অভয়মাঝে: রাজপথে প্রতিরোধের বহমান মুখ, ১১ সেপ্টেম্বর। ছবি: পিটিআই।
আশ্চর্য সমাপতন! ১৯৪৭-এর ৯-১৪ অগস্ট গান্ধী সোদপুরে সত্যাগ্রহে বসেছিলেন— চতুর্দিকে বিভাজন ও বিদ্বেষের মোকাবিলার জন্য; চেতনার মন্থন ও বিবেকের জাগরণের জন্য; ‘সত্য’-এর ব্যক্তিগত উপলব্ধিকে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য। খুব সফল হয়েছিলেন বলা যায় না। দেশভাগের পরেও অব্যাহত ছিল সাম্প্রদায়িক হানাহানি। এ বছর ৯-১৪ অগস্ট ফের চেতনার মন্থন ও বিবেকের জাগরণ হল, সঙ্গে গান্ধী-কাঙ্ক্ষিত ‘অভয়’-এরও জাগরণ। এ এক স্বতঃস্ফূর্ত জনজাগরণ— যে-যার আত্মশক্তির উদ্বোধনের ভিত্তিতে, পরস্পরকে শক্তি জুগিয়ে। এক তরুণী চিকিৎসকের নৃশংস হত্যার প্রতিবাদ শুধু নয়, শুধু মেয়েদের নিরাপত্তার দাবি নয়— যদিও ১৪ অগস্ট মেয়েদের উতরোল রাত দখলে এই বিষয়টাই পুরোভূমিতে ছিল এবং রইল— তার সঙ্গে জুড়ে গেল দুরাচার ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধের সঙ্কল্প।
লড়াই জারি এখনও। অনেক বছর ধরে যারা হাসপাতালে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, অফিসে, পাড়ায়, চাকরির নিয়োগে, ব্যবসাক্ষেত্রে অনেক অন্যায় সয়েছে, আপস করেছে, এমনকি হয়তো শাসক-পোষিত কর্তৃপক্ষের কাছটি ঘেঁষে অল্পবিস্তর সুবিধেও নিয়েছে, যারা অন্যায়ের প্রতিবাদ করে হেনস্থা হয়েছে তারা তো বটেই— সবাই আজ বিবেকী প্রতিবাদী। অনেকেরই মনে পড়ছে নিজের লাঞ্ছনা বঞ্চনার কথা, তাই হয়তো নিহত মেয়েটিকে এত আপন মনে হচ্ছে। তাই আজকের লড়াইটা প্রত্যেকের নিজের, সবার এবং সামগ্রিক। সার্ত্রর ভাষায় বলতে গেলে, একটা ‘ফিউজ়ড গ্রুপ’— যেন এক ‘এগজ়িসটেনশিয়াল হিরো রিট লার্জ’— লড়াই করছে ‘কমন ফ্রিডম’-এর জন্য। স্বৈরাচারী কর্তৃত্ববাদ, অনাচার, দুর্বৃত্তায়ন— যা আজ বহুস্তরে ব্যাপ্ত বন্দোবস্ত— তা থেকে মুক্তির জন্য। আন্দোলনকারীরা গান্ধীর নাম নেয়নি, কিন্তু গান্ধী থাকলে খুশিই হতেন।
চিকিৎসকরা আন্দোলনের কেন্দ্রে। অথচ অনেক বছর ধরেই চিকিৎসকদের অর্থলোলুপতা আর রোগীর প্রতি উদাসীনতা নিয়ে সমাজে ভূরি ভূরি অভিযোগ। মুনাফালোভী ‘হেলথ ইন্ডাস্ট্রি’তে তো বটেই, সরকারি হাসপাতালেও ডাক্তারদের ‘টাউট’ লাগিয়ে রোগীকে নিজের চেম্বারে ধরে নিয়ে যাওয়া, ওষুধ কোম্পানির সঙ্গে যোগসাজশ ইত্যাদি জানা ছিল। অবশ্যই স্বাস্থ্যক্ষেত্রে ভাল ডাক্তারদের নিষ্ঠা, সততাও ছিল। আজ অশুভ শক্তিকে কোণঠাসা করে সেটাই প্রবল আকার নিয়েছে। সর্বত্রই কি এমন শুভশক্তির আত্মঘোষণা? আন্দাজ করি, কিছুটা নিশ্চয়ই। ঠিকই, এই আন্দোলনে নানা রকম মানুষজন আছেন। এমনকি হয়তো কিছু শাসক-ঘনিষ্ঠও রাজনৈতিক সঠিকতার তাগিদে আন্দোলনরত। রাজনৈতিক দলগুলির ফয়দা লোটার উৎসাহ তো আছেই। কেউ কেউ আবার আন্দোলনকে হিংস্রতার দিকে নিয়ে যেতে চান। হোয়াটসঅ্যাপে ভাইরাল মেসেজ— মেয়েটির হত্যাকারীদের অধিকাংশই মুসলমান। আর যতই স্বতঃস্ফূর্ত জন-আন্দোলন হোক, বিনোদন জগতের মানুষদের উপর ফোকাস করে মিডিয়া সেলেব-সংস্কৃতিও অক্ষুণ্ণ রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে। উৎসবে ফেরার জন্যও নিশ্চয়ই অনেকের প্রাণ আনচান করছে। সমাজ-মন কি রাতারাতি বদলাতে পারে?
আন্দোলনের সীমাবদ্ধতা প্রসঙ্গে আরও শোনা যাচ্ছে যে, এ হল নিছক শহুরে মধ্যবিত্তদের আন্দোলন। গ্রামের দিকে এর প্রভাবের কথা সত্যি জানি না। এক ছাত্র— বর্ধমানের এক গ্রামের বাসিন্দা এবং বাঁকুড়ার গ্রামাঞ্চলের কলেজে পড়ান— বললেন, সেখানে কোনও প্রভাব তিনি দেখেননি। বরং শাসক দল মিছিল বার করে বোঝাবার চেষ্টা করেছে, তাদের প্রতি কী অন্যায়টাই না হচ্ছে! তাদের দাপটও অব্যাহত। হতাশা প্রকাশ করলেন, “গ্রাম থেকেই তো শাসক দলের ভোট আসে।” কিন্তু গ্রামের মানুষের বঞ্চনা তো কম নয়৷ লক্ষ্মীর ভান্ডার সেই বঞ্চনার বোধকে কতটা প্রশমিত করতে পারে, বিশেষ করে আজকে এই মুহূর্তে? গ্রাম কি শহর থেকে এতই বিচ্ছিন্ন, এই বিশ্বায়নের যুগেও? না কি ‘পার্টি সোসাইটি’তে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা অতিষ্ঠ অসহায় গ্রামবাসীরা মুক্তির সুযোগের প্রতীক্ষায়?
শহরের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, মধ্যবিত্তরা যতই নিজেদের নিয়ে আন্দোলন করুক, তলার দিকেও কিন্তু এর মেজাজ অনেকটা চারিয়ে গেছে। সে দিন স্বাস্থ্যভবনের সামনে আন্দোলনরত ডাক্তারদের জন্য আমরা কিছু রসদ নিয়ে যাচ্ছিলাম। ব্যারিকেডের জন্য সে সব রিকশায় চাপিয়ে হেঁটে যেতে হল ‘প্রোটেস্ট সাইট’-এ। রিকশাওয়ালাকে ভাড়া দিতে গেলে তিনি নিলেন না৷ বললেন, এ তো তাঁরও আন্দোলন। কী জানি, ওঁকে কি রোজ রিকশা বার করার জন্য তোলা দিতে হয়! সে দিনেরই আর একটি ঘটনা। এক জায়গায় টিকিট ছাড়া অন্যায় ভাবে পার্কিং ফি চাওয়া হলে আমাদের গাড়ির চালক ধমকে উঠলেন, “এত দিন যা হয়েছে, হয়েছে; আর এ সব চলবে না।” এঁদের ক্ষেত্রে প্রতিবাদকে কিছুতেই মধ্যবিত্তের হুজুগে ‘ওকিজ়ম’ বলা যাবে না। সমাজে শ্রেণিভেদ, জাতিভেদ ইত্যাদি অন্যায়ের গভীর শিকড়কে এই আন্দোলন তো প্রশ্ন করছে না। তবুও এঁরা ‘কমন ফ্রিডম’-এর জন্য লড়াইয়ে শামিল, আমরা এঁদের আমাদের গর্বিত নাগরিক সমাজের অন্তর্ভুক্ত করি আর না করি।
বিহেভ বইটির রচয়িতা রবার্ট স্যাপলস্কির মতো স্নায়ুবিজ্ঞানীরা যন্ত্র নিয়ে মাপামাপির সুযোগ পেলে আজ আমাদের ‘নিউরোফিজ়িয়োলজিক্যাল ইকোসিস্টেম’-এ বিরাট পরিবর্তন দেখতে পেতেন— মস্তিষ্কে, শারীর-রসায়নে। স্যাপলস্কি দেখিয়েছেন, আধিপত্য, আনুগত্যের মতো প্রতিরোধও মানুষের পক্ষে স্বাভাবিক, বিশেষত তা যখন হয় অনেকে মিলে। ভীরু ছাপোষা মানুষ কী ভাবে হঠাৎ এক দিন বিদ্রোহী হয়ে ওঠে, তার স্নায়বিক ব্যাখ্যা আছে তাঁর বইতে। মূল ব্যাখ্যাটা অবশ্য শারীরিক ততটা নয়, যতটা সামাজিক-সাংস্কৃতিক। সমাজ আর সংস্কৃতিই তো অনেকাংশে শরীরকে চালনা করে। কিন্তু স্যাপলস্কির অন্য দু’-একটি কথাও প্রণিধানযোগ্য। বিদ্রোহ-সংশ্লিষ্ট শারীরিক পরিবর্তন কিন্তু চট করে ‘রিভার্সড’ও হতে পারে। তা ছাড়া, একই উৎস থেকে জন্ম নেয় আমাদের সবচেয়ে ভাল এবং সবচেয়ে খারাপ আচার-ব্যবহার। উদ্বেগ, অস্থিরতা, প্রতিরোধ মিলিয়ে যে শারীর-রসায়ন, তা অত্যাচারীর বদলে নিরীহকেও টার্গেট করতে পারে। মনে করুন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঠিক পরেই ব্রিটিশের বিরুদ্ধে, সব রকম অত্যাচারীর বিরুদ্ধে ‘বিদ্রোহ চারিদিকে’— সবই হিন্দু-মুসলমানের যৌথ লড়াই। পরমুহূর্তেই কিন্তু নিজেদের মধ্যে দাঙ্গা। সুতরাং সাধু সাবধান!
এখন প্রশ্ন, এই জাগরণের মেজাজটা কী ভাবে ধরে রাখা যায়? মনে হয়, শেষ পর্যন্ত এটা মানুষ তৈরির প্রশ্ন। রাস্তার আন্দোলনের সঙ্গে ঘরের ও নিজের দিকে নজর দেওয়া দরকার— সংবেদনা, মূল্যবোধ বিকাশের লক্ষ্যে। যেমন, ছেলেকে মায়ের সচেতন করা দরকার— মেয়েদের মর্যাদার ব্যাপারে। কালীপুজোয় শব্দবাজির তাণ্ডবের বিরুদ্ধে কিংবা কর্মস্থলে (সরকারি/বেসরকারি) অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ— ডাক্তারদের অবস্থানমঞ্চে সঙ্গ দেওয়ার মতোই গুরুত্বপূর্ণ। দরকার লোভ সংবরণও। বিপুল বস্তুপুঞ্জ আর বিনোদনের আকাঙ্ক্ষাই (কখনও ক্ষমতালিপ্সাও) অনিয়ন্ত্রিত হলে সন্দীপ ঘোষদের তৈরি করে। পুনরপি গান্ধী স্মরণীয়— “পৃথিবীতে মানুষের প্রয়োজন (নিড) মেটানোর মতো সব কিছু আছে, লোভ (গ্রিড) মেটানোর মতো নয়।”
পাশাপাশি, যতই নিজেদের ‘অরাজনৈতিক’ বলি, আমাদের নির্বাচনমূলক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার কথাও আসতেই হবে। দুষ্প্রবৃত্তি, দুর্নীতি অনেকটা এই ব্যবস্থা দ্বারাই লালিত, সব রাজনৈতিক দল যার অংশ। এই ব্যবস্থার মধ্যেই আমাদের থাকতে হয়। শাসকের হৃদয় পরিবর্তনের গান্ধীয় আশাবাদ অথবা প্রাতিষ্ঠানিক বিকল্প হিসেবে গান্ধীয় গ্রামস্বরাজ যদি অ-বাস্তবোচিত মনে হয়, আমাদের গৃহকর্ম-সহায়ক ছেলেটির প্রস্তাব বিবেচ্য। নানা আলোচনা শুনে সে বলল, “আচ্ছা দিদি, এমন হয় না যে একটা রাজনৈতিক দল পর পর একটা কি বড়জোর দুটোর বেশি নির্বাচনে দাঁড়াতে পারবে না?” আমরা লাফিয়ে উঠে বললাম, “দারুণ বলেছ! দাঁড়ালেও বিরোধী ভূমিকা পালনের জন্য। সে ভূমিকা গঠনমূলক হলে একটা টার্মের পরে আবার না-হয় ক্ষমতায় ফিরবে।” আমরা তো জানি, ‘অ্যাবসোলিউট পাওয়ার কোরাপ্টস অ্যাবসোলিউটলি’। অতএব একটি দলের মৌরসিপাট্টা— যা নানা কারণে আমাদের দেশে সহজেই কায়েম হয়— তা আটকানো জরুরি। এ কি নিতান্তই অসম্ভব? হোক না সর্বভারতীয় স্তরে নাগরিক সমাজের আন্দোলন, সাংসদদের উপর চাপ সৃষ্টি, দরকার হলে রেফারেন্ডাম!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy