গত ২৭ জুন ছিল মাইক্রো, স্মল অ্যান্ড মিডিয়াম এন্টারপ্রাইজেস (এমএসএমই) ডে— অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ দিবস। সারা পৃথিবী জুড়ে এই দিবস উদ্যাপিত হয়েছে, তবে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে এর তাৎপর্য আলাদা। এ রাজ্যে বড় মাপের বিনিয়োগ কম আসছে, আপাতত ছোট এবং মাঝারি উদ্যোগই ভরসা। বিশেষ করে কর্মসংস্থানের নিরিখে ছোট ও মাঝারি উদ্যোগের বিকল্প নেই। তাই পশ্চিমবঙ্গের উন্নয়নে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগের ভূমিকা নিয়ে কিছু চিন্তা-ভাবনার অবকাশ আছে। মূল প্রশ্ন একটাই— যদি বড় বিনিয়োগ ততটা না হয়, শুধু ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগের উপরে নির্ভর করে পশ্চিমবঙ্গ কতটা উন্নতি করতে পারবে? এমন কোনও রাজ্য ভারতে আছে কি, যেখানে নিকট অতীতে বড় বিনিয়োগ না হওয়া সত্ত্বেও শুধুমাত্র ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগের মধ্য দিয়ে প্রভূত উন্নতি ঘটেছে?
ক্ষুদ্র এবং মাঝারি শিল্পের কাঠামোর দিক থেকে একটা সময় অবধি তামিলনাড়ুর সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের মিল ছিল। কিন্তু গত কয়েক দশকে পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় তামিলনাড়ুতে বড় বিনিয়োগ হয়েছে অনেক বেশি— সে রাজ্যের অটোমোবাইল হাব যার একটা উদাহরণ। ফলে তামিলনাড়ুতে অনেক অনুসারী শিল্প তৈরি হয়েছে, যা পশ্চিমবঙ্গে হয়নি। তাই তামিলনাড়ুর সঙ্গে তুলনা করছি না। দক্ষিণ ভারতের অন্য একটি রাজ্যের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের বেশ কিছু মিল আছে— অমিলও যে নেই, তা নয়। রাজ্যটির নাম কেরল। পশ্চিমবঙ্গের মতো কেরলেও বামপন্থীরা তিন দশকের বেশি রাজত্ব করেছেন, যদিও একটানা নয়। পশ্চিমবঙ্গের মতো কেরলেও উল্লেখযোগ্য ভাবে ভূমিসংস্কার হয়েছে। দু’রাজ্যেই অরণ্য-পাহাড়-সমুদ্র এবং খনিজ সম্পদ রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের মতো কেরলের বামপন্থী সরকারও নব্বই দশকের প্রথম ভাগ অবধি ব্যক্তিগত পুঁজি বা বেসরকারি উদ্যোগের ব্যাপারে সন্দিহান ছিল। নব্বই দশকের মধ্যভাগে সিপিএম তাদের শিল্পনীতি বদলাতে শুরু করে। মনে করতে শুরু করে যে, অর্থনৈতিক উন্নয়নে বেসরকারি পুঁজি এবং ব্যক্তিগত উদ্যোগের ভূমিকা আছে। এর প্রভাব পশ্চিমবঙ্গ এবং কেরল দু’টি বাম-শাসিত রাজ্যেই পড়েছিল।
উদার অর্থনীতির প্রয়োগ কিন্তু দু’জায়গায় দু’রকম হল। পশ্চিমবঙ্গে বাম সরকারের নীতিনির্ধারকরা বেসরকারি পুঁজি এবং বাজার অর্থনীতিকে স্বাগত জানালেন বটে, কিন্তু তাঁদের ঝোঁক গেল বড় বিনিয়োগের দিকে। বড় বিনিয়োগের দুটো সমস্যা। এক, বড় বিনিয়োগ মানে বড় প্রকল্প, যা রূপায়িত করতে একলপ্তে অনেকখানি জমি দরকার। পশ্চিমবঙ্গে মানুষের তুলনায় জমি অল্প, বড় প্রকল্পের জন্য জমি পাওয়া সহজ নয়। জমি জোগাড় করতে গিয়ে সরকারকে গায়ের জোরে অধিগ্রহণের চেষ্টা করতে হল। দ্বিতীয়ত, বড় বিনিয়োগ মানে