Advertisement
E-Paper

অস্ত্রের দামেই ঘায়েল

ট্রাম্পের শাসনের দ্বিতীয় পর্যায়ের সূচনা, এবং ১৩ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী মোদীর সঙ্গে ট্রাম্পের বৈঠকের পর থেকে প্রশ্ন উঠছে, ভারত কি আগের মতো স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে পারবে?

প্রণয় শর্মা

শেষ আপডেট: ১২ মার্চ ২০২৫ ০৪:২৪
Share
Save

সর্বাধিক অস্ত্র আমদানি করে যে দেশ, তার নাম ভারত। তাই নানা দেশের অস্ত্র নির্মাতারা ভারতের সঙ্গে কারবারে উৎসাহী। ভারত যে-হেতু দক্ষিণ এশিয়ার সর্ববৃহৎ দেশ, তাই তাদের ভূ-রাজনীতির সঙ্গে বাণিজ্যিক স্বার্থের বেশ খাপ খেয়ে যায়। কেবল এশিয়া নয়, বিশ্ব-রাজনীতিতেও ভারতের গুরুত্ব ক্রমশ বাড়ছে। নানা দেশের থেকে অস্ত্র কেনার নীতি নিয়েছে ভারত, যাতে পশ্চিমের অস্ত্র উৎপাদকদের মধ্যে একটা প্রতিযোগিতার আবহ তৈরি হয়। রাজনীতিতেও তার ছাপ পড়তে দেখা যায়— অনেক গুরুতর বিষয়ে মতান্তর থাকলেও, ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ করার ঝুঁকি কোনও দেশ নিতে চায় না। এর ফলে ভারতের বিদেশনীতিতে স্বাতন্ত্র্য সুরক্ষিত হয়েছে, কৌশলগত সিদ্ধান্তের জমি আরও বিস্তৃত হয়েছে, নিজের খুশিমতো সহযোগী নির্বাচনের ক্ষমতা বজায় থেকেছে। রাশিয়া ভারতের সর্বাপেক্ষা বড় অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ, কিন্তু কূটনীতির নিরিখে আমেরিকার সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। এদের মধ্যে ভারসাম্য রাখার কাজে ভারত সফল হয়েছে। খানিকটা এই কারণেই ইউক্রেন আক্রমণের পর রাশিয়াকে কোণঠাসা করার জন্য যে চাপ দিয়েছিল পশ্চিমের দেশগুলো, ভারত তাকে প্রতিহত করতে পেরেছে।

কিন্তু ট্রাম্পের শাসনের দ্বিতীয় পর্যায়ের সূচনা, এবং ১৩ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী মোদীর সঙ্গে ট্রাম্পের বৈঠকের পর থেকে প্রশ্ন উঠছে, ভারত কি আগের মতো স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে পারবে? আমেরিকা যে ভাবে ‘অবৈধ’ ভারতীয় অভিবাসীদের শিকলবন্দি করে ফেরত পাঠাচ্ছে, বিষয়টা মোদী উত্থাপনই করতে পারলেন না। ব্রাজ়িল, মেক্সিকো, কলম্বিয়ার মতো দেশ কিন্তু এ ভাবে তাদের নাগরিকদের শৃঙ্খল পরানো নিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছে। মোদীর নীরবতা তাই বহু ভারতীয়কে হতাশ করেছে। সংশয় দেখা দিয়েছে, এই কি ‘নিউ নর্মাল’? ভারত-আমেরিকা সংলাপে ক্ষমতার অসাম্যকেই কি এখন থেকে স্বাভাবিক বলে ধরে নিতে হবে?

ট্রাম্প-মোদী বৈঠকে আরও স্পষ্ট হয়ে গেল যে, ভবিষ্যতে আমেরিকার থেকে আরও বেশি অস্ত্র কিনতে হবে ভারতকে, আরও বেশি তেল আমদানি করতে হবে যাতে আমেরিকাই ভারতের সবচেয়ে বড় তেল জোগানদার হয়ে ওঠে, এবং আমেরিকার পণ্যের জন্য আরও বেশি খুলে দিতে হবে ভারতের বাজার। পরিবর্তে আমেরিকা সামরিক উৎপাদনের কিছু কারখানা খুলবে ভারতে। সেই সঙ্গে ভারতকে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি পাঠানোর উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেবে, যার ফলে মহাকাশ, দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র, আকাশ ও সাগরতলের সুরক্ষার ব্যবস্থায় ভারতের লাভ হবে। তবে এটা স্পষ্ট করে দেওয়া হল যে, ভবিষ্যতে ভারতকে আরও বেশি অস্ত্র কিনতে হবে আমেরিকার থেকে।

ভারত বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতি হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে তার অস্ত্র কেনার পরিমাণও বেড়েছে। ২০০০ সালে অস্ত্র কেনার বরাদ্দ ছিল তিন বিলিয়ন আমেরিকান ডলার, এখন তা আঠারো বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছে। নিকট ভবিষ্যতে তা ১৫০ বিলিয়ন ডলার ছাড়াতে পারে। ভারতের প্রতিরক্ষা বাজেট ৭৫ বিলিয়ন আমেরিকান ডলার, যা ভারতের জিডিপি-র ২.৯ শতাংশ।

গত শতাব্দীতে প্রায় চার দশকের শীতল যুদ্ধ কালে ভারত অস্ত্রের জোগানের জন্য প্রধানত সোভিয়েট ইউনিয়নের উপর নির্ভর করেছে, কারণ পশ্চিমের দেশগুলি ভারতের নিষ্পক্ষ অবস্থানের জন্য অস্ত্র জোগাতে চায়নি। সোভিয়েট ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর যন্ত্রাংশের সরবরাহে দেরি বাড়ে, দামও বাড়ে। ভারত তখন অন্যান্য দেশের দিকে ফেরে। এখনও ভারতের অস্ত্র আমদানির প্রায় অর্ধেকই আসে রাশিয়া থেকে। তবে ফ্রান্স, ইজ়রায়েল, ব্রিটেন এবং আরও কয়েকটি ইউরোপীয় দেশের উপস্থিতি ক্রমশ বেড়েছে।

আমেরিকা থেকে অস্ত্র আমদানি বাড়া শুরু হয় ২০০৮ থেকে। সে বছর ভারত-আমেরিকা আণবিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। আমেরিকার থেকে ভারত কিনছে সামরিক পরিবহণের বিমান, নৌবাহিনীর বিমান, ভারী ওজন বহনে সক্ষম হেলিকপ্টার, আক্রমণ-সমর্থ হেলিকপ্টার, জাহাজ ধ্বংসকারী ক্ষেপণাস্ত্র ‘হারপুন’, ‘হাওইটজ়ার’ কামান চালকহীন ড্রোন ‘রিপার’-সহ নানা অস্ত্রশস্ত্র। এখনও অবধি ভারত আমেরিকার থেকে কুড়ি বিলিয়ন আমেরিকান ডলারের অস্ত্র কিনেছে। সম্প্রতি দু’টি চুক্তি সই করেছে ভারত। একটি সামরিক অংশীদারি, বাণিজ্য ও প্রযুক্তিতে গতি আনার চুক্তি, অপরটি ভারত-আমেরিকা প্রতিরক্ষা চুক্তি, যার মেয়াদ দশ বছর।

ট্রাম্প চাইছেন, ভারত আমেরিকার থেকে কিনুক এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান, যার এক একটার দাম আশি মিলিয়ন থেকে একশো পনেরো মিলিয়ন ডলার। এই অত্যুন্নত বিমানগুলির কার্যসীমা ছেষট্টি বছর। এই গোটা সময় জুড়ে সেগুলির রক্ষণাবেক্ষণ, নিয়মিত ‘আপগ্রেড’ বা উন্নীত করার খরচ ধরে মোট চুক্তির অঙ্ক বিপুল— ১.৭ ট্রিলিয়ন ডলার। তার উপর একটি এফ-৩৫ বিমান প্রত্যেক ঘণ্টা ওড়ার খরচ ছত্রিশ হাজার ডলার।

ভারত এখনও অবধি এফ-৩৫ বিমান কেনার অঙ্গীকার করেনি। কিন্তু আগামী কয়েক মাস ট্রাম্প ভারতকে রাজি করানোর সব রকম চেষ্টা চালাবেন, এটাই প্রত্যাশিত। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের এ বছর ভারত সফরে আসার কথা। এখনও অবধি মোদী সরকার দু’দিক সামলে চলেছে। কিন্তু ট্রাম্পীয় আমেরিকার সঙ্গে ‘সার্বিক আন্তর্জাতিক কৌশলগত সহযোগিতা’ (কমপ্রিহেনসিভ গ্লোবাল স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ) বজায় রাখার কী মূল্য চোকাতে হবে ভারতকে?

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

India-US Relationship Donald Trump Narendra Modi

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}