E-Paper

দলাই লামার উত্তরসূরি সঙ্কট

চিন চেষ্টা চালাচ্ছে, সে দেশের প্রবীণ বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা যেন চিনের দলাই লামাকে স্বীকৃতি দেন। দলাই লামা নির্বাচনের অধিকারকে বৈধতা দিতে আইনও পাশ করে ফেলেছে চিন। চিনের দাবি, দলাই লামার কোনও অধিকার নেই নিজের উত্তরসূরি স্থির করার।

প্রণয় শর্মা

শেষ আপডেট: ২৪ জুলাই ২০২৫ ০৮:২০

সীমান্তে চার বছর সামরিক সক্রিয়তার পর যখন ভারত-চিন সম্পর্ক খানিকটা সহজ পথে ফেরানোর চেষ্টা চলছে, তখনই পথ আটকে দাঁড়াল নতুন প্রশ্ন: বর্তমান দলাই লামার উত্তরাধিকারী ঠিক করবে কে? ১৪তম দলাই লামার বয়স এ বছর নব্বই ছুঁয়েছে। আশঙ্কা দেখা দিয়েছে যে তাঁর অবর্তমানে দু’জন আলাদা ব্যক্তি দলাই লামা পদের দাবিদার হবেন, এক জন ভারতে, এক জন চিনে। এক জনকে বর্তমান দলাই লামার নির্দেশ অনুসারে তাঁর অনুগামীরা নির্ধারণ করবেন। অন্য জনকে ঠিক করবে চিনের কমিউনিস্ট পার্টি। ধর্মপ্রাণ তিব্বতিরা বিশ্বাস করেন যে, অতীতের কোনও দলাই লামার নবজন্ম ঘটে। জীবিত দলাই লামার দেওয়া সঙ্কেত এবং ধর্মীয় ঐতিহ্য অনুসারে পরবর্তী দলাই লামাকে চিহ্নিত করা হয়। বর্তমান দলাই লামা তেনজ়িন গিয়াৎসো জানিয়ে দিয়েছেন যে তাঁর প্রতিষ্ঠিত প্রশাসনিক কার্যালয় ‘গাদেন ফোড্রাং’-এর সদস্যরা তাঁর উত্তরসূরিকে চিহ্নিত করবেন। তিব্বতের রাজধানী লাসা-তে এই কার্যালয় বহু প্রাচীন। ভারতের ধর্মশালায় বর্তমান দলাই লামা এর প্রতিষ্ঠা করেন ২০১১ সালে। উদ্দেশ্য, তিব্বতিদের আত্মপরিচয়, সংস্কৃতির সংরক্ষণ। দলাই লামা সতর্ক করেছেন যে কমিউনিস্ট চিন যেন নতুন দলাই লামা নির্বাচন না করে। পরবর্তী দলাই লামা ভারতের মতো কোনও স্বাধীন দেশ থেকেই আসবেন।

চিন চেষ্টা চালাচ্ছে, সে দেশের প্রবীণ বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা যেন চিনের দলাই লামাকে স্বীকৃতি দেন। দলাই লামা নির্বাচনের অধিকারকে বৈধতা দিতে আইনও পাশ করে ফেলেছে চিন। চিনের দাবি, দলাই লামার কোনও অধিকার নেই নিজের উত্তরসূরি স্থির করার। চিনের কমিউনিস্ট পার্টি ‘স্বর্ণকলস’ পদ্ধতি মেনে তা স্থির করবে। এই পদ্ধতিতে কয়েক জনের নাম একটি ছোট সোনার পাত্রে রাখা থাকে, একটি তুলে নেওয়া হয়।

১৪তম দলাই লামা তিব্বতি বৌদ্ধ ধর্মের ‘গেলুগ’ ধারার প্রধান। অতীতে দলাই লামারা ছিলেন তিব্বতের রাষ্ট্রপ্রধান। বর্তমান দলাই লামা নিজের রাজনৈতিক ভূমিকা ছেড়ে, তিব্বতিদের দাবিগুলির জন্য কাজ করছেন। তিব্বতের স্বাতন্ত্র্যের জন্য তাঁর প্রচেষ্টা নানা মহল থেকে সমর্থন পেয়েছে। কূটনীতিতে চিন শক্তিবৃদ্ধি করেছে, কিন্তু দলাই লামাকে সে ভাবে কোণঠাসা করতে পারেনি। চিন দলাই লামাকে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ বলে দেখাতে চায়। তিব্বতিরা মনে করেন, তিনি তাঁদের জাতীয়তা, অস্মিতার প্রতীক। কিন্তু অদূর ভবিষ্যতে হয়তো ভারতের দলাই লামার কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ জানাবে চিন-অধিকৃত তিব্বতের দলাই লামা।

ভারত-সহ অধিকাংশ দেশ তিব্বতকে চিনের প্রজাতন্ত্রের অংশ বলে মনে করে। তা বলে সকলেই চিনের নির্বাচিত দলাই লামাকে মেনে নিতে রাজি, এমন নয়। আমেরিকা ২০২০ সালে আইন পাশ করে দলাই লামাকে সমর্থন জানিয়েছে, এবং তাঁর উত্তরাধিকারী চিহ্নিত করায় তিব্বতিদের অধিকারকে সমর্থন করেছে। তবে ট্রাম্প এই আইনকে কী ভাবে ব্যবহার করবেন, তা অনিশ্চিত।

ভারতের সঙ্গে তিব্বতের ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক এবং বাণিজ্যিক সম্পর্ক দীর্ঘ দিনের। ১৯৫৯ সাল থেকে ভারত দলাই লামা, কর্মাপা এবং আরও অনেক প্রবীণ লামা ও তাঁর সমর্থকদের আশ্রয় দিয়েছে। তিব্বতে বৌদ্ধদের চারটি প্রধান বিভাগ এখন ভারতে। ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী কিরণ রিজিজু দলাই লামার উত্তরাধিকারী নির্বাচনের দাবিকে সমর্থন করেছেন, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী দলাই লামাকে তাঁর ৯০তম জন্মদিনে শুভেচ্ছাবার্তা পাঠিয়েছেন। তাতে চিন ক্ষুব্ধ হয়েছে। চিনের দাবি, তিব্বত চিনের অভ্যন্তরীণ বিষয়, ভারত যেন নাক না গলায়। ভারত স্পষ্ট করেছে যে ধর্মীয় বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে না সরকার। তবে উত্তরাধিকারী নির্বাচনে দলাই লামার অধিকারে যেন বাইরে থেকে হস্তক্ষেপ না করা হয়।

নিরীশ্বরবাদী বলে পরিচিত কমিউনিস্ট চিন কেন দলাই লামার নতুন অবতার ঠিক করতে চায়? আসলে চিনের দরকার তিব্বতের উপরে নিয়ন্ত্রণ কায়েম রাখা। নানা রকম মূল্যবান খনিজ ছাড়াও, তিব্বত হল বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম জলের ভান্ডার। এখানকার হিমবাহগুলি চিনের ইয়াংসে, ভারতের সিন্ধু, ব্রহ্মপুত্র-সহ বেশ কিছু বড় নদীর জলের উৎস। এ ছাড়া চিনের ভয় আছে যে, তিব্বত স্বাতন্ত্র্য পেলে শিনচাং এলাকার তুর্কি বংশোদ্ভূত উইগুর মুসলিমরাও চিন থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চাইবে। অতি অল্প জনবসতি-বিশিষ্ট তিব্বতের উপর বহিরাগতদের আক্রমণও সহজ। তাই চিন তিব্বতের সীমান্তসুরক্ষাকে কেবলই শক্তিশালী করছে।

অতীতে যা ছিল ভারত-তিব্বত সীমান্ত, এখন তা-ই কার্যত ভারত-চিন সীমান্ত হয়ে উঠেছে। ১৯৬২ সালের যুদ্ধের পর থেকেই ভারতের আকসাই চিন উপত্যকা চিনের দখলে। এই উপত্যকা ঘেঁষেই রয়েছে তিব্বত এবং শিনচাং, চিনের দুই অশান্ত এলাকা। তাই ভারত সীমান্তে যে কোনও কার্যকলাপের প্রতি চিন অতিমাত্রায় স্পর্শকাতর।

১৯৬০ সালে, যখন ভারত-চিন সীমান্ত সঙ্কট চলছে, তখন ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির একটি দল মাও জে দ‌ং-কে প্রশ্ন করেছিল, ভারত দলাই লামাকে আশ্রয় দিয়েছে বলেই কি সমস্যা তৈরি হচ্ছে? উত্তরে মাও বলেছিলেন, সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকায় থাকার চাইতে দলাই লামা যে বন্ধুত্বপূর্ণ ভারতে রয়েছেন, সেটা ভাল। শি জিনপিং-এর সরকার একই কথা মনে করে কি না, সেটাই এখন প্রশ্ন।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Dalai Lama India-China

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy