Advertisement
০৫ মে ২০২৪
SSC recruitment scam

আমাদের ‘মাথাব্যথা’ নেই

শিক্ষায় দুর্নীতি হলে গণতান্ত্রিক ভারতে ভোটব্যাঙ্কে তেমন নড়চড় হয় না, যদি না সেটা বহুল প্রচারিত এবং দৃশ্যত ভয়ঙ্কর সমালোচিত হয়।

সুগত মারজিৎ
শেষ আপডেট: ২৭ জুলাই ২০২২ ০৬:২৮
Share: Save:

উত্তর ভারতের একটি প্রতিষ্ঠানের এক অধ্যাপক জানালেন, সরকারি প্রতিষ্ঠানে ইন্টারভিউয়ের মাধ্যমে চাকরি পেতে গেলে যে ঘুষ দিতে হয়, তা নিয়ে সেখানে আর কারও তেমন মাথাব্যথা নেই। এক দশক আগেও দক্ষিণ ভারতের এক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হাসতে হাসতে আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, এখানে উপাচার্য হওয়ার ‘রেট’ কত? কাজেই, পশ্চিমবঙ্গে স্কুলশিক্ষক নিয়োগ নিয়ে যে বিপুল দুর্নীতির খবর বেরোচ্ছে, সেটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং দেশের বেশ কিছু প্রান্তের ‘ট্র্যাডিশন’। এ কথাও সত্যি যে, শিক্ষার গোড়ার দিকের দুর্নীতি সবচেয়ে ভয়াবহ, কারণ শিশুদের চেতনার জমি যাঁরা তৈরি করবেন, তাঁদের নিজেদের দুর্নীতিপ্রবণতা ভিতটাকেই আলগা করে দেন। শিক্ষাক্ষেত্রকে কি খানিকটা দুর্নীতিমুক্ত রাখা যেত না? এর মূল সমস্যার একটা বড় দিক রাজনৈতিক প্রশাসনের শিক্ষা সম্পর্কে উদাসীনতা ও অসম্মান। বিশেষ করে শিক্ষার গুণমান সম্পর্কে।

শিক্ষায় দুর্নীতি হলে গণতান্ত্রিক ভারতে ভোটব্যাঙ্কে তেমন নড়চড় হয় না, যদি না সেটা বহুল প্রচারিত এবং দৃশ্যত ভয়ঙ্কর সমালোচিত হয়। আমরা ক্লাস রুমের ভিতরে, গবেষণায়, রাজনৈতিক সমাবেশে, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বলি, ‘শিক্ষাই সব’। কিন্তু নির্বাচনের প্রচারে কোনও দিন শিক্ষার গুণমান, প্রাথমিক কিংবা উচ্চশিক্ষার আসলে কী অবস্থা, তা নিয়ে কোনও উচ্চবাচ্য হয় না। কারণ, এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের রোজগারের উচ্চাশার প্রদীপে শিক্ষার সলতের প্রয়োজন কম। আর সেখানে দুর্নীতির ভূমিকাও তেমন নয়। যে রাজনৈতিক নেতা বিভিন্ন দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত, নিজের নির্বাচনী কেন্দ্রে তিনি অকুতোভয়। সব সময় জিতে আসছেন। এ দেশে জেলে বসে বিপুল ভোটে জিতছেন এমন মানুষ তো আছেন। তাঁদের ব্রাত্য করে রাখবে কার সাধ্য! যিনি শিক্ষার প্রাঙ্গণে নয়-ছয় করছেন, তিনি জনপ্রতিনিধি হচ্ছেন বার বার। আর তেমনটা হলে কোন দল তাকে বাদ দিয়ে চলবে?

আমরা শিক্ষাকে বিশেষ কোনও সম্মান দিই না, মুখে যতই অন্য কথা বলি না কেন। এক কালে অন্তত শিক্ষা মন্ত্রক বা উচ্চশিক্ষা মন্ত্রকের প্রতিভূ হিসাবে কিছু সম্মাননীয় মানুষকে শিক্ষা প্রশাসনের উপর দিকে রাখা হত। এখন সে সব পাট চুকে গেছে। এখন প্রাতিষ্ঠানিক শীর্ষপদ বা প্রাতিষ্ঠানিক শীর্ষস্থানীয় মানুষদের ক্ষমতা রাজনৈতিক ভাবে নির্ধারিত হয়। তাঁরা রাজনৈতিক আদর্শকে অনুসরণ করতে বাধ্য হবেন, এটাই ধরে নেওয়া হয়। অন্য দিকে, অভিভাবকরা সরকারি স্কুলে একটু বেশি পয়সা বেতন দিতে চান না, কিন্তু বেসরকারি স্কুলে বহু টাকা দিতে কুণ্ঠিত নন। অনেকে বলেন, ছেলেমেয়েরা স্কুলে তেমন শেখে না যাতে প্রতিযোগিতায় সক্ষম হতে পারে। শুধু স্কুলে পড়ে কিছু হয় না। এক-এক জনের এক-একটি বিষয়ে দু’জন শিক্ষক। কত বড় বিপদ প্রতিনিয়ত বয়ে বেড়াচ্ছি আমরা। সরকারি স্কুল যত খারাপ হবে, তত বেসরকারি ব্যবসা ফুলে ফেঁপে উঠবে। এগুলো কি কখনও নির্বাচনী প্রশ্ন হয়?

এ রাজ্যে ভাষা শিক্ষার এখন অবস্থা হল যে, ইংরেজি ও বাংলা, দুই ভাষায় পারদর্শী শিক্ষক প্রজাতি ধ্বংস হয়ে গেল। ইংরেজিতে সরকারি চিঠিপত্র লেখার বিপুল সমস্যা এ রাজ্যে বহু দিনের। ক্লাস ফোরের ছেলেমেয়ে ক্লাস ওয়ানের পড়াশোনা ঠিক মতো করতে পারে না। শুধু এই রাজ্য কেন, দেশের বিভিন্ন জায়গায় উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে দেখেছি যে, কলেজে পড়ার যোগ্য ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ক্রমহ্রাসমান। আমরা মুষ্টিমেয় সম্পদশালী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বসে আছি। গোল্লায় যাক সরকারি শিক্ষা— এ তো আমাদের ছেলেমেয়েদের জন্য নয়। হালে সর্বজনীন শিক্ষার আসল চেহারাটা নিয়ে বিভিন্ন কারণেই কারও মাথাব্যথা নেই।

ধরুন, প্রাথমিক স্তরে ১০০ জন শিক্ষকশিক্ষিকা চাকরি পেলেন, কিন্তু এঁদের মধ্যে ৯০ জন ভাল করে পড়াতে পারেন না বা পড়ান না। ফলে, চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রছাত্রী প্রথম শ্রেণির তুলনায় পিছিয়ে থাকে। এ বার, ওই ৯০ জনের মধ্যে দেখা গেল ১০ জন দুর্নীতি করে চাকরি পেয়েছেন। অন্য ১০ জনের পাওয়া উচিত ছিল। বেআইনি, চরম অন্যায়ের বিচার না করলে এ দুর্নীতি আরও জাঁকিয়ে বসবে। কিন্তু অন্য ১০ জন চাকরি পেলে শিক্ষার মৌলিক সমস্যার কতটা সুরাহা হবে? আমি সারাজীবন মফস্সলের অখ্যাত স্কুলে পড়েছি। ইংরেজির শিক্ষক না এলে অখ্যাত বাংলার মাস্টারমশাই ইংরেজি পড়াতেন। তাতে কিন্তু আমাদের শেখায় ঘাটতি থাকেনি।

শিক্ষায় দুর্নীতির নিয়ন্ত্রণের সবচেয়ে বড় বাধা আমরাই। আমার বাড়ির সামনের রাস্তা ঠিক রাখতে, জল সরবরাহ নিশ্চিত করতে, বা বিপদেআপদে সাহায্যে যিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করেন, তিনিই হয়তো মন্ত্রী হয়ে অন্য কোথাও প্রচুর আর্থিক দুর্নীতিতে যুক্ত হন। শেষ অবধি আমি ভোটটা তাঁকেই দিই। দলও তাঁকে বিশেষ পছন্দ করবে, কারণ এ সব মানুষকে শাস্তি দিলে যে গভীর ক্ষতি আটকানো যাবে, তাতে হয় দলের কোনও মাথাব্যথা নেই, কিংবা তা হলে রাজনৈতিক ক্ষমতা ত্যাগ করতে হবে। এই যে আমার ভোট একেবারে আমার অন্দর ও অন্তরমহলের স্বার্থসিদ্ধি দিয়ে নিয়ন্ত্রিত— এই বোধই সমস্যাকে টিকিয়ে রাখে। মধ্যবিত্ত ভাবে যে, রাজ্যে সরকারি শিক্ষাব্যবস্থার অবক্ষয় তাদের ছোঁবে না, কারণ তাদের সন্ততি বেসরকারি স্কুলে পড়ে; আর যাদের নির্ভর করতে হয় এই সরকারি ব্যবস্থার উপরেই, তাদের অনেকেরই এই ভাঙনের পুরো ছবিটা বোঝার ক্ষমতা নেই।

শিক্ষায় দুর্নীতি অনেক ধরনের জটিল সমস্যার প্রতিফলন। প্রাথমিক শিক্ষায় গুণমানের সমস্যা নিয়ে মাথাব্যথার বিশেষ প্রয়োজন— স্কুলে ভাল পড়াশোনা যাতে হয়, যাতে চতুর্থ-পঞ্চম শ্রেণির ছেলেমেয়েরা যথাযথ স্তরে পৌঁছতে পারে, যাতে শিক্ষা থেকে জীবিকা নির্বাহের সুযোগ বাড়ে, যাতে বিনে পয়সায় স্কুলে পড়ে প্রচুর টাকাপয়সা দিয়ে প্রাইভেট টিউশন না নিতে হয়। এবং, যাতে শিক্ষিত হতে গিয়ে ঘটিবাটি না বিক্রি হয়, যাতে সারা দেশে শিক্ষার গুণমানের উন্নতি এবং স্তরভেদ কমে, যাতে সুযোগ পেলেই গবেষণার টাকাকড়ি দেওয়া না হয়। শিক্ষার ক্ষতি হলে নাগরিকরা চটবেন, এবং তার প্রভাব পড়বে ভোটে, রাজনীতিকরা এই কথাটি বুঝলে পরিস্থিতি পাল্টাবেই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE