Advertisement
০২ মে ২০২৪
Ideology & lifestyle

ভুলতে পারি গাড়ির দাম, ভুলছি না তো বাবার নাম!

বাবার নাম বলতে তাঁর ভারী অনীহা। কিন্তু তিনি ২২ লক্ষ টাকার গাড়ির মালিক, জানাজানি হওয়ার পরে ‘সাবালক’ নেতাকে সাংবাদিক ডেকে বাবার নাম বলতে হল।

SUV of 22 lakh owned by a Bengal CPM leader and his father’s Bank Cheque

সর্বহারার নেতাদের কি দামি গাড়ি চড়ার মন ওঠে না? না কি তাঁদের কাঁধে ঝোলা নিয়ে দৌড়ে দৌড়ে অটোয় উঠতে হবে! গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

অনিন্দ্য জানা
অনিন্দ্য জানা
শেষ আপডেট: ০৫ এপ্রিল ২০২৩ ০৮:৩৫
Share: Save:

বছরখানেক আগের এক রবিবারের দুপুর মনে পড়ে গেল। সেই প্রথম পর্দার বাইরে তাঁকে দেখা। উঁচেগোটে চেহারা। ব্যাকব্রাশ চুল। পরিষ্কার কামানো গাল। তাঁর ঝকঝকে উপস্থিতির চারপাশে গুণমুগ্ধদের কিচিরমিচির। কেউ পাশে দাঁড়িয়ে একটা ছবি তুলতে চান। কেউ শুধু একটু কথা বলতে পারলেই কৃতার্থ। কেউ একটু দূর থেকে সম্ভ্রমভরে তাকিয়ে থাকতে চান শুধু।

সাধারণত তাঁর পরনে থাকে লম্বাঝুল কুর্তা (পেঁয়াজ রঙে তাঁকে দারুণ মানায়) এবং আলিগড়ি পাজামা। পায়ে মানানসই চামড়ার চপ্পল। কিন্তু সে দিন তিনি এসেছিলেন টি-শার্ট আর ট্রাউজ়ার্সে (সেগুলো ‘ডিজ়াইনার’ ছিল কি না মনে পড়ছে না)। কিন্তু তাতে কি আর তাঁর হ্যান্ডসামত্ব টোল খায়? বরং দেখলাম কুর্তা-পাজামার মতো টি-শার্ট আর ট্রাউজ়ার্সেও তিনি সমান চৌম্বকক্ষেত্র তৈরি করতে পারেন তাঁর পরিমণ্ডলে।

দক্ষিণ কলকাতার ম্যান্ডেভিল গার্ডেন্‌সে রক্তদান শিবির। অন্যতম উদ্যোগী অনুজপ্রতিম এবং প্রাক্তন সহকর্মী। তিনিই ডেকেছিলেন। গিয়েছিলাম। রক্ত দিতে নয়। রক্তদান মহাদান, জানি। অতীতে নিকটজনের জন্য রক্ত এবং প্লেটলেট জোগাড় করতে প্রচুর ছুটোছুটিও করেছি। কিন্তু ছোটবেলায় বার তিনেক ছাড়া নিজে খুব একটা রক্ত দিই না। কেন জানি না, তার পরে কেউ খুব একটা চাননি। চানও না। বুড়োটে চেহারা বলেই হয়তো। রসিকতা করে নিজেকে বোঝাই, দাসত্বের রক্ত তো! অন্যের দেহে সঞ্চারিত না-হলেই ভাল।

সেই শিবিরেই দেখা তাঁর সঙ্গে। ঠিক ‘দেখা’ও নয়। সশ্রদ্ধ ‘অবলোকন’ই বলা ভাল। এমনিতেই নিজে বেঁটে-মোটা এবং কদাকার হওয়ায় লম্বা আর সুদর্শন লোক দেখলে আপনা থেকেই গুটিয়ে-সিঁটিয়ে যাই। সে দিনও চারদিকে প্রচুর সুবেশ-সুবেশা এবং স্মার্ট তরুণ-তরুণী। তার উপর তিনি যখন শালপ্রাংশু মহাভুজ হয়ে সেই রক্তদান শিবিরের উপরের ঘরটিতে আবির্ভূত হলেন এবং তজ্জনিত কারণে চারপাশে আচমকাই আলো-বাতাসের পরিমাণ খানিক বেড়ে গেল, আমি স্বেচ্ছানির্মিত কোটরে আরও বেশি করে ঢুকে গেলাম। মনে আছে, গর্ত থেকে এক বার সারসের মতো গলা বাড়িয়ে তাঁর মুখের দিকে তাকানোরও চেষ্টা করেছিলাম। পোকামাকড়েরা যেমন করে।

তিনি কি তাঁর উপস্থিতি থেকে বিচ্ছুরিত জ্যোতির্বলয়ের বেড়ার ধারে বসে-থাকা প্রাণীটিকে অপাঙ্গে দেখেছিলেন? মনে হয় না। দেখার কথাও নয়। তিনি বরং ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন তাঁকে ঘিরে থাকা অনুরাগীদের বলতে যে, সে দিন সন্ধ্যায় তাঁকে ট্রেন ধরে নদিয়ার বেথুয়াডহরিতে যেতে হবে দলের কাজে। মনে মনে ভাবছিলাম, সত্যিই, কষ্টের জীবন!

খানিক বিশ্রম্ভালাপ। খানিক রাজা-উজির নিধন। খানিক লঘু, চপল এ পাশ-ও পাশ। তাঁকে ঘিরে ভিড়। কেউ কেউ দরজার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে পড়েছেন স্ট্যাচুবৎ। কেউ আবদার করছেন, রক্তদান করতে হলে তিনি ওঁর পাশের বেডে শুয়েই রক্ত দেবেন। আবার কেউ বলছেন, রক্ত দেবেন না। কিন্তু উনি যখন রক্ত দেবেন, তখন পাশের বেডে একটু শুয়ে থাকবেন। সেই মুহূর্তের একটা ছবি তুলে দিতে হবে।

মাঝারি সাইজের ঘরটায় একটি চেয়ার টেনে বসে যখন তিনি সকলকে ক্রমান্বয়ে বিমোহিত করছেন এবং করেই চলেছেন, ফুট দেড়েক দূর থেকে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে দেখছিলাম। মনে হচ্ছিল, ওয়াহ্! যুবনেতা হো তো অ্যায়সা। কী অসম্ভব জনপ্রিয়তা!

ইতিহাস মনে পড়ল। ২০১১ সালের বিধানসভা ভোটে কসবা থেকে প্রার্থী হয়েছিলেন তিনি। তখন তিনি সবে পঁচিশ। সে বারের নির্বাচনে সবচেয়ে কমবয়সি প্রার্থী। হেরেছিলেন (পরে আরও দু’বার হারবেন)। কিন্তু তাতে কী! সেই ভোটে রাজ্য জুড়ে ‘পরিবর্তন’-এর ঝড়ে তো বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যও হেরেছিলেন। ফলে পরাজিত যুবনেতার উপর দলের আস্থা টাল খায়নি। উল্টে দল তাঁকে জাতীয় স্তরে দায়িত্ব দিয়েছিল। তিনিও দিব্যি ছিলেন। ‘সর্বভারতীয়’ আফটার অল। গোল বাধল তার বছর দুয়েক পর। দক্ষিণ কলকাতার কিছু নেতা-কর্মী চিঠি পাঠালেন প্রকাশ কারাট এবং বিমান বসুর কাছে। এই মর্মে যে, ‘প্রতিশ্রুতিমান’ নেতা নিজের জন্মদিনটি নিয়ে একটি কাণ্ড ঘটিয়ে বসেছেন। কোনও একটি সমাজমাধ্যমে নিজের জন্মদিন লিখতে গিয়ে জানিয়েছিলেন ‘২২ এপ্রিল, ১৯৮৬’। ঘটনাচক্রে, ২২ এপ্রিল লেনিনেরও জন্মদিন। ব্যস! শুভেচ্ছার বন্যা। প্রভূত লাইকধ্বনি।

কিন্তু অঙ্কে কিছু গোলমাল ছিল। ২০১১ সালের ২৭ এপ্রিল ছিল কলকাতায় বিধানসভা ভোট। মনোনয়ন জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ছিল ৯ এপ্রিল। যুবনেতার (তখন অবশ্য খোকানেতা ছিলেন) জন্মদিন ২২ এপ্রিল হলে মনোনয়নের সময় তাঁর বয়স পঁচিশ বছর হতে পারে না। সেই মর্মে নির্বাচন কমিশন তখনই তাঁর প্রার্থিপদ বাতিল করে দিত। তা হয়নি। তিনি ভোটে লড়েছিলেন (হেরেছিলেন। কিন্তু তাতে কী! ওই যে, বুদ্ধদেবও তো হেরেছিলেন)। অর্থাৎ, তখন কমিশনকে নির্ঘাত অন্য তথ্য দেওয়া হয়েছিল।

এই মর্মে দক্ষিণ কলকাতার কিছু নেতা-কর্মীর চিঠিচাপাটি নয়াদিল্লির একেজি ভবন এবং কলকাতার আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে পৌঁছনোর পরে দলীয় স্তরে খোঁজ নিয়ে দেখা গিয়েছিল, যুবনেতার জন্মদিন আসলে ২২ মার্চ। জন্মের শংসাপত্র এবং কমিশনে জমা-দেওয়া হলফনামা তেমনই বলছে। লেনিনের জন্মদিনের এক মাস আগে। কিন্তু তিনি ‘লেনিন’ হতে চেয়েছিলেন। তা নিয়ে কিঞ্চিৎ প্রশ্ন এ দিক-সে দিকে উঠেছিল বটে। কিন্তু ওই পর্যন্তই। তরঙ্গ হিল্লোলে পরিণত হয়নি। কেনই বা হবে? সুকান্ত ভট্টাচার্য যদি লিখে থাকতে পারেন, ‘বিপ্লব স্পন্দিত বুকে মনে হয় আমিই লেনিন’, তা হলে যুবনেতা কী দোষ করলেন! তিনিও লেনিন।

তবে কিনা জনপ্রিয় মানুষদের নিয়ে অক্ষমের অসূয়া যুগে যুগে, কালে কালে এমন করে এসেছে। আর বাল্যকালে এমন কাণ্ডকারখানা খোকাখুকিরা করেই থাকেন। কেউ নিজেকে অরণ্যদেব ভাবেন। কেউ ম্যানড্রেক। কেউ ফ্ল্যাশ গর্ডন। কেউ লোথার। কেউ ডায়ানা পামার। তেমনই কেউ লেনিন। এগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতে হয়।

কেদারাসীন হয়ে এ সব ভাবতে ভাবতেই সেই মাহেন্দ্রক্ষণটি এল। এ বার যুবনেতাকে রক্তদান করতে যেতে হবে। এক তরুণ তাঁর কাছে প্রয়োজনীয় ফর্মটি নিয়ে এলেন। বিনীত ভাবে বললেন, ‘‘দাদা, একটা জিনিস ফর্মে লিখতে হবে। আপনার বাবার নামটা?’’

তিনি তরুণের দিকে বিস্ময়চকিত দৃষ্টিতে তাকালেন। তার পর ভ্রু সামান্য উঁচিয়ে অট্টহাস্য করে বললেন, ‘‘বাবার নাম লিখতে হবে? দরকার আছে? সাবালক হওয়ার পর থেকে তো কোথাও বাবার নাম লিখিনি ভাই!’’

চমৎকৃত হলাম! মনে হল, ওয়াহ্! বামপন্থী যুবনেতা হো তো অ্যায়সা। ঠিকই তো। সাবালক হওয়ার পর লোকে পিতৃপরিচয়কে পিছনে ফেলে নিজের পরিচয়েই তো পরিচিত হতে চায়। মুগ্ধতা ছিল। ভক্তি হল। ভাবলাম, সত্যিই তো। এমন করে তো কখনও ভাবিনি! বিড়ম্বনায় আরও সরু হয়ে গেলাম। তার পরে আস্তে আস্তে চেয়ার ছেড়ে উঠে কেটে গেলাম। বাইরে বেরিয়ে মনে হল, ইস্, এমন একজন নেতার বাবার নামটা জানা হল না। আফসোস রহিয়া গেল।

কিন্তু ভবি খণ্ডাবে কে! বাবার নাম জানা গেল। রক্তদান শিবিরের ফর্ম জানল। দেড় ফুট দূরে বসে-থাকা মধ্যবয়সি জানল। সারা পশ্চিমবঙ্গই জানল। তিনি ২২ লক্ষ টাকা দামের একটি গাড়ির মালিক, সে কথা জানাজানি হওয়ার পরে ‘সাবালক’ নেতাকে আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে বাবার নাম বলতে হল। কারণ, গাড়ির দামের সঙ্গে তাঁর বাবার নাম জড়িয়ে রয়েছে। যুবনেতাকে বলতে হল, গাড়ি কেনার টাকা তাঁর নয়, তাঁর বাবার। বাবার নাম করেই বলতে হল। নাম তো ছোটখাটো বিষয়। সারা রাজ্য এ-ও জানল যে, তাঁর বাবার কোন ব্যাঙ্কের কোন ব্রাঞ্চে অ্যাকাউন্ট, তিনি কী চাকরি করতেন, পুত্রের গাড়ি কেনার জন্য তিনি কত টাকা দিয়েছেন, কোন খাত থেকে দিয়েছেন, ফিক্সড ডিপোজ়িট ভাঙিয়েছেন না সেভিংস অ্যাকাউন্ট থেকে দিয়েছেন, সমস্ত! এহ বাহ্য, নেতার পিতার ব্যাঙ্কের পাসবইটিও দেখা গেল।

দেখতে দেখতে ভাবছিলাম, ইদানীং বাবাদের টেনে আনার একটা প্রবণতা দেখা দিয়েছে বটে। তৃণমূলের এক মন্ত্রীও সম্প্রতি তাঁর প্রয়াত পিতাকে স্মরণ করে সাংবাদিক বৈঠক করেছেন। বলেছেন, বামফ্রন্ট আমলে যখন তাঁর বাবা মন্ত্রী ছিলেন, তখন তিনি অনেককে নাকি চিরকুটে চাকরি দিয়েছিলেন! যা, তাঁর মতে, পুরোপুরি ‘অনৈতিক’।

মন্ত্রীপ্রবরের ‘বোধোদয়’ শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল, এ তথ্য তিনি এত দিন কেন প্রকাশ্যে বলেননি? কেনই বা তাঁর প্রতিবাদী বিবেক তখন জাগ্রত হয়নি, যখন তাঁর প্রতাপশালী পিতার সুপারিশহেলনে বিভিন্ন লোকের চাকরি হয়েছে?

যেমন মনে হচ্ছিল ‘সাবালক’ যুবনেতার কথা শুনে। সত্যিই তো, একজন ‘সাবালক’ কী গাড়ি চড়বেন, কত টাকার গাড়ি চড়বেন, সেই টাকা কে দেবেন, তা অন্যে বলার কে? হতে পারে তিনি ‘সর্বহারার নেতা’। হতে পারে তিনি ‘বিপ্লব স্পন্দিত বুকে আমিই লেনিন’। সর্বহারার নেতাদের কি দামি গাড়ি চড়ার মন ওঠে না? না কি তাঁদের কাঁধে ঝোলা নিয়ে দৌড়ে দৌড়ে অটোয় উঠতে হবে! নিজেকে ‘লেনিন’ মনে করলেই কি পৃথিবীর যাবতীয় কৃচ্ছ্রসাধন করতে হবে? যত্তসব!

মনে হচ্ছিল, গরম পড়ছে। এই সময়ে রক্তদান শিবির হয়। অতঃপর তেমন কোনও শিবিরে রক্ত দিতে গিয়ে ফর্মে বাবার নাম লিখতে হলে ‘সাবালক’ তিনি কি আগন্তুকের দিকে বিস্ময়লোচনে তাকিয়ে বলবেন, ‘‘সাবালক হওয়ার পর থেকে তো কোথাও বাবার নাম লিখিনি ভাই!’’

না কি গাড়ির দামের বিষয়টা মনে রেখে ‘নাবালক’ হয়ে বাবার নামটিও ফর্মে লিখে দেবেন? কৌতূহল রহিয়া গেল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Ideology Lifestyle Shatarup Ghosh CPM Leader
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE