তেসরা অক্টোবর প্রায় সন্ধ্যাবেলা এসে পৌঁছলাম দার্জিলিঙের কাছাকাছি আবাসটিতে, কয়েক দিন পুরো পরিবার মিলে ছুটি কাটানোর জন্য। স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়া সঙ্গী ছিলই, পর দিনও। চার তারিখ সন্ধে থেকে নামল যাকে বলে মুষলধারে বৃষ্টি। প্রচণ্ড মেঘগর্জন। তার পর বিকট শব্দ এবং অন্ধকার। ৫ অক্টোবর সকাল থেকে তুফান আর জলপ্রলয়ের খবর। শুরুই হল মৃত্যুর খবর দিয়ে— ধস পড়ে মারা গিয়েছেন, প্রথমে শোনা গেল নয় জন, তার পর তেরো, এখন কুড়ির উপরে। জলের তোড়ে ভেসে গেছে মিরিকের কাছাকাছি বালাসন নদীর উপরের দুধিয়া সেতু। লোহার তৈরি সেতু। কবে তৈরি হয়েছিল, কতখানি ওজন নেওয়ার জন্য তৈরি, জানা গেল না। তবে এটুকু বলা যায়, গত বেশ কিছু বছর ধরে তার উপর দিয়ে নানাবিধ গাড়ি চলার কোনও বিরাম ছিল না। কারণ, ওই এক কালের শান্ত সুন্দর হ্রদটি ঘিরে, সেই একদা বনাঞ্চলের আশপাশে ইদানীং গড়ে উঠেছে ছোট-মাঝারি অসংখ্য খাবার জায়গা হোটেল হোমস্টে। তার উপরে এটি শিলিগুড়ি-মিরিক-কালিম্পং পথের একটি সদাব্যস্ত বিন্দু। সেতুটির অবস্থার কোনও সম্যক পরীক্ষা কখনও করা হয়েছে বলে শোনা গেল না।
‘হড়পা বান’ নাকি নেমেছিল মহানন্দা নদীতে। সে দিনকার মতো প্রবল বৃষ্টিপাতে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে স্বাভাবিক ভাবেই তীব্র গতিতে গড়িয়ে আসবে বিপুল পরিমাণ জল। বিশেষ করে যেখানে নিরন্তর গাছ কেটে নেওয়া হয়, বৃষ্টির জল শোষণ করে রাখার মতো কোনও ‘হিউমাস’-এর স্তর অবশিষ্ট নেই। সেখানে নদীর স্বাভাবিক ‘ফ্লাড-প্লেন’ যদি খালি না থাকে, খালি রাখার জন্য কোনও নিয়ন্ত্রণের যদি একান্ত অভাব দেখা যায়, তা হলে নদীখাত বেয়ে আসা সেই তীব্র জলস্রোতে মানুষের বিপন্নতার জন্য নদীর দোষ দেওয়া যায় না। এই বৃষ্টিতে সবচেয়ে বড় বিপর্যয় ছিল রাস্তা বন্ধ হয়ে যাওয়া। এই সময় আমাদের চেনা এই দার্জিলিং পাহাড়ে বেড়াতে যাওয়া ফুর্তিবাজ বাঙালির ভারী প্রিয় ব্যসন। ব্যাপক ধস পড়ে সেখানকার পথঘাট বন্ধ ও বিপদসঙ্কুুল হয়ে ওঠা মানে সেই অনভ্যস্ত লোকেদের সর্বনাশ।
অথচ এখানে ধস পড়া না আকস্মিক, না অস্বাভাবিক। যে কোনও প্রাকৃতিক আঘাতের মতোই এ বারের বিপদও আকস্মিক নয়। অধিক মাত্রায়, এমনকি অত্যধিক মাত্রাতেও, বৃষ্টিপাত আশ্বিন মাসে হতেই পারে। কিন্তু এক দিনের বৃষ্টিতে এমন তুমুল কাণ্ড হওয়ার কথা নয়। একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে এই বিধ্বংস ঘনাচ্ছিল। অবশ্যম্ভাবী ছিল। গত অন্তত তিন দশক ধরে এক দিকে যেমন বেড়েছে এই পাহাড়ে অরণ্য ছেদন, অন্য দিকে বেড়েছে রাস্তা ও জনপদ বাড়ানোর কাজ। দ্রুত, যেমন-তেমন করে। কোনও পরীক্ষিত পরিকাঠামো ছাড়াই। এখানে আসার সময়ে খেয়াল করছিলাম, ছোট জনপদগুলোতে সারা ক্ষণ যেমনটি চোখে পড়ত, দরজায় সুন্দর পর্দা লাগানো, সিগারেটের কৌটোয় বারান্দায় সাজানো রঙিন ফুলগাছওয়ালা সৌন্দর্যপ্রিয় নেপালিদের সেই হালকা ছোট ছোট সুন্দর কাঠের বাড়ি, সেগুলো পুরোপুরি অদৃশ্য হয়ে গেছে। তাদের জায়গা নিয়েছে সস্তা ইট-সিমেন্টের দোতলা-তিনতলা লম্বাটে বাড়ি। স্পষ্টতই ওঠা হোমস্টে কিংবা ছোট হোটেল।
দেখছিলাম, ঢালের দিকে রাস্তার কী রকম কিনারে ওই অপেক্ষাকৃত ভারী বাড়িগুলো অথবা পাহাড়ের পেটের দিকে কিছুটা খোঁদল করে ঢুকে গেছে। রাস্তার কিনারা কী ভাবে মাঝে মাঝেই বিপজ্জনক ভাবে ক্ষয়ে যাচ্ছে। কার্শিয়াং, টুং, সোনাদা— ঠিক যে সব জায়গায় ধসে গেছে ঘরবাড়ি, সেগুলো দু’দিন আগে দেখে আসা বাড়ির মধ্যেই কিছু কিছু। কী রকম যেন লাগছিল। মায়া আর ধ্বংসের এই ঘন সহাবস্থান মেনে নেওয়া বড় কঠিন। পর্যটনের উপর নির্ভরতা বাড়ছে, কারণ কমে গেছে মানুষের অভ্যস্ত কাজকর্ম। তাই তাঁরা ঝুঁকি নিয়েও টিকে থাকার চেষ্টা করছেন। সেই চেষ্টা আইন-বহির্ভূত হলেও কোনও প্রশাসন শক্ত করে বাধা দেয় না। কারণ জানা। অপেক্ষাকৃত সাময়িক বিপর্যয়েও তাই অনেক বেশি মানুষের মৃত্যু হয়। বসত ভেসে যায়। ধসে পড়ে পাড়। জলদাপাড়ার বয়ে আসা জলে বড় পশুদের অসহায়তা আবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় সেই অরণ্যের বৃক্ষবিরলতার চেহারা। যে অরণ্য সত্যিকারের অভয় দেবে, তাকে ঘন হতেই হবে। প্রাচীন বড় গাছের ঘন জঙ্গলে বন্যার জলস্রোত বাধা পেয়ে ভেঙে যায়। বড় প্রাণী দুর্ঘটনাবশত একটা ভেসে যেতে পারে, এতগুলি পারে কি?
যে প্রকাণ্ড পরিমাণ মাটি ছিন্ন অরণ্য ও নানান জানিত কারণে দীর্ঘকাল ধরে ধসের ফলে বছরের পর বছর হিমালয়ের নদীগুলিতে নেমে আসছে, সেই মাটি জমে থাকছে বয়ে যেতে না-পারা জলধারার নীচে। কিছু বেশি বর্ষণ হলেই জলধারণের শক্তিহীন এই সব নদীতে জলস্ফীতি ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। বস্তুত, আলিপুরদুয়ার, জলপাইগুড়ি, কোচবিহার অঞ্চলের কয়েক জনই বললেন, গত কয়েক বছর ধরে ৪-৭ অক্টোবরের মধ্যে এক বা একাধিক ভারী বর্ষণ হচ্ছে। সদ্য-অতীতে এই একই এলাকায় বিজয়ার ভাসানের দিন আচমকা বৃষ্টির জলস্রোতে নদীর প্লাবনভূমির মধ্যে নামা অনেক মানুষের মৃত্যুস্মৃতি স্থানীয় মানুষদের শোকে আজও জীবিত। সে বারও পরে প্রশাসনসূত্রে জানা যায় যে, নদীর মধ্যেকার ওই জায়গায় ভাসানের দিন ওই রকম জনসমাবেশ প্রতি বছরই হয়ে থাকে।
১০ নম্বর হাইওয়ের একাধিক অংশ ডুবে যাওয়ায় সড়ক যোগাযোগ সাময়িক ছিন্ন হয়ে যাওয়ার বিপন্নতা এ বারে প্রথম নয়। সেবকের কাছে কালীঝোরায় তিস্তা নদীতে বাঁধ দেওয়ার বিরুদ্ধে যে বিপুল প্রতিবাদ হয়েছিল তার অন্যতম কারণ ছিল এই আশঙ্কা যে, ওইখানে নদীর পেটে বালিমাটি জমে গেলে বর্ষাকালে জল উপচে ওঠার সম্ভাবনা অনেক বাড়বে, এবং ওই প্রাকৃতিক ভাবে দুর্বল ধসপ্রবণ জায়গাটিতে বিপদ অনেক বেড়ে যাবে। গত সপ্তাহের সংবাদে তিস্তা বাজারের যে মহাপ্লাবিত রূপ দেখা যাচ্ছিল, তার কারণও সেই একই— তিস্তা ও রঙ্গিত দুই খরস্রোতা নদীর মিলনস্থলের জল কালীঝোরায় বাধা পায়, স্বাভাবিক ভাবে বেরিয়ে যেতে পারে না। এ ক্ষেত্রে সমগ্র অঞ্চলটি যা হয়েছিল তার চেয়ে অনেক বেশি বিপন্ন হতে পারত।
কী বলতে চাইছি আমি এই সব কথা দিয়ে? ওই এলাকায় গত ক’দিন উপস্থিত থাকা, আর নানা জনের সঙ্গে কথা বলার দরুন যে উপলব্ধি হয়েছে তা অত্যন্ত দুঃখজনক, কিন্তু কটু সত্য। এক দিনের প্রচণ্ড বৃষ্টিতে ধস পড়ে সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে যে টুরিস্টরা ওই আশপাশের জায়গায় আটকে পড়েছিলেন, সেটা সমতলের নগরাঞ্চলের কাছে এক বিরাট ত্রাস ও রোমাঞ্চের কারণ। একই সঙ্গে শিলিগুড়ি থেকে ফেরার বিমান ও বাসের ভাড়া যে ভাবে বাড়ে, তাতে বোঝা যায় মুনাফার ক্ষুদ্রতম সুযোগও কোনও পরিকাঠামো ব্যবস্থা ছাড়তে প্রস্তুত নয়। এই ভদ্র বহিরাগতদের সঙ্কট কেটে গেল ঠিক দু’দিনের মধ্যে, দারুণ কুশলতায় ঠিক হয়ে গেল রাস্তা, সুতরাং সেই আলোড়নও কমে গেল। কিন্তু সঙ্কট রইল যেখানকার, সেখানেই। যে হতভাগ্য পরিবারগুলি নিজেদের প্রিয়জনকে হারাল, যে মানুষেরা হারালেন নিজেদের প্রাণ, দেখা যাবে তাঁরা সেই সব স্থানীয় লোক যাঁরা বাস করেন নদীর বিপজ্জনক নৈকট্যে, বিপজ্জনক ধস প্রবণ এলাকার ধারে, জানিত বিপদ-সম্ভাবনার অস্বস্তিকর রকম কাছাকাছি। একটি বিপর্যয় থেকে পরের বিপর্যয়— মাঝখানে রক্ষণীয় বিষয়ের কোনও নিয়মিত যত্ন নেওয়া নেই, যাতে বিপদ বাড়ে সেই কাজ বন্ধ করার শক্ত ব্যবস্থা নেই। রাস্তা বাড়ানো, নির্মাণ বাড়ানো, জঙ্গল ধ্বংস, হাজার হাজার গাড়ি থেকে নির্গত বেহিসাব কার্বন— এই সব কিছুর যা ফল হচ্ছে ওই ভঙ্গুর ইকলজির মাটি, জল, অরণ্য, অধিবাসীদের জীবনের উপর, সে বিষয়ে সরকার বেসরকার ভদ্রসমাজ একই রকম উদাসীন। বেপরোয়া।
ভয় হয়, এই শেষ নয়, পরের বছর, তার পরের বছর কলকাতা থেকে সুন্দরবন, অন্য সমস্ত জায়গার মতো এই মহান সুন্দর পাহাড়ের আশ্রয় আর সেখানে থাকা মানুষদের জীবনযাত্রা— দুই-ই বিপন্ন হতে থাকবে আরও বেশি।
আপ্রাণ চাইব, এ কথা ভুল হোক।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)