Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
US-China relation

Taiwan: তাইওয়ান কি ইউক্রেন হবে? চিন, আমেরিকা কেউ সেই ঝুঁকি নেবে কি?

চিন যদি আক্রমণ করে, তখন আমেরিকা কি তাইওয়ানকে রক্ষা করবে? বুশ বলেছিলেন, “নিশ্চয়ই।” বাইডেনও বলছেন, “হ্যাঁ। আমেরিকা তাইওয়ানের পক্ষ নেবে।”

বাইডেন হয়তো ভাবছেন, ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার অভিজ্ঞতা দেখে চিন নিজেকে সংযত করবে।

বাইডেন হয়তো ভাবছেন, ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার অভিজ্ঞতা দেখে চিন নিজেকে সংযত করবে। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

অর্ধেন্দু সেন
অর্ধেন্দু সেন
শেষ আপডেট: ১০ জুলাই ২০২২ ১১:৩৮
Share: Save:

বছর কুড়ি আগে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশকে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেন— চিন যদি আক্রমণ করে, তখন আমেরিকা কি তাইওয়ানকে রক্ষা করবে? বুশ বলেছিলেন, “নিশ্চয়ই। চিনা আগ্রাসনের মুখে আত্মরক্ষায় তাইওয়ানকে সাহায্য করতে আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।” এ বছর মে মাসে বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন টোকিও গিয়েছিলেন ভারত-জাপান-অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে ‘কোয়াড’-এর মিটিং করতে। সাংবাদিক সম্মেলনে তাঁকেও একই প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। উত্তরে তিনি একই কথা বলেন, “হ্যাঁ। আমেরিকা তাইওয়ানের পক্ষ নেবে।”

এ বছরের প্রশ্নে অবশ্য ছোট্ট একটা লেজুড় ছিল। এবং তা ছিল খুবই সঙ্গত কারণে। তিন মাসের উপর হল ইউক্রেনে যুদ্ধ চলছে। আমেরিকা আর পশ্চিমী ইউরোপের সক্রিয় সাহায্য ছাড়া ইউক্রেনের পক্ষে সম্ভব ছিল না রাশিয়ার বিরুদ্ধে এত দিন যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া। এই দেশগুলি, বিশেষ করে আমেরিকা ইউক্রেনে হাজার হাজার কোটি টাকার অস্ত্র সরবরাহ করেছে। রাশিয়ার সেনাবাহিনীর ট্যাঙ্ক ও জাহাজের অবস্থান জানিয়ে তা ধ্বংস করতে সাহায্য করেছে। কিন্তু তারা ইউক্রেনে নিজেদের সৈন্য পাঠায়নি। যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েনি। তাই প্রশ্নকর্তা সুযোগ পেয়ে এ কথাও জানতে চান, ইউক্রেনে না হয় আমেরিকা সৈন্য পাঠায়নি, কিন্তু তাইওয়ানে কি প্রয়োজনে আমেরিকা তাও করতে প্রস্তুত? গোটা বিশ্বকে চমকে দিয়ে প্রেসিডেন্ট বাইডেন বলেন, “হ্যাঁ। প্রয়োজনে আমরা তাও করব। চিনের সে কথা মাথায় রাখা উচিত।” এত স্পষ্ট ভাবে এ কথা আমেরিকা আগে বলেনি।

গণপ্রজাতন্ত্রী চিন গোড়া থেকেই বলে আসছে তাইওয়ান তাদের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

গণপ্রজাতন্ত্রী চিন গোড়া থেকেই বলে আসছে তাইওয়ান তাদের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ছবি: রয়টার্স।

তাইওয়ান চিনের গায়ে লেগে থাকা দ্বীপ বা দ্বীপপুঞ্জ। সতেরো-আঠেরো শতকে দক্ষিণ চিন সমুদ্রের এই দ্বীপপুঞ্জ চোখে পড়ে ইউরোপীয় বণিকদের। পর্তুগিজরা দ্বীপের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে তার নাম রাখে ফরমোসা। স্পেনীয় এবং ওলন্দাজ বণিকরা দ্বীপের দুই প্রান্তে দু’টি ঘাঁটি স্থাপন করেন। চিনের বহু মানুষ এই দ্বীপে এসে বসবাস শুরু করেন। চিনে তখন চিং সম্রাটদের রাজত্ব। কিছুটা কিছুটা করে তাইওয়ান চিং সাম্রাজ্যের অন্তর্গত হয়। ১৮৯৫ সালে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে সম্রাট তাইওয়ান দ্বীপ তুলে দেন জাপানের হাতে। ১৯১২ সালে দেশজোড়া বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানে চিং সম্রাটের পতন হয়। সান-ইয়াৎসেন গণতান্ত্রিক চিনের প্রথম প্রেসিডেন্ট হন। কিন্তু তিনি ক্ষমতা ধরে রাখতে পারেন না। চিন বহু ভাগে বিভক্ত হয়। শেষে চিয়াং-কাইশেকের নেতৃত্বে কুয়োমিনতাং পার্টি ১৯২৮ সালে দেশের বিভিন্ন খণ্ডকে একত্রিত করে চিনা প্রজাতন্ত্র (রিপাবলিক অফ চায়না)-র পত্তন করে।

আমেরিকা চিং সম্রাটের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেছিল ১৮৪৪ সালে। ১৯২৮ সালে আমেরিকা চিয়াং সরকারকে স্বীকৃতি দেয়। তাইওয়ান তখন জাপানের অংশ। কিছু দিনের মধ্যেই কুয়োমিনতাংকে চ্যালেঞ্জ জানায় মাও জে দং-এর কমিউনিস্ট পার্টি। দীর্ঘ গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। কুয়োমিনতাং আধিপত্য হারাতে থাকে। শেষে কমিউনিস্টরা জয়ী হয়ে ১৯৪৯ সালে বেজিং-এ গণপ্রজাতন্ত্রী চিন (পিপলস রিপাবলিক অব চায়না বা পিআরসি) নামক হুকুমত কায়েম করে। চিয়াং পালিয়ে আশ্রয় নেন তাইওয়ান দ্বীপে। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে এই দ্বীপেই জাপান আত্মসমর্পণ করেছিল চিয়াং-এর কাছে। চিয়াং তখন বিজয়ী মিত্রশক্তির প্রতিনিধি।

কমিউনিস্ট সরকারকে স্বীকৃতি না দিয়ে আমেরিকা চিয়াং কাইশেকের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখে। ১৯৫০-এর দশকের গোড়ায় আমেরিকা কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামে কোরিয়ায়। এই সুযোগে মাওয়ের কমিউনিস্ট পার্টি যাতে তাইওয়ান দখল করতে না পারে তাই আমেরিকার সৈন্য তাইওয়ান পাহারা দেয়। ১৯৬০-এর দশকে কিন্তু চিন এবং সোভিয়েত রাশিয়ার মধ্যে ব্যবধান বাড়তে থাকে। পশ্চিমী দুনিয়ায় চিনের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ে। ১৯৭১ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জের আসনে চিয়াং-এর বদলে আসেন মাও। ১৯৭২ সালে প্রেসিডেন্ট নিক্সন চিন সফরে যান। এই সফরের প্রস্তুতি পর্বে হেনরি কিসিঞ্জার হঠাৎ একদিন পাকিস্তান থেকে উধাও হয়ে চিন চলে যান। সে ঘটনা আমাদের ভালই মনে আছে।

তাইওয়ানকে চিনের আগ্রাসন থেকে রক্ষা করবার প্রতিশ্রুতি দিয়েও আমেরিকা চায়নি তাইওয়ান নিজে কোনও সঙ্কট তৈরি করুক।

তাইওয়ানকে চিনের আগ্রাসন থেকে রক্ষা করবার প্রতিশ্রুতি দিয়েও আমেরিকা চায়নি তাইওয়ান নিজে কোনও সঙ্কট তৈরি করুক। ছবি: রয়টার্স।

এই উদ্যোগ সত্ত্বেও কমিউনিস্ট চিনের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক হতে সময় লাগে। ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত তাইওয়ানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রেখেছে আমেরিকা। পিআরসি স্বীকৃতি পাওয়াতে তাইওয়ানের সঙ্গে আমেরিকার সরকারি সম্পর্ক ছিন্ন হয়। বেসরকারি ভাবে সম্পর্ক বজায় থাকে আমেরিকান ইনস্টিটিউট অফ তাইওয়ানের মাধ্যমে। এর এক গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল তাইওয়ানে অস্ত্র সরবরাহ। একটা উদ্দেশ্য ছিল কমিউনিস্ট চিনকে আমেরিকার বন্ধু দেশ দিয়ে ঘিরে রাখা। দ্বিতীয়ত, দক্ষিণ চিন সমুদ্র বাণিজ্যের দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এই অঞ্চলে ভারসাম্য বজায় রাখার দায়িত্ব ছিল আমেরিকার নৌসেনার ‘সেভেন্থ ফ্লিট’-এর উপর।

পিআরসি গোড়া থেকেই বলে এসেছে তাইওয়ান চিনের অংশ। তার আগে কুয়োমিনতাং-এর চিনা প্রজাতন্ত্র বলেছে তাইওয়ান স্বাধীন দেশ। পিআরসি এ কথাও বলেছে যে, তাদের বিশ্বাস মুখে যাই বলুক তাইওয়ান একদিন পিআরসির বশ্যতা স্বীকার করবে। তাইওয়ানকে মাঝেমধ্যেই ভয় দেখানো হয়েছে। প্রেসিডেন্ট বাইডেন যে দিন টোকিও পৌঁছলেন, সে দিনও চিনা ফাইটার জেট তাইওয়ানের সীমা লঙ্ঘন করে। তাইওয়ানের জেট তাদের ধাওয়া করে। তবে অপ্রীতিকর কিছু ঘটেনি। তাইওয়ান নিজের সামরিক শক্তি বাড়িয়েছে যুদ্ধজাহাজ, টর্পেডো, অ্যান্টি-এয়ারক্রাফট গান আমদানি করে। কেউই কম যায়নি।

১৯৭৯ সালের পরে আমেরিকা তার এক-চিন নীতিতে নিষ্ঠ থেকেছে। তাইওয়ানকে অস্ত্র সাহায্য দিয়েও তাদের স্বাধীনতা সমর্থন করেনি। তাইওয়ানকে চিনের আগ্রাসন থেকে রক্ষা করবার প্রতিশ্রুতি দিয়েও আমেরিকা চায়নি তাইওয়ান নিজে কোনও সঙ্কট তৈরি করুক। দীর্ঘ দিন এ ভাবে চলার পর ঘোর চিন বিরোধী ডোনাল্ড ট্রাম্পের আবির্ভাব। নির্বাচনে জিতেই তিনি প্রথা ভঙ্গ করলেন তাইওয়ানের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের উদ্যোগে তাইওয়ানের সঙ্গে বেসরকারি সম্পর্ক কার্যত সরকারি স্তরে উন্নত হয়। আমেরিকান ইনস্টিটিউট পরিণত হয় আমেরিকার কনসুলেটে। অস্ত্র বিক্রি বেড়ে যায়।

তাইওয়ানের সেনা। আমেরিকার বিশেষজ্ঞেরা সম্প্রতি তাইওয়ানের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা খতিয়ে দেখতে শুরু করেছেন বলে খবর।

তাইওয়ানের সেনা। আমেরিকার বিশেষজ্ঞেরা সম্প্রতি তাইওয়ানের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা খতিয়ে দেখতে শুরু করেছেন বলে খবর। ছবি: রয়টার্স।

প্রেসিডেন্ট বাইডেন ট্রাম্পের বিপরীত মেরুর মানুষ। কিন্তু তাইওয়ান প্রশ্নে তিনি ট্রাম্পকেই অনুসরণ করছেন। জটিল পরিস্থিতিতে জটিল নীতি গ্রহণ করতে হয়। তাই আমেরিকার নীতির একটা অঙ্গ ছিল ‘স্ট্রাটেজিক অ্যাম্বিগুইটি’ অর্থাৎ ইচ্ছাকৃত অস্বচ্ছতা। কোন পরিস্থিতিতে আমরা কী করব তা আগেই বলতে যাব কেন? তেমন পরিস্থিতি হোক। কী করব দেখতেই পাবেন। এই অস্বচ্ছতা জলাঞ্জলি দিয়ে বাইডেন এখন স্পষ্টভাষ শুরু করেছেন। হয়তো উনি ভাবছেন ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার অভিজ্ঞতা দেখে চিন নিজেকে সংযত করবে। তা ছাড়া ‘কোয়াড’-এর মিটিং-এ এসে দু-চারটে গরম কথা না বললে চলে?

চল্লিশ বছর হল তাইওয়ান প্রণালিতে মোটের উপর শান্তিরক্ষা হয়েছে। টেনশন হয়েছে কিন্তু যুদ্ধ হয়নি। আমেরিকা মনে করে তাদের নীতি এর জন্য কিছুটা কৃতিত্ব দাবি করতে পারে। অস্বচ্ছতার অবসান হলে হিতে বিপরীত হবে না তো? খবরে প্রকাশ, আমেরিকার বিশেষজ্ঞেরা তাইওয়ানের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা খতিয়ে দেখছেন। তাইওয়ানের মানুষ কিন্তু মনে করেন তাদের প্রতিরক্ষার প্রধান উপাদান যুদ্ধজাহাজ নয়। তা হল তাদের ‘চিপ’ শিল্প। চিপ এখন কোথায় না লাগে। মোবাইল ফোনে থেকে শুরু করে সামরিক বিমান সব চলে চিপের সাহায্যে। ইউক্রেন যেমন গোটা পৃথিবীতে গম আর ভোজ্য তেল সরবরাহ করে, তাইওয়ানের ওই ছোট্ট দ্বীপে তৈরি হয় বিশ্বে ব্যবহৃত চিপ-এর ৯০ শতাংশ। এই শিল্প কিছু দিনের জন্য অকেজো হলেও আমরা অচল হয়ে যাব। আমেরিকাই হোক বা চিন, কেউ কি পারবে এত বড় ঝুঁকি নিতে?

(লেখক পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যসচিব। মতামত নিজস্ব)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE