E-Paper

তিনি নিজেই একটি ঘরানা

সলিল এমন একটি ধারা তৈরি করলেন, যেখানে তাঁর গান শুনেই বলে দেওয়া যায়, ‘এটা সলিল চৌধুরী’। তাঁর গানের প্রতিটি মোড়, প্রতিটি বাঁক একদম সম্পূর্ণ ভাবে আলাদা।

দেবজ্যোতি মিশ্র

শেষ আপডেট: ১৬ নভেম্বর ২০২৫ ০৫:২৫

একটি তারার মৃত্যু হয়েছে বহু আগে— কিন্তু তার সব আলো এখনও এসে পৌঁছয়নি পৃথিবীর বুকে। যত ক্ষণ আলো, তত ক্ষণ অমর থাকবে সেই তারা। কেন জানি না মনে হয়, সঙ্গীতজগতের সেই মহাজাগতিক তারকার নাম সলিল চৌধুরী। তাঁর থেকে উৎসারিত আলোয় এখনও তরুণ প্রজন্ম পথ দেখে, অগ্রসর হয়। ১৯৯৫-এ সত্তর বছর বয়সে তাঁর প্রয়াণের পরেও জন্মেছেন সলিল চৌধুরীর এক-এক জন একলব্য। তাঁরা ভারতব্যাপী ছড়িয়ে আছেন; বিশ্বব্যাপীও। তিনি স্মৃতি নন— খুব রকম বর্তমান।

সাঙ্গীতিক যাত্রাপথে রবীন্দ্রনাথ যদি একটা জংশন হন, তা হলে পরের জংশনটি সলিল চৌধুরী। রবীন্দ্রনাথের সমসাময়িক ও তাঁর পরবর্তী কালের মহীরুহরা শিরোধার্য, কিন্তু যদি একটা ‘ডিপার্চার’-এর কথা বলি— চিন্তাভাবনার ক্ষেত্রে নতুন পথে হাঁটা, শুধুমাত্র গান বা কবিতা নয়, সামগ্রিকতার নিরিখে— সেখানে সলিল চৌধুরী আর সবার থেকে আলাদা। মিউজ়িক অ্যারেঞ্জমেন্ট তাঁর শ্বাস-প্রশ্বাসের স্বাভাবিকতার মতো। ইন্টারল্যুড-প্রিল্যুড, গানের গা বেয়ে তার শাখানদী উপনদীর মতো বেয়ে আসে যে সব কাউন্টার পার্টস অবলিগেটো, তা সবই সলিল চৌধুরীর তৈরি। এখানে এসে জড়ো হয়েছে বাখ, বেঠোফেন, মোৎজ়ার্ট-এর সঙ্গীতচেতনা। জড়ো হয়েছে পদাবলি, কীর্তন, বাংলার লোকসঙ্গীত, ভারতের লোকসঙ্গীত। সলিলের সঙ্গীতে তাদের অস্তিত্ব চেনা যায় বিলক্ষণ, কিন্তু শ্রোতা অবধারিত ভাবে বুঝতে পারেন— সে সব সুর নিজেদের স্বতন্ত্র পরিচয়ে নয়, এখানে সমবেত হয়েছে সলিলপ্রবাহে মিশে যাওয়ার জন্য।

সলিলের শতবর্ষে তাঁর সৃষ্ট কিছু গানের বয়সও ৭৫-৮০ পেরিয়েছে। সে সব গানও কিন্তু নতুন প্রজন্মকে পথে নামার গানের মতো ডাক দেয়। আবার একই সঙ্গে ‘সাত ভাই চম্পা’র মতো গানও রয়েছে, যার সুরের গা বেয়ে চলে কত অজস্র বাঁকবদল, ভাবনাচিন্তার বদল! একটা ব্যান্ডপার্টি বাজিয়ে চলে যেতে পারে ‘সাত ভাই চম্পা’। বাজায়ও তো। এত সাবলীল এই সুরের চলন যে, স্বচ্ছ আলোর মতো গানটিকে দেখা যায়। এক বার শুনলেই মনে থেকে যায়— বহু বার গাইতে ইচ্ছা করে, শুনতে ইচ্ছে করে। অথচ, অজস্র বার শোনার পরও মনে হয় না যে, এ বহু চেনা। অথবা ‘দুরন্ত ঘূর্ণি’র ইন্টারল্যুড প্রিল্যুড যে একটা দুরন্ত ঘূর্ণির ঝাঁকুনি দিয়ে যায়, তা কি কখনও পুরনো ঠেকে? তালিকা বানাতে বসব না, কারণ তা শেষ হবে না।

হিন্দিতে ‘জ়িন্দেগি ক্যায়সি হ্যায় পহেলি’ আর ‘না জানে কিউঁ’— এই দুটো গানে কয়্যার-এর ব্যবহার দেখুন— ক্যাথিড্রাল থেকে শিল্পীরা এসে গেয়েছিলেন এই অংশটুকু। হিন্দি গানে এই কয়্যারের ব্যবহার কিন্তু সলিল শুরু করেননি— সি রামচন্দ্র থেকে শঙ্কর-জয়কিষণ, অনেকের গানেই তা রয়েছে। উদাহরণ, লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া কালজয়ী ‘আজিব দাস্তাঁ’। কিন্তু সলিল চৌধুরীর কাছে এসে তারা আর শুধুই ওয়েস্টার্ন কয়্যার থাকল না, তার সঙ্গে মিশল ভারতের নিজস্ব সঙ্গীতের ধারা। এই মিলেমিশে যাওয়াটা একটা দিকচিহ্ন— সলিলের স্বাক্ষর। সময়ের ঢেউ সেই স্বাক্ষরকে কত দূরে বহন করতে পারে, তা দেখার।

সলিল নিজেই একটি ঘরানা। এই ঘরানা কত দূর পর্যন্ত থাকবে, সেটাই তো আমার প্রশ্ন। আজকের ভাল লাগা দিয়ে শুধু নয়। সলিলের বহু গান আছে, যা ১৯৬০ থেকে আজ অবধি সমান জনপ্রিয়। কিন্তু জনপ্রিয় শুধু একটি গান হলেই তো চলে না। এ তো সঙ্গীত সভ্যতার মশাল-দৌড়— এক প্রতিভা থেকে মশাল যাবে তাঁর উত্তরসূরির কাছে। কোনও তরুণের সঙ্গীতে অবচেতনে ফুটে উঠবে সলিলের একটি কর্ড প্রোগ্রেশন, যে কর্ড প্রোগ্রেশন হয়তো সলিলের কাছে এসেছিল বাখ-এর কাছ থেকে। হয়তো বা এক বিশেষ মিউজ়িক্যাল ফিলার, যা মনে করিয়ে দেবে সলিল চৌধুরীকে। বা, হয়তো এখনই মনে করাবে না— হয়তো বহু পরে আর জানাও যাবে না যে, ঠিক কোথা থেকে সেই ধারাটি এসেছিল। সলিল চৌধুরী ঠিক এমন ভাবেই মিশে যাবেন সাঙ্গীতিক মননে।

মালয়ালি গানে যেমন তিনি আছেন। চেম্মিন নামক ছবিটির মধ্যে দিয়ে তিনি বদলে দিয়েছিলেন মালয়ালম ছবির সঙ্গীতের ধারা। কাজটা সহজ ছিল না। তিনি এমন সুর করলেন, যার ছন্দ-তাল কাঠামো মালয়ালি সঙ্গীতের নয়। তাতে কথা বসাতে গিয়ে মালয়ালি গীতিকাররা বাধ্য হলেন তাঁদের ভাষার পরিচিত গীতিকাঠামো থেকে সরে আসতে, নতুন কাঠামোয় গান লিখতে। তা মালয়ালি শ্রোতাদের কানে নতুন লাগল; ক্রমে পরিণত হল ভাল লাগায়; এবং, সেখান থেকে দাঁড়িয়ে তা বহু দূর পর্যন্ত এমন এগিয়ে গিয়েছে যে, আজকের কোনও মিউজ়িক্যাল রিযালিটি শো-তে সলিল চৌধুরীর নামাঙ্কিত একটি পর্ব থাকতেই হয়।

প্রকৃত সঙ্গীত এক সময় স্রষ্টাকে ছাড়িয়ে মিশে যায় গানের জল-মাটি, আলোহাওয়ায়। জয়দেব কিংবা বিদ্যাপতি, বা চণ্ডীদাস, জ্ঞানদাসের সঙ্গীতের ধারা তো আমরা জানতে পারি না। কিন্তু, বুঝতে পারি কীর্তনের ধারায় অনেক অনেক রাগরাগিণী ছিল। সেই কাঠামো এখন বিস্মৃত, কিন্তু বা‌ংলার জল-মাটিতে মিশে গিয়েছে সে সব। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় যখন ‘আষাঢ় শ্রাবণ মানে না তো মন’-এর সুর করেন, তখন তার মধ্যে কীর্তন-লোকগান এই সমস্ত মিলেমিশে যায়। তখন কি আমরা জানতে পারি যে, পদাবলির কোন ধারাটি এসে মিশেছে? কিন্তু, মিশে গিয়েছে তা সত্যি। কেমন ভাবে মিশেছে, ঠিক ভাবে বলতে পারা যায় না। সলিলও এ ভাবেই থাকবেন ভারতের সুরে।

‘না যেয়ো না’ গানটির প্রথম সুরের ঠিক পরেই যে গৎটি বাজে, শুনেছি উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ নাকি বলেছিলেন, “সলিল চৌধুরী এই গৎ পাইল কী কইরা?” বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন পণ্ডিত রবিশঙ্করও। ওই গৎ আসলে ছিলই । কিন্তু এই গানে এ ভাবে প্রয়োগটা সলিলের নিজস্ব সিগনেচার। এ রকম বহু গানে বহু রকম ভাবে ঝলসে ওঠেন সলিল। ‘শোনো, কোনও এক দিন’ গানটি যেখান থেকে শুরু হয়, সেখানে থেমে থাকে না— তার স্কেল পাল্টায়। সেখান থেকে দাঁড়িয়ে আবার আর এক জায়গায় যায়, ফের স্কেল পরিবর্তন। সেই পরিবর্তনটা কিন্তু পাশ্চাত্য সঙ্গীতের কাঠামো মেনে, পাশ্চাত্য ভঙ্গিতে হয়। কিন্তু সম্পূর্ণ ভাবে একটি বাংলা গানের মধ্য দিয়েও যে হয়, তা এর আগে কেউ ভাবতেই পারেনি। এ রকম বহু ঘটনা।

সলিল যখন বম্বের সঙ্গীত জগতে এলেন, তখন সেখানে দিকপালরা কাজ করছেন। কিন্তু সলিল এমন একটি ধারা তৈরি করলেন, যেখানে যে কোনও মুহূর্তে যে কোনও জায়গায় তাঁর গান শুনে বলে দেওয়া যায়, ‘এটা সলিল চৌধুরী’। তাঁর গানের প্রতিটি মোড়, প্রতিটি বাঁক একদম সম্পূর্ণ ভাবে আলাদা। গান যদি শুরু হয় এক জায়গায়, ইন্টারল্যুডে একেবারে অন্য কোথাও চলে যেতে পারে। এই যে মোড়ে মোড়ে আকস্মিকতা অপেক্ষা করে রয়েছে— এটা সলিল চৌধুরীর সঙ্গীতভাবনার অংশ। তাঁর সৃষ্টি জীবনের গল্প বলছে। জীবন যে আসলে মৃত্যুর চেয়ে অনেক বড়, সে কথা বলতে বলতে চলেছে। তাঁর কয়্যার আমাদের মনে করিয়ে দিতে পারে বেঠোফেন-এর নাইন্থ সিম্ফনি ‘ওড টু জয়’-এর কথা, জীবনই যেখানে উদ্‌যাপনের মূল বিষয়। এই কয়্যারের মধ্যেও সেই হারমনিক প্রোগ্রেশনগুলো ব্যবহৃত হয়েছে যা বাখ কিংবা মোৎজ়ার্ট হয়ে বেঠোফেন-এ এসে পৌঁছেছে। এই সঙ্গীত মানবজাতির জন্য, জীবনের জন্য। যা মৃত্যুর বিরুদ্ধে, হেরে যাওয়ার বিরুদ্ধে লড়াই।

‘পথে এ বার নামো সাথী’ গানটির কথা ভাবুন। মার্চ-এর ছন্দ প্রত্যক্ষ ভাবে শুনতে পাচ্ছি এই গানে। মানুষকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা বলা হচ্ছে। গানটার মধ্যে একটা টানাপড়েন আছে— পথে কী হবে, তা জানা না-থাকার মানসিক অবস্থা। এই টেনশন তৈরি করতে সলিল এমন কতকগুলো হারমনিক প্রোগ্রেশন ব্যবহার করছেন, যা এর আগে কখনও ঘটেনি, এমনকি সলিলের নিজের গানেও নয়। এতে এমন কতকগুলো হারমনিক প্রোগ্রেশন আছে, যা সমানে এগিয়ে নিয়ে যায়, আবার পিছিয়ে নিয়ে আসে— সেই এক পা এগোনো দু’পা পিছোনোর কৌশলের মতো এই হারমনিক প্রোগ্রেশনগুলোর মধ্যে একটা জায়গা আছে। জনস্রোতের নানান মতে মনোরথের ঠিকানা-র পর একটা কর্ড ব্যবহার হচ্ছে, যার মধ্যে কাজ করছে এক অমোঘ অনিশ্চয়তা। ব্যাকরণগত ভাবে এই কর্ডটি এক বার এগোচ্ছে আবার পিছিয়ে আসছে ‘আ-আ-আ-আ’ বলে। এই কর্ড তাঁর মাথায় এসেছে শুধুই কি সাঙ্গীতিক ভাবে, না কি তাঁকে ভাবিয়েছিল মানুষের ইতিহাস? এমনই কর্ড কিন্তু আগে আমরা শুনেছিলাম বেঠোফেন-এর ‘ফিফথ্‌ সিম্ফনি’তে। বাখের টোকাটা ফিউগ-এর ডি মাইনর মোৎজ়ার্ট থেকে বেঠোফেন হয়ে যখন ভারতের এক সুরকার তাঁর ভাবনায় চিন্তায় জারিত করলেন তাঁর ‘পথে এ বার নামো সাথী’। এই সুর একটা নাগরিক বিপ্লবের মতো। মানুষকে সমবেত করবার জন্য গানটি তৈরি হল এই হারমনিক প্রোগ্রেশনগুলো দিয়ে ।

আমরা কোনও এক দিন হয়তো এই হারমনিক প্রোগেশনই আবার এক নতুন প্রজন্মের কাছে পাব। সেটা হয়তো অন্য রকম ভাবে হবে। এক ঝাঁক উজ্জ্বল পায়রা ঠোঁটে করে আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে দেবে সলিলের সুর। সেই সুর বহু দূর হেঁটে যাবে মানুষের মন থেকে মনে। তাঁর সৃষ্টি থেকে যাবে সে দিনও। কারণ, সেই সৃষ্টির কেন্দ্রে যে রয়েছে মানুষ। মানুষের কথা মানুষ বলবে। আর সলিল চৌধুরীর গানই হয়ে উঠবে সেই কালোত্তীর্ণ মানব সংলাপ।

তিনি তো এটুকুই চেয়েছিলেন। ‘ওগো আর কিছু তো নয়’।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

music Music Director lyricist Singer

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy