Advertisement
০৩ মে ২০২৪
India

উদার ভারতকে চিনিয়েছেন

বামিয়ানে কুষাণ শিল্পের ঐতিহ্যবাহী বুদ্ধমূর্তি ধ্বংস করেছিল ‘গোঁড়া’ তালিবানরা আর বাবরি মসজিদ ধ্বংস করেছিল ‘উদার’ হিন্দুরা।

পৌলমী ঘোষ
শেষ আপডেট: ১১ জুন ২০২২ ০৬:১০
Share: Save:

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আমন্ত্রণে ১৯২২-এ স্টেলা ক্রামরিশ (১৮৯৬-১৯৯৩) এ দেশে আসেন। শান্তিনিকেতনে দু’বছর আর ২৬ বছর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। পাশ্চাত্যভূমিতে ‘ভারত’-কে নতুন বিশ্লেষণে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিলেন; হিন্দুত্বকে কী ভাবে দেখতে হবে— সেটাও বুঝিয়েছিলেন। তাঁর ভারত আগমনের শতবর্ষ উদ্‌যাপনে বিদেশি প্রতিষ্ঠান অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছে, অথচ ভারতবন্ধু স্টেলা ক্রামরিশকে আমরাই ভুলে থেকেছি।

সুকুমারী ভট্টাচার্য একটি প্রবন্ধে পাশাপাশি দু’টি ঘটনা বর্ণনা করেছেন। বামিয়ানে কুষাণ শিল্পের ঐতিহ্যবাহী বুদ্ধমূর্তি ধ্বংস করেছিল ‘গোঁড়া’ তালিবানরা আর বাবরি মসজিদ ধ্বংস করেছিল ‘উদার’ হিন্দুরা। ইসলামি ধর্ম প্রতিষ্ঠার তাগিদে অ-ইসলামি ভাস্কর্য ধ্বংসে তালিবানি আগ্রাসন সংঘটিত হলেও বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পরিকল্পনা প্রতিশোধস্পৃহা থেকেই। ভারতীয় সংস্কৃতি অশ্রদ্ধা ও হিংসার শিক্ষা দেয় না। ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরকে বলেছিলেন: সত্য, দয়া বা সংযমের বাঁধ ভাঙলে অনেক মানুষ হয়তো প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে কোনও ঘটনার প্রতিশোধ নিতে পারে, কিন্তু তাতে অন্তরাত্মায় ধর্মের জোয়ার আসে না। আধুনিক সমাজবিদ শ্রীনিবাসের মতে, হিন্দুসভ্যতার বৈশিষ্ট্য পরমতসহিষ্ণুতা এবং বৈচিত্রের প্রতি আগ্রহ, যা আমরা ভুলতে বসেছি। দারিদ্র ও দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিয়ে, সামাজিক বৈষম্য ও অসংযমকে বাড়তে দিয়ে আড়ম্বরপ্রধান ধর্মকে অবলম্বন করে ধর্মসত্যকেই হারিয়ে ফেলছি।

মানুষের উৎকর্ষ প্রকাশ পায় শিল্পে। তাকে ধ্বংস করা মানে অশিক্ষায় প্রত্যাগমন। সচেতন মানুষের কর্তব্য ধ্বংসের প্রতিবাদ জানানো। এর জন্য চাই সচেতনতা, যাকে আমরা বলি আধ্যাত্মিকতা ও শিল্প-সংস্কৃতি সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা। এই ধারণাটি স্টেলার লেখায় মেলে। ধর্মের গভীরতা এবং উদারতা অনুভবে শিল্পই ভরসা, তার অনুভবের জন্য আধ্যাত্মিক সক্রিয়তা সহায়কারী। স্টেলা বুঝিয়েছেন, শিল্প আত্মসত্য উপলব্ধির মাধ্যম। তাঁর বই দ্য প্রেজ়েন্স অব শিব হিন্দুত্বের যে মর্মার্থ বোঝায়, তাতে এটি নিছকই শিল্প ইতিহাসের ধারাবিবরণী হয়ে থাকে না, বরং আত্মবিকাশের অবলম্বন হয়ে ওঠে— যা জীবনের প্রতি উৎসাহিত করে।

আদি শঙ্করাচার্য বলেছেন, জ্ঞান ও আনন্দের স্বরূপ শিব। ধারণাটি সাধারণের কাছে সহজগম্য হয় স্টেলার শিল্প-আধারিত বিশ্লেষণে। দ্য প্রেজ়েন্স অব শিব-এ শিব একটি সমন্বিত ধারণা, সভ্যতা সংস্কৃতি বা পরম্পরার সর্বময় প্রকাশ। এক দিকে তিনি মঙ্গলময়, আবার তিনিই রুদ্র। আমাদের একপেশে কল্পনায় ঈশ্বর সুদর্শন, মমতাময়। স্টেলার শতরুদ্রের বর্ণনায় শিব সঙ্কটতারণ আবার সঙ্কটকারণও। অমঙ্গল বোঝাতে বলা হয় ‘দক্ষযজ্ঞ বেধেছে’। দক্ষ রাজার যজ্ঞে আড়ম্বর ছিল, কিন্তু শিবের নিমন্ত্রণ ছিল না। প্রতি মুহূর্তে সংঘটিত প্রতিটি যজ্ঞ মানবকল্যাণকর হলে সেখানেই ঘটবে শিবের চূড়ান্ত প্রকাশ— ভাবতেন ভারতমুগ্ধ এই ইউরোপীয়।

হরপ্পা সভ্যতা থেকে শিব পশুপতি— শিল্পবিশ্লেষণে দাবি স্টেলার। হরপ্পার সিলমোহরে বজ্রকঠিন দেহধারী মানবাবয়বকে ধ্যানস্থ দেখা যায়। জলহস্তী, বাঘ, হাতি, গন্ডারের মতো বন্যপশু পরিবেষ্টিত পশুপতি। স্টেলার ব্যাখ্যায় পশুপতি ঊর্ধ্বরেতা, অর্থাৎ পরম যোগী মহাদেব। মনের বিক্ষেপণ এবং কামনা সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রাখা একমাত্র মহাদেবের পক্ষেই সম্ভব।

দ্য প্রেজ়েন্স অব শিব শিবের বৈষম্যহীনতা প্রকাশ করে। গভীর অর্থে শিব সমদর্শী। আধুনিক সমাজের লিঙ্গবৈষম্যের আভাসটুকুও শিবের মধ্যে নেই। এই বৈষম্যহীনতা বোধ হয় অর্ধনারীশ্বরের উৎসমুখ। তাঁর বর্ণনায় এটি উভলিঙ্গের প্রতীক হলেও উভমুখী যৌনতার নয়। শিব চূড়ান্ত পৌরুষোচিত, আকর্ষক। তাই শিবকে নিয়ে পার্বতী বিচলিত সর্বদা। আধুনিক দাম্পত্য এমন সন্দেহ বা নিরাপত্তাহীনতাকে বিচ্ছেদ পর্যন্ত টেনে নিয়ে যায়, কিন্তু শিব পার্বতীকে আশ্বস্ত করতে তাঁর অঙ্গসাৎ করে হলেন অর্ধনারীশ্বর। এই যুগ্ম রূপকল্পে শক্তির মাহাত্ম্য সম ভাবে মর্যাদাপূর্ণ। এই ধারণায় বিশ্বব্রহ্মাণ্ড বাঁধা, সংসারচক্র, সমাজের নীতি-নৈতিকতা, সাম্যের আদর্শও বাঁধা। নারীর প্রতি অসীম শ্রদ্ধাবোধ থেকে বিনায়ক গণেশের পিতৃত্ব স্বীকার করে পুত্রপরিচর্যায় পার্বতীর সহায়ক হয়েছিলেন তিনি। এ ভাবে শিব বাস্তুপতিও। নারীত্বই গভীর অর্থে প্রকৃতি, আমাদের স্বাতন্ত্র্য। শিব তাকে রক্ষা করেন ভৈরব রূপে।

স্টেলার ব্যাখ্যায়, শিব আত্মার দারিদ্রমোচনকারী। নিজের লাভের লোভে অন্যকে বঞ্চিত, অসম্মানিত বা উপেক্ষা করে বিপুলা পৃথিবীতে পৃথুলা হয়ে ওঠা অপরাধ। এই অপরাধে জন্ম নেয় পৃথিবীময় দারিদ্র। সেই দারিদ্র শুধু আর্থিক অসচ্ছলতা বা পরাধীনতা নয়; মনুষ্যত্বের মর্যাদার সঙ্গে মানবিকতা সামাজিকতা নৈতিকতার দ্বন্দ্ব। ভারতীয় সংস্কৃতির শিব নামক এই বিমূর্ত অথচ পূর্ণ ধারণাটির মধ্যে সকল দারিদ্র, দুঃখ অবসানের সঙ্কেত। স্টেলা বইটিতে এই বার্তা রেখে গিয়েছেন উদার ভারত সংস্কৃতির জন্য। আজকের ভারতে চলমান মেকি উগ্র হিন্দুত্বের নাগপাশ থেকে এই উদার ভারত-কে উদ্ধার করতে পারে এই অস্ট্রিয়ান বংশোদ্ভূত নারীর জীবনব্যাপী কার্যক্রম। প্রশ্ন, আমরা তা গ্রহণের যোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছি কি না!

শারীরশিক্ষা বিভাগ, বহরমপুর ইউনিয়ন ক্রিশ্চিয়ান ট্রেনিং কলেজ

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তেফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ

অন্য বিষয়গুলি:

India History
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE