E-Paper

জানা চাই সাহিত্যের ভূগোলও

ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, নদীর ভাঙন বা গতিপথ পরিবর্তন গ্রামজীবনকে প্রভাবিত করে। একের পর এক গ্রাম হারিয়ে যায়, নদীর বুকে জেগে ওঠে চর। জোয়ারের জলে চর ভরে যায়, জেগে ওঠে সুন্দরী কেওড়া গরানের জঙ্গল।

মৃন্ময় প্রামাণিক

শেষ আপডেট: ১৩ মে ২০২৫ ০৬:১২
Share
Save

ছোটনাগপুর অঞ্চলের অন্যতম বৃহৎ ভাষাগোষ্ঠী সাদরি— প্রায় পঞ্চাশ লক্ষ মানুষ মাতৃভাষা হিসাবে ও সত্তর লক্ষ মানুষ দ্বিতীয় ভাষা হিসাবে ব্যবহার করেন। সাহিত্যের ইতিহাসকারদের মতে, এ ভাষার সাহিত্যিক নিদর্শনের সন্ধান মেলে প্রায় সপ্তদশ শতাব্দী থেকে। ব্রিটিশ আমলেই এই মালভূমি অঞ্চলের বিপুল সংখ্যক জনজাতি গোষ্ঠীর মানুষকে নিয়ে যাওয়া হয় চা-বাগান অঞ্চলে, সেখানে জনসংযোগের ভাষা হিসাবে সাদরি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। উত্তরবঙ্গ ও উত্তর-পূর্ব ভারতের নানা জায়গায় তাই ব্যবহৃত হয় এ ভাষা। ব্রিটিশ ভারতে জনজাতি গোষ্ঠীর মানুষের একটা বড় সংখ্যক অভিবাসী হয়ে আসেন সুন্দরবনের নানা অঞ্চলে, সাদরি-ভাষীরাও। সুন্দরবনের মুন্ডা ও ভূমিজদের মুখের ভাষা সাদরি। ব্যাপক ভৌগোলিক বৈচিত্রের কারণে এ ভাষার কোনও একটিমাত্র রূপ নেই, আছে একাধিক ভাষাবৈচিত্র। অন্যান্য ভাষার শব্দে ব্যাপক মিশ্রণ ঘটেছে এতে, ভাষার ব্যবহারে পার্থক্য দেখা যায় ঝাড়খণ্ড, ছত্তীসগঢ়, সুন্দরবন বা হিমালয়ে।

সুন্দরবনের সাদরি ভাষায় প্রথম উপন্যাস লেখেন দয়ালহরি সরদার (মুন্ডা), বামন বুড়ির চর (প্রকা: গাঙচিল)। চলিত বাংলায় লেখা শুরু করে কিছুটা এগোনোর পর, লেখক কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রফিকুল হোসেনের পরামর্শে পুরো উপন্যাসটি লেখেন সাদরিতে। সাদরিতে লেখা প্রথম উপন্যাস বলেই নয়, মানুষের মুখের ভাষা হিসেবে ক্রমশ হারিয়ে যেতে থাকা এই ভাষার একটি সাহিত্যিক ডকুমেন্টেশন হিসেবেও বইটি গুরুত্বপূর্ণ। উপন্যাস-শেষে লেখক বাংলা ও সাদরি সমশব্দ সংগ্রহ দিয়েছেন। সুন্দরবনের শব্দভান্ডারের উপর নির্মিত নিরঞ্জন মণ্ডলের অভিধানটিও এই উপন্যাস পাঠের সহায়ক।

২০২২-এ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক ভারতীয় ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ আয়োজিত ‘সুন্দরবন অনুবাদ’ কর্মশালায় লেখকের উপস্থিতিতে এক দল অনুবাদক যৌথ অনুবাদ-পদ্ধতিতে উপন্যাসটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। লেখক সেই কর্মশালায় উপন্যাসের প্রেক্ষিত ও সাদরি ভাষাভাষী মানুষের জীবন নিয়ে বলেছিলেন, তুলে ধরেছিলেন সুন্দরবনের সাদরি গ্রামের প্রকৃতি। ইংরেজি অনুবাদটি সম্পাদনার কাজ করতে গিয়ে আমাদের মনে হয়েছিল, একটি নতুন পাঠপদ্ধতির অনুসন্ধান প্রয়োজন। উপন্যাসটি ভাল ভাবে বুঝতে এবং অনুবাদকর্মটি দক্ষ ভাবে সম্পাদনা করতে দরকার এক সাহিত্যিক বাস্তুতান্ত্রিক সংলাপ। সেই লক্ষ্যেই আমরা গিয়েছিলাম লেখকের গ্রামে— ক্যানিং থেকে কাটরাখালি হয়ে হানা নদী পেরিয়ে গোসাবার পাঠানখালির কামারপাড়া— যে গ্রাম উপন্যাসেরও গ্রাম। নদীতে জেগে ওঠা যে চর নিয়ে এই উপন্যাস, সেখানে আমরা সারা দিন ঘুরে বেড়াই; স্বয়ং লেখক ও গ্রামের কিছু যুবক আমাদের সঙ্গ দেন, বুঝিয়ে দেন সেই অঞ্চলের ভূগোল, মানুষের জীবন।

ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, নদীর ভাঙন বা গতিপথ পরিবর্তন গ্রামজীবনকে প্রভাবিত করে। একের পর এক গ্রাম হারিয়ে যায়, নদীর বুকে জেগে ওঠে চর। জোয়ারের জলে চর ভরে যায়, জেগে ওঠে সুন্দরী কেওড়া গরানের জঙ্গল। সেখানে জীবিকার সন্ধানে দরিদ্র মানুষ যান কাঁকড়া ধরতে, কেওড়া ফল সংগ্রহ করতে। নতুন বাসস্থানের সন্ধান করতে হয় কোনও কৃষিভূমিতে। নদীর ভাঙনে রাস্তা হারিয়ে যায়, নতুন যে বিচ্ছিন্ন পাড়া তৈরি হয় সেখানে আর পুরনো সমাজ টিকে থাকে না। সাদরি, ওরাওঁ, সাঁওতাল মানুষেরা তাঁদের সমাজ ও পুরনো পাড়া হারানোর সঙ্গে সঙ্গে হারান স্বভাষায় কথা বলার মানুষও। চর্চার অভাবে নতুন প্রজন্ম হারিয়ে ফেলে নিজেদের ভাষা। বাঙালি অধ্যুষিত পাড়াতে নতুন বসতি গড়তে হয়।

নদীর ভাঙনের সঙ্গে সঙ্গে ঘর হারানো, নতুন বসতির সন্ধানে কৃষিজমির দিকে গ্রাম বসানো এই সব সম্প্রদায় ক্রমে বিচ্ছিন্ন হতে থাকে নিজেদের ভাষা-সংস্কৃতি থেকে। চর তাই একটা অভিশাপ, একটা নতুন চর জেগে ওঠা মানে বেঁচে থাকা গ্রামের মৃত্যু। দয়ালহরি যখন তাঁর উপন্যাসে অভিশপ্ত চর আর কামারপাড়া গ্রামের হারিয়ে যাওয়ার কথা লেখেন, তখন তিনি বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া এক ভূগোলকে, প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের যন্ত্রণাময় সংলাপকে ধরে রাখেন। উপন্যাসে ব্যবহৃত অনেক শব্দ, যারা সেই ভূগোলকে চেনায়, তাদের আমরা বুঝতে পেরেছিলাম সরেজমিনে পর্যবেক্ষণে। উপলব্ধি করেছিলাম, উপন্যাস পাঠে এ হয়ে উঠতে পারে এক নতুন পাঠপদ্ধতি। যে অঞ্চল বা সম্প্রদায় সম্বন্ধে চট করে প্রচুর তথ্য পাওয়া যায় না বা হাতের কাছে বইপত্র মেলে না, তার সাহিত্য বুঝতে সাহিত্যের ভূগোল অনুসন্ধান অতি জরুরি। লেখক ও উপন্যাসের চরিত্রের সঙ্গে এতে পাঠকের আত্মিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে, আখ্যানে প্রতিফলিত যন্ত্রণার অনুভব পাঠক কিছুটা হলেও পেতে পারেন। বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে প্রান্তিক ভাষা-সাহিত্যের পাঠ, অনুবাদ ও গবেষণার পরিসর তৈরিতে এই সাহিত্যিক ভূগোল পাঠ জরুরি এক পদ্ধতি হয়ে উঠতে পারে। উচ্চশিক্ষায় অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতি, বিদ্যায়তনিক-সামাজিক দায়িত্ব পালনের পথেও এ একটা বড় ধাপ।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

language Chota Nagpur Plateau Chota Nagpur Chhattisgarh River Erosion

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে আপনার সাবস্ক্রিপশন আপনাআপনি রিনিউ হয়ে যাবে

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।