অগস্ট স্বাধীনতা লাভের মাস; বিশাখা গাইডলাইনস লাভেরও। বাল্যবিবাহ-বিরোধী সরকারি প্রচারে নিযুক্ত ছিলেন রাজস্থানের ভাতেরি গ্রামের ‘সাথিন’ ভাঁওরি দেবী। ১৯৯২ সালে গুজ্জরদের শিশুকন্যার বিয়ে আটকে দেওয়ার ‘শাস্তি’-স্বরূপ গণধর্ষিতা হন। গণধর্ষণের মামলার পাশাপাশি ‘বিশাখা’-সহ বেশ কিছু অসরকারি সংস্থা ভারতীয় সংবিধানেরই ১৪, ১৫ ও ২১ নম্বর ধারাকে খুঁটি করে যৌন হেনস্থা থেকে কর্মরতাদের সুরক্ষার দাবিতে জনস্বার্থ মামলা দায়ের করে। তার সূত্র ধরেই কর্মরতা মেয়েদের কর্মস্থলে যৌন নির্যাতন প্রতিরোধে নতুন আইনের প্রয়োজনের কথা স্বীকার করে সুপ্রিম কোর্ট। আদালত সে আইন তৈরির গাইডলাইনস দেয় ১৯৯৭ সালের ১৩ অগস্ট। ‘কনভেনশন অন দি এলিমিনেশন অব অল ফর্ম অব ডিসক্রিমিনেশন এগেনস্ট উইমেন’-এর দ্বারা নির্ধারিত আন্তর্জাতিক নীতিমালা অনুসৃত হল সেই গাইডলাইনস তৈরিতে। আইন তৈরি হতে অবশ্য লেগেছিল আরও ১৬ বছর। দিল্লির নির্ভয়া কাণ্ডের পর সে আইন এল, ‘প্রোটেনশন অব উইমেন এগেনস্ট সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট, ২০১৩,’ বা ‘পশ’।
আর জি কর কাণ্ডের পর এ রাজ্যে লিঙ্গরাজনীতির আন্দোলন বার বার প্রশ্ন তুলেছিল: কর্মক্ষেত্রে কি ইন্টার্নাল কমপ্লেন্টস কমিটি (আইসিসি) সক্রিয়? পশ আইন কি আদৌ মানা হচ্ছে? হাসপাতালে নির্যাতক-বান্ধব পরিবেশ ছিল না কি? বছর ঘুরতে কসবা ল কলেজের ঘটনায় দেখা গেল, আইসিসি সক্রিয় থাকলে মূল অভিযুক্তের অনেক আগেই ক্যাম্পাসে প্রবেশ বন্ধ হওয়ার কথা ছিল, কারণ সে বার বার একই অপরাধ করেছে।
২০২৩ সালে পশ আইনের প্রয়োগসংক্রান্ত এক মামলা প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্ট বলেছিল, পশ আইন প্রণয়নের দশ বছরের পরেও প্রয়োগে আছে বিশাল ফাঁক। সংগঠিত কর্মক্ষেত্রে আইসিসি কাজ করছে না, অসংগঠিত কর্মক্ষেত্রে যৌন নিগ্রহ আটকাতে যে লোকাল কমপ্লেন্টস কমিটির (এলসিসি) কথা বলা হয়েছিল, তা গঠনই হয়নি বেশির ভাগ জেলায়। সুপ্রিম কোর্ট সময় বেঁধে দিয়েছিল— ২০২৫-এর এপ্রিলের মধ্যে আইসিসির সক্রিয়তা বিষয়ক রিপোর্ট পেশ করতে হবে, জানুয়ারি ২০২৫-এর মধ্যে এলসিসি গঠন সম্পূর্ণ করতে হবে, শি-বক্স পোর্টাল চালু করতে হবে ইত্যাদি। কোনও রাজ্যেই চিত্র সন্তোষজনক নয়, কিন্তু এই মামলার ফলে নানা রাজ্যে খানিক শোরগোল পড়েছিল।
সত্তোরোর্ধ্ব ভাঁওরি দেবীকে সারা পৃথিবী সম্মান করলেও নিজের গ্রামে তিনি এখনও এক রকম একঘরে। আন্দোলন, আন্দোলনপ্রসূত আইন আর সমাজবাস্তবতার ফারাক তাই তিনি জীবন দিয়ে জানেন। আর জি কর-কাণ্ড তথা কর্মক্ষেত্রে যৌন সুরক্ষা প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে বললেন, “শুধু নিজের জন্য নয়, সবার সুরক্ষার জন্য লড়েছিলাম। অথচ আজও সরকারি জায়গায় আইনটা ঠিকমতো চালু হতে দিল না।” রাজস্থানের ‘বিশাখা’ সংস্থার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও কর্ণধার ভরত বললেন, পশ আইনকে সরকারি-বেসরকারি নির্বিশেষে সব কর্মক্ষেত্রে পুরুষবিরোধী আইন ভাবা হয়। ঘাড় ধরে প্রয়োগে বাধ্য না করলে তাকে অকার্যকরই রাখা হয়। তাঁর মতে, ঘাটতি রয়েছে তিনটি ক্ষেত্রে: প্রশিক্ষণ, ব্যয়বরাদ্দ, এবং সচেতনতা প্রসার। কিন্তু ২০২৪ সালের পর পরিস্থিতি খানিক বদলেছে। কালেক্টর অফিসে ডাক পড়ছে ‘বিশাখা’-সহ নানা অসরকারি সংস্থার, যাতে সরকারি কর্মচারীদের পশ প্রশিক্ষণ দেওয়া যায়। ভাঁওরি দেবী যে সংস্থার স্বেচ্ছাসেবী, সেই ‘জনসাহস’-এর সঙ্গীতাও বললেন, মধ্যপ্রদেশ ও রাজস্থানের কিছু জায়গায় ২০২৪ সাল থেকে পশ, শি-বক্স ইত্যাদি নিয়ে সচেতনতা প্রসারের দায়িত্ব তাঁরা পেয়েছেন।
অথচ, পশ্চিমবঙ্গে সরকারি মহলের ঘুম ভাঙেনি। সরকারি কলেজ-হাসপাতালের ডাক্তারি পড়ুয়া ও নার্সদের থেকে জানা গেল, আইসিসির অস্তিত্ব সম্পর্কে এখনও প্রচার নেই। আইসিসির গঠন, সদস্যদের নাম, যোগাযোগের নম্বর সম্বলিত বোর্ড এখনও দেখা যাচ্ছে না। সরকারি অফিসের কর্মচারীদেরও একই বয়ান। ডাক্তারি কলেজের মতো অনেক সাধারণ কলেজেও আইসিসি আছে, কিন্তু তাদের অস্তিত্ব জানতে দেওয়ার জন্য ডিসপ্লে বোর্ড বা ওয়েবসাইটে প্রদর্শন নেই। সরকারি স্কুলে নিয়ম মেনে নোটিফিকেশন গিয়েছিল, আইসিসি গঠনও হয়েছে। কিন্তু কর্মীরা কি জানেন যে, কী কী করলে বিশাখা গাইডলাইনস অনুযায়ী তা যৌন নির্যাতন? কোন পরিস্থিতিতে কী ভাবে কার কাছে যেতে হবে? না। আর অসংগঠিত কর্মীরা? আশাকর্মী, গৃহপরিচারিকা, ইটভাটার শ্রমিক, নির্মাণশ্রমিক— সবাই জানেন, যৌন অত্যাচার মেনে নিতে হয়!
বেসরকারি তথা কর্পোরেট ক্ষেত্রে চিত্র অপেক্ষাকৃত আশাপ্রদ। পশ ট্রেনিং, ওয়েবসাইট ও পোস্টারিং, ডিসপ্লে বোর্ড দেখা যায়। তাদের আছে নন-কমপ্লায়েন্সের কারণে লাইসেন্স বাতিল বা বিনিয়োগ বন্ধের ভয়। অবাক হওয়ার পালা কিছু অসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার ক্ষেত্রে। সেখানে সুগঠিত আইসিসি নেই, বা তার প্রচার এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে— এমন নজিরও মিলছে বাংলায়।
সামগ্রিক ভাবে, পশ্চিমবঙ্গে এখনও সংখ্যাগুরু কর্মরতা বা ছাত্রী পশ আইনের গুরুত্ব জানেন না। জানতে দেওয়া হয়নি। আইনি অধিকার না জানলে বঞ্চনার ধারণাও মাথায় আসে না। সরকারি জায়গায় আইসিসি যদি বা কোনও ঘটনায় ক্রিয়াশীল হয়, সদস্যরা অপ্রশিক্ষিত হওয়ায় জানেন না যে, ভুক্তভোগীর সঙ্গে কোন ব্যবহার সমীচীন। ক্ষমতাবান কেউ অভিযুক্ত হলে রায় পক্ষপাতদুষ্ট হতে পারে। সদস্যদের অনেকের মাথায় গেঁথে থাকে নির্যাতিতাকে দোষারোপ করার প্রবণতা। আইসিসির ক্ষমতা সিভিল কোর্টের সমান। অপ্রশিক্ষিত ও অসংবেদনশীলের হাতে দায়িত্ব পড়লে এ ক্ষেত্রে উপকারের চেয়ে অপকারের সম্ভাবনা বেশি।
কর্মক্ষেত্রে বা শিক্ষাক্ষেত্রে একটি ধর্ষণ শুধু ধর্ষণের ভয় বাড়িয়ে দেয় না। ক্ষেত্রগুলিতে মেয়েদের জমি হারানোর ভয়ও বাড়ায়। প্রতিকারের প্রয়োজনীয় আইন থাকা সত্ত্বেও সে আইন প্রয়োগে তৎপর না হয়ে যখন অপরাজিতা বিল সংক্রান্ত চাপান-উতোর চলতে থাকে, তখন সরকারি সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন জাগে। ভাঁওরি দেবীর দীর্ঘশ্বাস ধ্বনিত হয়, “একটা গোটা জীবন কেটে গেল। তাও…”।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)