লোকহিতৈষী নন, দুর্বৃত্তও নন প্রকাশকেরা। তাঁরা রাজকীয় ধনী বা কুঁকড়ে থাকা ভিক্ষুকও নন। তাঁদের খুব সাধারণ মানুষ হিসাবেই দেখুন, যাঁরা এক অস্বাভাবিক কঠিন পেশায় রুটিরুজির সন্ধানে এসেছেন। নিজের বইয়ে লেখকদের প্রতি লেখা ভূমিকায় এ ভাবেই প্রকাশকদের দেখতে বলেছিলেন বিশ্বখ্যাত এক প্রকাশক, স্যর স্ট্যানলি আনউইন। বিশ শতকের প্রকাশনা-বিশ্বে কিংবদন্তি হয়ে আছে তাঁর সেই বই, দ্য ট্রুথ অ্যাবাউট পাবলিশিং।
এ বছর শতবর্ষে পা দেওয়া সে-বই যখন প্রকাশিত হয়, আনউইনের তখন ৪২ বছর বয়স। মুক্তচিন্তার সাহসে বরাবর জেগে ছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ যে বছর শুরু, সেই ১৯১৪-তে নতুন একটা প্রকাশনা খুললেন, জর্জ অ্যালেন অ্যান্ড আনউইন লিমিটেড। চার জন ডিরেক্টর ছিলেন প্রতিষ্ঠানের, তার তিন জনকেই যুদ্ধে হারাতে হল। তবু একার লড়াইয়ে অ্যালেন অ্যান্ড আনউইনকে প্রকাশনার সেই দুঃসময়ে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিলেন তিনি। সুদীর্ঘ প্রকাশক-জীবনে স্বাধীন চিন্তার জন্য গেস্টাপোর ব্ল্যাকলিস্টে উঠেছিল তাঁর নাম। ছিয়াত্তর বছর বয়সে আদালতে দাঁড়িয়েছিলেন লেডি চ্যাটার্লি’জ় লাভার উপন্যাসের পক্ষে।
সোজা কথা সোজা করে বলার দুঃসাহস সম্বল করেই প্রকাশনা-জগতের ভিতরের সত্যগুলো খোঁজার চেষ্টা করেছিলেন একশো বছর আগে। তখনও বইয়ের শরীর বস্তুনির্ভর। দূর কল্পনাতেও ই-বই, পিডিএফ, অডিয়ো বুকের ধারণা ছিল না, সেল্ফ-পাবলিশিংও না। আজ আমূল বদলে গিয়েছে প্রকাশনার দুনিয়া। পিওডি ও সেল্ফ-পাবলিশিংয়ের দৌলতে প্রকাশনা-প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বও আপাতভাবে কমে আসছে। তবু, প্রতি বছর অন্তত বাংলা বইয়ের দুনিয়ায় এখন কেবলই প্রকাশকের জন্ম হয়।
বেঁচে থাকলে আজ আনউইন হয়তো এই প্রকাশ-দুনিয়ার নতুন সত্য খুঁজে বার করতেন। তিনি লিখেছিলেন: প্রকাশক তাঁর দোরগোড়ায় প্রতি দিন ডজন ডজন সদ্যোজাত ‘সন্তান’কে পান এবং তাঁর গুদামে একটু বেশি বয়সি এমন আরও কত সন্তান এক সঙ্গে তারস্বরে তাঁকে ডেকেই চলেছে। আনউইন জানতেন না, ‘শতবর্ষ পরে’ এমন কত প্রকাশক গজিয়ে উঠবেন যাঁরা লেখকের অর্থে বই প্রকাশে কার্যত ছেলেধরার ভূমিকাতেও পিছপা হবেন না!
নিজ বইয়ের প্রতি লেখকের আবেগ স্বাভাবিক। কিন্তু রুটিরুজির সন্ধানে এসেছেন বলে কোনও কোনও প্রকাশক লেখকের সেই আবেগকে সার্থক মনে করে তোল্লাই দেবেন, এটা বেশ হতাশার। হতাশা এ কারণে নয় যে, এতে আখেরে সাম্প্রতিক বাংলা বইয়ের কনটেন্ট দুর্বল হয়ে পড়ছে। এই কারণে যে, বাংলা বই-দুনিয়া তার পণ্যটিকে ভালবাসছে না।
বইকে পণ্য বললে অনেকেই আহত হবেন। অথচ, বইকে যথার্থে পণ্য ভাবতে পারলে তবেই বাংলা বই-ইন্ডাস্ট্রি কুটিরশিল্পের স্তর থেকে উন্নীত হতে পারে। এই ভাবনার প্রথম প্রশ্নটাই হল, কী ছাপব? বইয়ের বিষয়ের কোনও নির্দিষ্ট রসায়ন নেই, কারখানায় তা চাইলেই তৈরি করা যায় না। তাই আঞ্চলিক প্রকাশনাকে তার ভাষার লেখকদের সামগ্রিক মন ও মননের সমৃদ্ধির দিকেই তাকিয়ে থাকতে হয়। দুঃখের কথা, বাংলা ভাষায় সেই সমৃদ্ধি এখন দুরাশা। মননের চর্চা যাঁরা করেন তাঁদের বেশির ভাগই এখন তাঁদের বিদ্যাশৃঙ্খলার আন্তর্জাতিক পরিসরটির দিকে তাকিয়ে ইংরেজিতেই লিখতে বেশি পছন্দ করেন। সে লেখাও তার চলনেবলনে অ্যাকাডেমিক পরিসরের পাঠকদেরই জন্য। বৃহত্তর পাঠকসমাজের বাজার প্রায় অধরাই থেকে যায়।
সেই সমাজ যে নেই তা নয়। নানা বিষয়ের বই পড়ায় আগ্রহী মানুষ এখনও যথেষ্ট। তাঁরা নিয়মিত বই কেনেন, পড়েন। ফেসবুকে পুরনো বই বেচাকেনার জনপ্রিয় গ্রুপগুলির দিকে চোখ রাখলে এ সত্য বোঝা যায়। বোঝা যায় বাংলা বইয়ের সাম্প্রতিক সামগ্রিক তালিকায় চোখ বোলালেও। সে তালিকা প্রকাশ-তারিখের বিচারে সাম্প্রতিক হলেও চরিত্রে ব্যাকলিস্ট। অর্থাৎ পুরনো বই-ই নতুন মোড়কে প্রকাশিত হচ্ছে অনেক বেশি। কেবল এক প্রকাশকের ব্যাকলিস্ট ঢুকে যাচ্ছে অন্য প্রকাশকের কারেন্ট লিস্টে। এক প্রকাশক যে বই আর ছাপছেন না, অন্য প্রকাশক সেটাই ছাপছেন, বিক্রিও যে একেবারে হচ্ছে না তা নয়।
সবচেয়ে স্থিতিশীল প্রকাশনা তারাই, যাদের ধারাবাহিক ও লাভজনক বিক্রির একটি সমৃদ্ধ ব্যাকলিস্ট আছে, এবং তারা কখনও ব্যবসা নিশ্চিত করার জন্য জুয়া খেলে না। এই বইমেলাতেও পুরনো বাংলা বই পুনঃপ্রকাশের ছড়াছড়ি। নিজেদের বাজার-সমীক্ষার দুর্বলতায় কোনও প্রকাশক হয়তো তাঁর একদা জনপ্রিয় একটি বইকে অন্য প্রকাশককে দিয়ে দিচ্ছেন এবং সেই নতুন প্রকাশকের ঘর থেকে সে বই রমরম করে বিক্রি হচ্ছে, দেখা যাচ্ছে এমনটাও।
পুরনো চালের এই বৈপ্লবিক ভাতে বাড়ার কারণ অবশ্য সাম্প্রতিক কনটেন্ট-এর আকালও। আতা-স্তরের নতুনত্বও যে-হেতু প্রায়শ অমিল, তাই পুরনো ফজলি আমগুলিই নতুন মোড়কে দিব্য বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু কেবলমাত্র পুরনো পণ্যের উপরে ভরসা করে কোনও ইন্ডাস্ট্রি দীর্ঘকাল টিকে থাকতে পারে কি? বই কেমন করে ছাপব তা নিয়ে শিল্পিত-স্বভাব তরুণ প্রকাশককুলের যত্ন আশা জাগায়। পাশাপাশি আশঙ্কাও হয়, সম্পাদক-প্রকাশকের নিরন্তর তাগাদায় সম্ভাবনাময় নতুন কনটেন্ট যদি তৈরি হয়ে উঠতে না-থাকে, তবে বাংলা প্রকাশনার ভবিষ্যৎ কী? প্রকাশক হওয়া সহজ, প্রকাশক থাকা কঠিন, এবং নবজাতকের মৃত্যুর হার এই বাণিজ্যে অন্য অনেক বাণিজ্যের চেয়ে অনেক বেশি— প্রকাশনা সম্পর্কে আনউইন-কথিত এই সত্য কথাগুলি আজও বদলায়নি কিন্তু!
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)