিরোধিতার অন্যতম স্তম্ভ।

সাংস্কৃতিক ভাবে বাঙালিদের পৃথকীকরণ বাঙালি ভাষাগত জাতীয়তাবোধকে দুর্বল করে। সঙ্ঘ পরিবার চায় অন্যান্য সমস্ত পরিচয়কে হিন্দু পরিচয়ের অধীন হতে হবে। বাঙালি আবেগ, যা মূলত উদার ও প্রগতিশীল, তার সঙ্গে হিন্দুত্ববাদের উগ্র রক্ষণশীলতার সম্পর্ক অহি-নকুল।

বাংলাকে আর্যাবর্ত-মুখী করার লক্ষ্যের অংশ হিসেবেই তারা একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের গুরুত্ব ও আবেগ ক্ষুণ্ণ করতে চায়। তারা প্রচার করে, একুশে ফেব্রুয়ারির সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের কোনও সম্পর্ক নেই। বাঙালি জনগণের জন্য দ্বিতীয় ‘ভাষা শহিদ দিবস’ শিলচরের ঘটনাকেও উপেক্ষা করে হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা। পরিবর্তে, ২০২০-তে তারা ২০ সেপ্টেম্বর ‘পশ্চিমবঙ্গ মাতৃভাষা দিবস’ নামে একটি নতুন অনুষ্ঠান শুরু করে সম্পূর্ণ অপপ্রচারের উপর ভিত্তি করে।

২০১৮-র ২০ সেপ্টেম্বর উত্তর দিনাজপুরের দাঁড়িভিট স্কুলে ছাত্র-বিক্ষোভের সময় আরএসএস-এর ছাত্র সংগঠন, অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ (এবিভিপি)-র দুই কর্মীর মৃত্যু হয়। অভিযোগ পুলিশের গুলিতে মৃত্যুর, যদিও সেই অভিযোগ পুলিশ অস্বীকার করে। বিক্ষোভের কারণ, বাংলা ও গণিত শিক্ষকের শূন্যপদ পূরণের জন্য ছাত্রদের দাবি অগ্রাহ্য করে সরকার স্কুলে সংস্কৃত ও উর্দুর শিক্ষক নিয়োগ করে। কিন্তু সঙ্ঘ পরিবার সংস্কৃত শিক্ষক নিয়োগের ব্যাপারটি সম্পূর্ণ চেপে গিয়ে দাবি করে যে, স্কুলের ওই দুই প্রাক্তন ছাত্র ‘বাঙালিদের উপর উর্দু চাপিয়ে দেওয়া’র বিরুদ্ধে লড়াই করে মারা গেছেন। তাদের ‘ভাষা শহিদ’ বলে অভিহিত করে এই দিনটিই পশ্চিমবঙ্গের বাঙালির আসল ভাষা দিবস বলে প্রচার করে তারা। পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিকে শুধু বাংলাদেশ নয়, অসমের বাঙালিদের থেকেও বিচ্ছিন্ন করার এই চেষ্টা— নইলে ‘পশ্চিমবঙ্গ মাতৃভাষা দিবস’ আবার কী ব্যাপার?

রবীন্দ্রনাথের যা কিছু বাংলাদেশ গ্রহণ করেছে, সে-সব ত্যাগ করতে বলা মানে রবীন্দ্রনাথকেই ভাগ করতে চাওয়া। এই দুঃসাহস (না কি দুরভিসন্ধি?) আসলে বাঙালিকে তার সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য ভুলিয়ে হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্থানমুখী করে তোলার লক্ষ্যে চালিত। হিন্দুত্ববাদের ভাষা হিন্দি। বাংলা বা তামিলের মতো ঐতিহ্যশালী ভাষা-সংস্কৃতির সঙ্গে তাদের সংঘাত অনিবার্য। বাঙালি পরিচয়গত একাত্মতা হিন্দুত্ববাদী শক্তির অন্যতম বড় বাধা। কিন্তু বাংলাদেশ সংক্রান্ত যা কিছু, সে-সব বাদ দিতে পারলে বাঙালি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যেরও অর্ধেকই হাপিস করে দেওয়া যায়।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Rabindranath Tagore Bengali Bengali Culture

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy