দিনকয়েক ধরে স্কুল-ডায়েরির পাতা সাদা, এক অক্ষরও লেখা নেই তাতে। অথচ, নিয়মমতো স্কুলপড়ুয়াকে ওখানেই লিখতে হবে পড়া-পরীক্ষার খুঁটিনাটি। অভিভাবক আর স্কুলের মধ্যে দৈনন্দিন সেতু বাঁধার কাজ করে তো স্কুলের ডায়েরিটাই। অথচ, সেই ডায়েরিই বেবাক ফাঁকা। বিস্মিত মায়ের প্রশ্নের উত্তরে মেয়ের সপাট জবাব ছিল— ডায়েরি লিখব কেন? স্কুলের মেল, আর ওয়টস্যাপ গ্রুপ থেকেই তো সব জানা যাবে।
অস্বীকার করা যায়নি। কোভিডকাল দেখিয়ে দিয়েছিল, এক দিনও স্কুলে না গিয়ে, চক-ডাস্টার-ব্ল্যাকবোর্ডের দুনিয়ার বাইরে প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা— সবই চালানো সম্ভব ইন্টারনেট সংযোগের মাধ্যমে। অতিমারির সঙ্কটকাল অতিক্রান্ত। কিন্তু ডিজিটাল শিক্ষার পথ থেকে সম্পূর্ণ সরে আসা যায়নি। যুগের প্রয়োজনেই যায়নি। অবশ্যই এখনও শ্রেণিশিক্ষার পুরোপুরি বিকল্প হয়ে উঠতে পারেনি ডিজিটাল শিক্ষা। কোভিডকালের বহু-আলোচিত ‘ডিজিটাল ডিভাইড’ প্রমাণ করে দিয়েছিল শ্রেণিকক্ষের শিক্ষার অপরিহার্যতা। কিন্তু কোভিড-উত্তর যুগে তুলনায় সচ্ছল পরিবারে ডিজিটাল শিক্ষার প্রতি পক্ষপাত উত্তরোত্তর স্পষ্ট। শিশু অ আ বলতে শেখার আগেই তার হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে মোবাইল, এগিয়ে দেওয়া হচ্ছে হরেক লার্নিং অ্যাপ। ফলে, শিশু বই পড়ার আগেই স্ক্রিন চিনতে শিখছে, পোক্ত হাতে লিখতে শেখার আগেই স্বচ্ছন্দ হচ্ছে কি-বোর্ডে। বিশেষত বেসরকারি স্কুলগুলি এই পরিবর্তনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বহু স্কুলই বিভিন্ন বই পড়ে জ্ঞান অর্জনের চেয়ে বেশি আস্থা রাখে অডিয়ো-ভিডিয়ো মাধ্যমের উপর। ক্লাসে বিষয় ধরে দীর্ঘ আলোচনার চেয়েও বেশি জরুরি হয়ে ওঠে মেল-ওয়টস্যাপে হরেক লিঙ্ক পাঠিয়ে দেওয়া। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ডিজিটাল যন্ত্রে মুখ গুঁজে থাকা যে শিশুর মানসিক আর শারীরিক স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর, সে বোধ এখন প্রায় সকলেরই আছে। কিন্তু এই সচেতনতা উবে যায় ‘ডিজিটাল পড়াশোনা’র ক্ষেত্রে।
সাম্প্রতিক এই ধারার ঠিক বিপরীত পথে হাঁটতে চলেছে সুইডেন। সে দেশে শিক্ষানীতিটিকে এমন ভাবে ঢেলে সাজানো হচ্ছে, যাতে বিশেষত প্রাক্-প্রাথমিক স্তরে বই পড়ে, হাতে লিখে পড়াশোনার উপরই বেশি জোর দেওয়া যায়। তবে এই পরিবর্তনের অর্থ কিন্তু এমন নয় যে, শিক্ষায় প্রযুক্তির ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হয়েছে। বরং, জ্ঞান অর্জন মানেই প্রযুক্তির ব্যবহার— এই ‘অত্যাধুনিক’ ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে এক আদর্শ শিক্ষার পরিবেশ গড়তে তারা প্রথাগত পদ্ধতি এবং প্রযুক্তির মধ্যে এক সুন্দর ভারসাম্য নির্মাণের চেষ্টা করছে।
অথচ, এক সময় এই ডিজিটাল শিক্ষার জগতেই সুইডেনের ভূমিকাটি ছিল পথপ্রদর্শকের। বছর পনেরো-ষোলো আগে সে দেশে স্কুলশিক্ষার আধুনিকীকরণের লক্ষ্যে বইপত্র প্রায় ঠেলে সরিয়ে সেই জায়গায় বসিয়ে দেওয়া হয়েছিল কম্পিউটার, যাতে আগামী দিনের প্রযুক্তি-নির্ভর দুনিয়ায় ছেলেমেয়েরা অনায়াসে পা রাখতে পারে। তৎকালীন সরকার ভেবেছিল বই সরিয়ে শিশুদের হাতে ট্যাবলেট কিংবা কম্পিউটারের মাউস ধরিয়ে দিলেই বুঝি শেখার প্রতি আগ্রহ বাড়বে তাদের। ২০১৭ সাল নাগাদ সুইডেন স্কুলব্যবস্থার ক্ষেত্রে পাঁচ বছরের ‘ডিজিটালাইজ়েশন স্ট্র্যাটেজি’ গ্রহণ করে। পরিণতি, ইউরোপীয় ইউনিয়ন-এ সুইডেন ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসে।
এই পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েও কিন্তু পিছু হটতে হয়েছে সে দেশের সরকারকে। সরকারের পক্ষ থেকে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে, তাড়াহুড়ো করে বইপত্রের পাট উঠিয়ে দেওয়াটা বড় ভুল ছিল। সেই ভুল শোধরাতে বরাদ্দ করা হয়েছে ১০৪ মিলিয়ন ইউরো, যাতে প্রত্যেক শিক্ষার্থী প্রতিটি বিষয়ের জন্য অন্তত একটি করে পাঠ্যবই পেতে পারে।
সুইডেনের সিদ্ধান্ত বদলের পিছনে দীর্ঘ গবেষণা, বিশেষজ্ঞদের মত এবং পরিসংখ্যানের ভূমিকাই প্রধান। দেখা গিয়েছে, একেবারে নার্সারি স্তর থেকেই সে দেশে শিশুর হাতে মোবাইল, ট্যাবলেট তুলে দেওয়ার ফলে তার পড়া, লেখার সাধারণ দক্ষতাটি কমতে বসেছে। তা ছাড়া পড়ার প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধির বদলে ইন্টারনেটের রঙিন দুনিয়ার হাতছানি তার মনঃসংযোগ নষ্ট করে দিচ্ছে। মান নামছে বই পড়া, অঙ্ক, বিজ্ঞানের মতো বিষয়ে। ফলে বিশেষজ্ঞরাও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলছেন, ভরসা ফিরুক সেই ছাপানো পাঠ্যবই আর শিক্ষকের অভিজ্ঞতার উপর। সরকারও ছ’বছরের নীচে শিশুদের জন্য ডিজিটাল শিক্ষা সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেওয়ার বিষয়ে ভাবনাচিন্তা করছে। শিক্ষাকে আধুনিক করে তুলতে যুগোপযোগী নীতি নির্ধারণ, তাতে ভুলত্রুটি হলে স্বীকার করে নেওয়া, এবং সরকারি ব্যয়ে তাকে শোধরানোর চেষ্টা— ভারতীয় চোখে অবিশ্বাস্য ঠেকে।
সুইডেনের মতো শিক্ষায় অতি আধুনিকীকরণের পথে আমাদের দেশ এখনও হাঁটেনি। কিন্তু ডিজিটাল শিক্ষার বাদ্যটি শোনা যাচ্ছে স্পষ্ট। বাজনা আরও জোরদার হওয়ার আগে জেনে নেওয়া ভাল, যে উন্নত পরিকাঠামোর উপর ভর করে সুইডেন পুরনো শিক্ষাপদ্ধতি এবং আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির মাপমতো মিশ্রণ ঘটাতে পারে, সেই পরিকাঠামো এ দেশের বহু রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থায় নেই। ইন্টারনেটের সুবিধা পৌঁছয়নি সব জায়গায়। সরকারি স্কুলে শিক্ষক, শিক্ষা-উপযোগী সরঞ্জাম, পরিকাঠামো— টানাটানির চিহ্ন সর্বত্র। পাঠ্যসূচিতে অপ্রয়োজনীয় উপাদানের ছড়াছড়ি, হামেশাই শাসকের মর্জিমাফিক চলে তথ্যবিকৃতি। ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা বেসরকারি স্কুলগুলিতে পড়ানোর মান নিয়েও প্রশ্ন অনেক। গোড়ার এই ক্ষত না সারিয়ে ডিজিটাল দিকে ঝোঁকার পরিণতি শিক্ষার্থীদের পক্ষে আগামী দিনে মর্মান্তিক হতে পারে।
সুইডেনের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত এবং তার ফলাফলের দিকে নজর থাকবে অন্য দেশগুলির। ভারতও নজর রাখবে কি?
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)