পুঁজি-নিবিড় প্রযুক্তি, যেখানে সরাসরি কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা তুলনায় কম। যাঁরা জমি হারাচ্ছেন, তাঁদের মনে হল যে, শিল্প হলে তাঁদের কী লাভ? প্রশিক্ষণ বা শিক্ষা নেই, এমন কর্মপ্রার্থীদেরও একই কথা মনে হল। সব মিলিয়ে বড় বিনিয়োগের পিছনে দৌড়নোর রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক ফল কোনওটাই ভাল হয়নি। বামফ্রন্টকে ক্ষমতা হারাতে হয়েছে, টাটাদের গাড়ির প্রকল্প মাঝপথে থেমে গেছে। ভবিষ্যতে বড় বিনিয়োগ আসার সম্ভাবনাও ব্যাহত হয়েছে।
কেরলের ছবিটা একেবারে আলাদা। শিল্পনীতি বদলে যাওয়ার পরে বৃহৎ পুঁজি নয়, কেরলের শিল্পায়ন ঘটল ছোট ও মাঝারি বেসরকারি উদ্যোগের মাধ্যমে। কিছু সনাতন উদ্যোগ তো ছিলই, যেমন চা, কফি, রবার, মশলাপাতি, কাজুবাদামের মতো বাণিজ্যিক কৃষি, বা মৎস্যচাষ। নতুন বিনিয়োগ সেই ক্ষেত্রগুলিতে প্রযুক্তির উন্নতি ঘটাল, উৎপাদনশীলতা বাড়াল। এর সঙ্গে যুক্ত হল আয়ুর্বেদ, স্বর্ণশিল্প, পর্যটন, স্বাস্থ্য পরিষেবা, তথ্যপ্রযুক্তি। কোনও উদ্যোগই খুব বড় নয়— কিছু মাঝারি, কিছু ছোট, কিন্তু প্রত্যেকটিই প্রতিযোগিতার বাজারে ভাল মুনাফা করার মতো দক্ষ। ছোট ও মাঝারি উদ্যোগের মধ্যে দিয়ে শিল্পায়নের ফলে কেরলে মানুষের ইচ্ছার বিরুদ্ধে জমি অধিগ্রহণ করতে হয়নি। অন্য দিকে, প্রচুর কর্মসংস্থান হয়েছে। সাধারণ মানুষ শিল্পায়নের ভাগীদার হয়েছেন। উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির ফলে রাজ্যে নিরবচ্ছিন্ন আয়বৃদ্ধি হয়েছে। ১৯৯০-৯১ সালে, যখন কেরল এবং পশ্চিমবঙ্গ দু’টি বামশাসিত রাজ্যেই বাজার অর্থনীতিকে সন্দেহের চোখে দেখা হত, তখন কেরলের মাথাপিছু আয় ছিল পশ্চিমবঙ্গের মাথাপিছু আয়ের তুলনায় ১৬% কম। ২০২১-২২’এ পৌঁছে কেরলের মাথাপিছু আয় পশ্চিমবঙ্গের দ্বিগুণেরও বেশি হয়ে গেছে।
এর একটা কারণ নিশ্চয় পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্টের ভ্রান্ত নীতি— রাজ্যের চাহিদা বা অবস্থা না-বুঝে বৃহৎ বিনিয়োগের পিছনে দৌড়ানো। কিন্তু এটা একমাত্র কারণ নয়। অন্য কারণটা বুঝতে গেলে পশ্চিমবঙ্গ এবং কেরলের মধ্যে মৌলিক অমিলের দিকে তাকাতে হবে। কেরলের আসল শক্তি তার মানবসম্পদ। বহু বছর ধরে স্কুলশিক্ষার উৎকর্ষে কেরল দেশের এক নম্বরে। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় কেরলের মজবুত বনিয়াদি শিক্ষা সাধারণ মানুষকে শ্রমের বাজারের উপযোগী করেছে, তাঁদের উৎপাদনশীলতা বাড়িয়েছে। এর ফলে এক দিকে কেরলের শ্রমিক সারা পৃথিবীর কাজের বাজারে কাজ পেয়েছেন, বিদেশ থেকে নিয়মিত টাকা পাঠিয়েছেন, এবং মধ্য-নব্বই’এর পর থেকে সেই টাকা রাজ্যের নানান ব্যবসায় লগ্নি করা হয়েছে। অন্য দিকে, রাজ্যে উৎপাদনশীল শ্রমিকের জোগান পর্যাপ্ত থাকার কারণে বেসরকারি উদ্যোগগুলির মান ও আয় দুটোই বেড়েছে। অন্য ভাবে বলতে গেলে, বাজার অর্থনীতি যখন কেরলের দরজায় কড়া নাড়ল, রাজ্যের শ্রমিকরা তার জন্য পুরোমাত্রায় প্রস্তুত ছিলেন। তাঁরা প্রতিযোগিতা এবং বাজার অর্থনীতির পূর্ণ সুযোগ নিতে পেরেছিলেন।
১৪-১৫ বছর বয়সি ছেলেমেয়ে, যাদের মাধ্যমিক স্তরে লেখাপড়া করার কথা, তাদের সংখ্যা, এবং আদতে যত জন মাধ্যমিক স্তরে লেখাপড়া করছে, তাদের সংখ্যা— এই দুই সংখ্যার অনুপাতকে বলা হয় মাধ্যমিক স্তরে মোট উপস্থিতির অনুপাত (গ্রোস অ্যাটেনডেন্স রেশিয়ো)। জাতীয় নমুনা সমীক্ষার হিসাব অনুযায়ী ২০১৭-১৮’য় পশ্চিমবঙ্গে এই অনুপাত ছিল ৯২%, সারা-ভারতে ৮৬%, কেরলে ৯৭%। ২০১১-১২’র পশ্চিমবঙ্গে অনুপাতটা ছিল ৮০%। অর্থাৎ বাম-আমলের তুলনায় যেমন মাধ্যমিক স্তর অবধি স্কুলগামীদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য ভাবে বেড়েছে, তেমনই কেরলের তুলনাতেও পশ্চিমবঙ্গ তেমন একটা পিছিয়ে নেই। সমস্যা হল, এই চিত্রটা উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে দেখা যাচ্ছে না। ২০১৭-১৮’তে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে মোট উপস্থিতির অনুপাত পশ্চিমবঙ্গে ৫৯%, সারা ভারতে ৬৮%, কেরলে ১০০%। এর ফলে শ্রমের বাজারে উৎপাদনশীল শ্রমিকের অভাব হচ্ছে, আধুনিক শিল্পায়ন প্রক্রিয়ায় যোগ দেওয়ার উৎসাহ, ইচ্ছা বা ক্ষমতা একটা বড় অংশের মানুষের মধ্যে থাকছে না। বস্তুত, বাংলার গড়পড়তা ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগের দু’টি সমস্যা— কম উৎপাদনশীলতা, এবং বিনিয়োগের স্বল্পতা। উৎপাদনশীলতা কম বলে, লাভের হার কম। লাভের হার কম বলে উদ্যোগপতিরা কম বিনিয়োগ করছেন। আবার বিনিয়োগ কম হচ্ছে বলে শ্রমিকদের উৎপাদনশীলতা আরও কমে যাচ্ছে। আরও বেশি ছেলেমেয়ে উচ্চ মাধ্যমিকের গণ্ডি না পেরোলে উৎপাদনশীল শ্রমিকের সংখ্যা বাড়ানো যাবে না। ক্ষুদ্র-মাঝারি উদ্যোগগুলিকেও অধিকতর লাভজনক করা যাবে না।
কেরলের মতো পশ্চিমবঙ্গেরও বহু মানুষ অন্য রাজ্য এবং অন্য দেশে কাজ করেন। এঁদের যদি এই রাজ্যে বিনিয়োগ করার ব্যাপারে উৎসাহ দেওয়া যেত, যদি কেরলের মতো এই অনাবাসীদের সঞ্চয়ের একটা অংশ এখানকার ছোট-মাঝারি উদ্যোগগুলোতে লগ্নি করা যেত, তা হলেও বিনিয়োগের সমস্যা খানিকটা মিটত। এর জন্য এমন একটা পরিবেশ তৈরি করা দরকার যেখানে প্রবাসীরা পশ্চিমবঙ্গে বিনিয়োগের ব্যাপারে নিরাপদ বোধ করবেন। এই নিরাপত্তাটা সরকারই দিতে পারে।
বক্তব্য তিনটি। এক, বড় বিনিয়োগের তুলনায় ছোট এবং মাঝারি বিনিয়োগই পশ্চিমবঙ্গের সর্বব্যাপ্ত আর্থিক উন্নতির জন্যে বেশি দরকার। কেরল আমাদের কাছে একটা দৃষ্টান্ত হতে পারে। দুই, ছোট এবং মাঝারি উদ্যোগকে ভিত্তি করে এগোতে গেলে শ্রমিকদের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে, উচ্চ মাধ্যমিকের আগে স্কুলছুটের অনুপাত কমাতে হবে। তিন, পশ্চিমবঙ্গের বহু মানুষ ভিনরাজ্যে, ভিনদেশে ভাল আয় করছেন। তাঁদের এই রাজ্যে বিনিয়োগ করার ব্যাপারে উৎসাহ দিতে পারলে, এই রাজ্যে তাঁদের আকর্ষণ করতে পারলে, বিনিয়োগের সমস্যা অনেকটা মিটবে। কেরল যেমন তার প্রবাসীদের আকর্ষণ করতে পেরেছে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)