E-Paper

সাহিত্যের যুক্তিনির্ভর ইতিহাস

আধ্যাত্মিকতার প্রেক্ষিতে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে মধ্যযুগের ব্যাপ্তি বিশাল। এই পর্বে ভারতের ইতিহাসের রাষ্ট্রনৈতিক সামাজিক সাংস্কৃতিক ঘাত-প্রতিঘাতের ছাপ পড়েছে বাংলা সাহিত্যে।

মানস ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ০৬:৫৫

সাহিত্যের ইতিহাসে অনিবার্য ভাবে জড়িয়ে আছে জীবন-ইতিহাস। নিয়ত পরিবর্তনশীল বাইরের জগৎ ও মানবমনের চিন্তার পরিবর্তনের প্রকৃতি বিচার করে আমরা যুগপর্ব নির্মাণ করি, সাহিত্যের ক্ষেত্রেও সেই পরিবর্তন লক্ষ করেই আদি, মধ্য ও আধুনিক যুগ কাঠামো নির্মিত হয়েছে। তবে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস চর্চার বিষয়টি বহুস্তরীয়।

আধ্যাত্মিকতার প্রেক্ষিতে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে মধ্যযুগের ব্যাপ্তি বিশাল। এই পর্বে ভারতের ইতিহাসের রাষ্ট্রনৈতিক সামাজিক সাংস্কৃতিক ঘাত-প্রতিঘাতের ছাপ পড়েছে বাংলা সাহিত্যে। সমাজের উপরতলা সাম্রাজ্য দখল ও রাষ্ট্রক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে মেতে থাকলেও, নিচুতলার মানুষদের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। ধর্মীয় সংঘাতের যে ছবি বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগের ইতিহাস জুড়ে পরিলক্ষিত হয়, শুধু তার নিরিখে এই পর্বের সাহিত্যকে ব্যাখ্যা করলে ভুল হবে। এই সময়ের সাহিত্য মূলত ধর্মকেন্দ্রিক; সমাজের বিভিন্ন গোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক কাঠামো যখন ধ্বংসের মুখে, তার প্রভাব সাহিত্যে পড়তে বাধ্য। মধ্যযুগের সাহিত্য-আলোচনায় এই দিকটির মূল্যায়ন দরকার, যে আলোচনা ধর্মের দিক থেকে ক্রমে সরে গেছে সমাজতত্ত্বের দিকে। অধ্যাত্মবাদ এখানে অস্বীকৃত নয়, তা জীবননির্ভর। এই দৃষ্টিভঙ্গির প্রথম পূর্ণাঙ্গ আভাস পাওয়া যায় সুকুমার সেনের (ছবি) মধ্যে। তাঁর বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস-এর প্রথম খণ্ডে বঙ্গের রাষ্ট্রিক ও সামাজিক ইতিহাসের পটভূমি যথাযথ বর্ণিত, যে দৃষ্টিভঙ্গি একান্তই তাঁর।

সুকুমার সেনের আগে সাহিত্যের ইতিহাস রচনার প্রয়াস কিছুটা দেখা যায় দীনেশচন্দ্র সেনের রচনায়। বঙ্গভাষা ও সাহিত্য গ্রন্থের নানা অধ্যায়ের তিনি নামকরণ করেছেন ‘গৌড়ীয় যুগ বা শ্রীচৈতন্য-পূর্ব্ব সাহিত্য’, ‘শ্রীচৈতন্য-সাহিত্য বা নবদ্বীপে ১ম যুগ’; অর্থাৎ ধর্মীয় পটভূমিই প্রাধান্য পেয়েছে। দীনেশচন্দ্র সেন যাকে শুধু বৌদ্ধ যুগ বলে উল্লেখ করেন তা আসলে গৌড়ের রাজসিংহাসন দখলে হিন্দু ও বৌদ্ধদের মধ্যে প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতার সময়। সেই ধর্মীয় অরাজকতার মধ্যে বাংলার দেবদেবীদের মধ্যেও লড়াই বেধে গিয়েছিল। পরবর্তী সময়ে বুদ্ধকে হিন্দু অবতারবাদে জায়গা দেওয়া, স্থানে স্থানে বৌদ্ধ মঠগুলিকে হিন্দু মন্দিরে পরিণত করা কেবল ধর্মীয় বিবর্তনের ইতিহাস নয়, প্রচলিত সাহিত্যধারার পরিবর্তনেরও ইতিহাস। বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস-এ সুকুমার সেন এ দিকে নজর দিয়েছিলেন। তাঁর লেখায় মধ্যযুগে ‘হিন্দু’ শব্দটির ব্যবহার লক্ষণীয়। কাশ্মীরি দার্শনিক শ্রীবর পঞ্চদশ শতকে মুসলিমের বিপরীতে ‘হিন্দু’ শব্দটি ব্যবহার করেন। এই হিন্দুর ধর্ম ও সমাজ পরিধিগত সম্প্রসারণশীলতা মেনে আমরা সাহিত্যের ইতিহাস পাঠ করিনি। বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস-কে যথার্থ অনুসরণ করতে গেলে হিন্দুসমাজের পাশাপাশি বৌদ্ধসমাজকেও গুরুত্ব দিয়ে বিচার করতে হবে। বঙ্গদেশে হিন্দু রচিত বাংলা সাহিত্যে ভারতীয় দর্শনের প্রভাব আছে, তার মূলে আছে সাংখ্য ও বৌদ্ধ দর্শন। দর্শনের ও সাহিত্যের ইতিহাস যে হাত ধরাধরি করে চলছে তা ঠিক ঠিক নজরে পড়েছে সুকুমার সেনের।

দীনেশচন্দ্র সেনের পরই বাংলা সাহিত্যের যুক্তিনির্ভর ইতিহাস রচনার প্রয়োজনীয়তা, এবং আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক অনুষঙ্গের নিরিখে সাহিত্যের বিচার-বিশ্লেষণ শুরু করেন সুকুমার সেন। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের ক্ষেত্রে কবিদের হেঁয়ালিপ্রীতি ও অনিবার্য জটিলতাকে যথাসম্ভব দূর করে সেই যুগের সমাজকাঠামো ও সমাজমানসের মূলটি ধরতে সক্ষম হয়েছিলেন। অপেক্ষাকৃত সহজ ধর্মবিশ্বাসের পথ ছেড়ে তিনি হেঁটেছেন বন্ধুর ইতিহাসনিষ্ঠার পথে।

ভারতীয় সমাজ-সংস্কৃতিতে প্রায় এক নিঃশ্বাসে উচ্চারিত রামায়ণ ও মহাভারত কিন্তু সমমর্যাদার নয়। রামায়ণ কবির সৃষ্ট কাব্য, আর মহাভারত হল ইতিহাস, বংশপরম্পরায় প্রাপ্ত লোকশ্রুতি। মহাভারতের মধ্যে রামকথা সন্নিবিষ্ট; তার বক্তা মার্কণ্ডেয়, শ্রোতা যুধিষ্ঠির। রামচন্দ্র আসলে যে অবতারপুরুষ নন, তাঁর নিবাস অযোধ্যায় না হয়ে পারস্যেও হতে পারে এবং রামায়ণ লেখার অনেক কাল আগেই ভারতে বা তার বাইরে রামচন্দ্র বলে এক প্রজারঞ্জক রাজা ছিলেন, সুকুমার সেনই তা প্রথম আলোচনা করেন। রামায়ণ লেখার অনেক আগে থেকেই বাংলায় রাম-কাহিনি জনপ্রিয় ছিল। বৈদিক সাহিত্যে রামকথার কোনও ইঙ্গিত না থাকলেও সীতা আছেন কৃষিসভ্যতার প্রতীক রূপে। ভারতে সংস্কৃত, পালি ও প্রাকৃতে রামকথা পাওয়া যায়। রামকথার স্রষ্টা হিসেবে বাল্মীকির নাম মহাভারতের রামকথায় নেই; হরিবংশ, বিষ্ণুপুরাণ ও ভাগবত পুরাণেও না। বৌদ্ধ ও জৈন রামকথায়, ব্রাহ্মণ্য ইতিহাস পুরাণে বাল্মীকির উল্লেখ নেই। সুকুমার সেন তথ্যপ্রমাণের সাহায্যে দেখিয়েছেন, বাল্মীকির বহু আগে থেকেই রামকাহিনির চল ছিল।

সুকুমার সেন ছিলেন কুশলী সমাজভাষাবিদ। ভাষা নিয়ে খেলতে খেলতে তার গভীরে প্রবেশ করাটা তাঁর মতো ভাষাতাত্ত্বিকের কাছে মূল বিষয়। তাঁর সাহিত্যের ইতিহাস-গ্রন্থগুলিতে সাহিত্যের সঙ্গে ভাষার অঙ্গাঙ্গি সম্পর্ক নিয়ে সচেতন ছিলেন তিনি। তথ্যের বিশ্লেষণ ও ইতিহাসের মূল্যায়নের নিরিখে তিনি শুধু সাহিত্যের ইতিহাস-রচয়িতাই ছিলেন না, ছিলেন তার সম-আলোচকও। তাঁর জন্মের একশো পঁচিশ বছরে সাহিত্যের ইতিহাস চর্চায় ভাষা সমাজ রাষ্ট্রনীতির প্রবণতাগুলি মনে রাখা দরকার।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Sukumar Sen Bengali Literature

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy