আজকের দুনিয়ায় আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রিল-এর রাজত্বে। একটা সময় ছিল, যখন সংস্কৃতি মানে ছিল সাহিত্যের চর্চা, সমাজ নিয়ে ভাবনা, মননের গভীরতা। আজ তার জায়গা দখল করেছে ‘এনগেজমেন্ট’ নামের এক নতুন মুদ্রা, যা পরিমাপ করে ফেসবুক পোস্টের লাইক, ইউটিউব ভিউ, ইনস্টাগ্রাম রিলের শেয়ার সংখ্যা। শিল্প ও চিন্তার সাফল্য বিচার আর তার ‘মান’ দিয়ে হয় না, হয় ‘পরিমাণ’ দিয়ে: কত জন দেখেছে, লাইক দিয়েছে, তার উপর নির্ভরশীল সেই সৃষ্টির গ্রহণযোগ্যতা। এই প্রবণতা শুধু চিন্তার দৈন্যই ডেকে আনছে না, এক বিস্তৃত সামাজিক তথা সাংস্কৃতিক সমস্যার জন্ম দিচ্ছে। আজকের দুনিয়া দেখছে মানব-মনীষার জগতে এক মধ্যমেধার মহামারি।
সমাজমাধ্যমের এ-হেন বাড়বাড়ন্তের আগে কবি-সাহিত্যিকদের লেখা পাঠকমনে ধাক্কা দিত, বিতর্ক তৈরি করত, চিন্তার রসদ জোগাত। এখন ইনস্টাগ্রাম বা ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া ‘কনটেন্ট’-এর বেশির ভাগই হয় তুচ্ছ কৌতুক, নকল ট্রেন্ড বা আবেগমথিত নাটকীয়তা। একটা সময় জ্ঞান মানে ছিল জানার আনন্দ। এখন ‘কত জন দেখল?’, সেটাই মূল প্রশ্ন। জ্ঞান, শিল্প, সাহিত্য সবই যেন কনটেন্টের সুপারিশকারী কৃত্রিমমেধাভিত্তিক অ্যালগরিদমের পায়ে পায়ে ঘোরে। মননশীল পোস্ট কেউ দেখে না, কারণ সেখানে নেই ভাইরাল হেডলাইন, স্ক্রিপ্টেড পারিবারিক ঝগড়া বা যৌনতার সুড়সুড়ি। বরং, পাড়ার ফেসবুক তারকা ‘ফুচকা খেতে খেতে প্রেমে পড়লাম’ বা ‘চ্যাটজিপিটি-কে দিয়ে লিখিয়ে নিন অব্যর্থ প্রেমপত্র’ গোছের ভিডিয়ো দিয়ে পান ৩ লাখ লাইক, আর দর্শক বলেন, “অসাধারণ কনটেন্ট!”
এই ‘সংখ্যার খিদে’ মাদকের নেশার মতোই। তরুণ প্রজন্মের অনেকেই শুধু ‘ভিউ’ পাবেন বলে একই ঘরানার কনটেন্ট বার বার তৈরি করছেন, নিজের স্বাতন্ত্র্য ভুলে। কোনও গায়ক হয়তো লোকগীতির অনুরাগী ছিলেন, কিন্তু এখন ‘টুনির মা’ বা ‘টুম্পা সোনা’কেই আদর্শ ঠাওরে রিল-যোগ্য রিমিক্স বা ভাইরাল গান গাইছেন, কারণ নিখাদ লোকসঙ্গীতে ‘রিচ’ বাড়ে না। ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে শিল্পের মূল উদ্দেশ্য: নিজেকে প্রকাশ নয়, বরং ওই সুপারিশকারী অ্যালগরিদমে জায়গা করে নেওয়া। যে সঙ্গীতশিল্পীরা বহু বছর তালিম নিয়েছেন, বহু যত্নে কাজ শিখেছেন, সমাজমাধ্যমে সস্তা বিজ্ঞাপন করতে না পারলে তাঁদের কাজ চলে যাচ্ছে এমন কিছু গায়ক-গায়িকার কাছে, যাঁদের একমাত্র পুঁজি অটো-টিউনার সম্বলিত রিল-স্টাইল। কোন অভিনেতা কত পারিশ্রমিক পাবেন তা ঠিক হচ্ছে ফলোয়ার-সংখ্যা দিয়ে। মনে রাখতে হবে, এ ধরনের ঘটনা তত ক্ষণই দারুণ, তত ক্ষণই তা এলিটিজ়ম-এর নাকে ঝামা ঘষে দেওয়া, যত ক্ষণ এ একটা ব্যতিক্রম। এটাই নিয়ম বা প্রবণতা হয়ে উঠলে সমাজের হিতে বিপরীতই হবে।
এই প্রবণতা এক বিপজ্জনক সমাজবীক্ষণও হাজির করছে— চিন্তার গভীরতা যেখানে শুধু উপেক্ষিতই নয়, বরং অনভিপ্রেত। যাঁরা প্রকৃত জ্ঞানচর্চায় লিপ্ত তাঁদের বলা হচ্ছে ‘বোরিং’, ‘অ্যান্টি-ট্রেন্ডি’। এর দায় কার? কেবল কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের উপর দোষ চাপানো কি ঠিক? হয়তো না। কারণ, অ্যালগরিদমই আমাদের যা দেখতে ভাল লাগে তা-ই বেশি দেখায়। উল্টো দিকে, অনেক পাঠক বা দর্শক নিজেরাও সহজ ও ঝটিতি আনন্দের খোঁজে থাকেন— তাঁরা ভাবেন না যে কিছু বিষয় বুঝতে সময় ও মনোযোগ লাগে। তাঁরা ভুলে যান, মহৎ সিনেমা বা কবিতার মতো শিল্পকে উপভোগ করতে হলেও দরকার এক ধরনের মানসিক অনুশীলন। এই মিলিত উদাসীনতা একটি সামূহিক মানসিক শৈথিল্যের দিকে আমাদের ঠেলে দিচ্ছে। সবচেয়ে বড় ঝুঁকির মুখে পড়ছে নবীন প্রজন্ম, ভবিষ্যতের দর্শক-পাঠক— যাদের সামনে রয়েছে শুধুই পুনরাবৃত্তি ও বিরক্তি।
এই প্রবণতা এক বৃহত্তর সমাজতাত্ত্বিক সঙ্কটেরও প্রকাশ। জার্মান সমাজতাত্ত্বিক ম্যাক্স ওয়েবার যে বৈষয়িক যুক্তিবাদের কথা বলেছিলেন, তার এক গভীর প্রভাব আজকের ডিজিটাল সংস্কৃতিতে দেখা যায়। প্রতিটি আবেগ, ভাবনা ও শিল্পকর্মকেও কনটেন্টে পরিণত করে তার সারবত্তা মাপা হয় ভিউ কাউন্ট, রিটেনশন রেট, ক্লিক-থ্রু রেট ইত্যাদির মাধ্যমে। মানবিকতার গভীরতাই এতে সত্যি সত্যি প্রশ্নের মুখে পড়ে।
খুব অল্প সময়ে ডিজিটাল পুঁজিবাদের বিপুল বিকাশ আমাদের সামনে এমন এক সমাজকে দাঁড় করিয়েছে, যেখানে নেট-নাগরিকদের মনোযোগই সবচেয়ে মূল্যবান মুদ্রা। ইনস্টাগ্রাম রিল বা ইউটিউব শর্টস এমনই এক মাইক্রো-আবেগের সংস্কৃতি তৈরি করেছে, যেখানে তিন সেকেন্ডের মধ্যে মনোযোগ না ধরতে পারলে কনটেন্টটি ব্যৰ্থ। এই প্রথম তিন সেকেন্ড হল ‘হুকিং পিরিয়ড’, ওর মধ্যেই দর্শকের গলায় কনটেন্টের বঁড়শিটি গেঁথে দিতে হবে। আমেরিকান সমাজতাত্ত্বিক হার্বার্ট মারকুজ় সতর্ক করে দিয়েছিলেন ‘ওয়ান-ডাইমেনশনাল ম্যান’ নিয়ে: যে একমাত্রিক মানুষ কেবল প্রযুক্তির ও বাজারের চাহিদামাফিক নিজেকে রূপ দেয়, চিন্তা করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। আজকের ‘ক্রিয়েটর ইকনমি’তে সেই একমাত্রিকতা ভয়ঙ্কর ভাবে প্রত্যক্ষ। এখানে শুধু সাংস্কৃতিক গ্রহণযোগ্যতা নয়, সামাজিক মর্যাদাও নির্ধারিত ফলোয়ারের সংখ্যা বা ‘ইনফ্লুয়েন্স স্কোর’ দিয়ে। সাংস্কৃতিক পুঁজির জমি দখল করে নিচ্ছে সামাজিক পুঁজির এক নতুন আদল, যেখানে নেটওয়ার্ক আর ডিজিটাল রিচই মূলধন। এই সংখ্যাভিত্তিক সংস্কৃতি আমাদের পেশাতেও তৈরি করছে চাপ; হালফিল গণমাধ্যমে এমন এক অলিখিত বিধিও চালু: গভীর বা সাহিত্যিক ভাষা নয়, সরল হালকা জনপ্রিয় ভাষাই চলবে। খবরের শিরোনামে ‘কী’ ঘটেছে তা নয়, ‘কেন ক্লিক করবে’ সেটাই জরুরি।
সব জায়গায় কনটেন্ট সরলীকরণের ফতোয়া। ফলে, শৈল্পিক বা মননশীল প্রশ্ন ধাক্কা খাচ্ছে বাজারের দেওয়ালে। ভাল কিছু সৃষ্টি করেও জীবনধারণ কঠিন। মননশীল পরিচালক দেখছেন, তাঁর ছবিতে আমজনতার কোষ্ঠকাঠিন্যময় প্রতিক্রিয়ার পাশেই বিরাট বাজার ধরছে নিম্নমানের থ্রিলার, রুচিহীন রোম্যান্স, রিয়ালিটি শোয়ের কৃত্রিম কান্না। এই রুচিহীনতা প্রতিফলিত হচ্ছে রাষ্ট্রীয় স্তরেও। যে রাজ্যে বিচার চাইতে আসা শিক্ষকদের রাস্তায় ফেলে পেটানো হয়, যেখানে বিদ্বান মানুষ নিত্য নির্যাতিত, সেখানে সামাজিক ভাবনার আশ্রয় ক্ষীণ হয়ে পড়ে, অনিবার্য ভাবে বেড়ে ওঠে অপরাধপ্রবণতা, লুম্পেন-রাজ। আমরা ভুলে যাই এই সঙ্কটের শুরুটা আমাদের মুঠোফোনের পর্দায় কী ভাবে হয়েছিল, সবার অলক্ষ্যে।
তবে সমাজ যতই সংখ্যার মোহে গ্রস্ত হোক, কিছু মানুষ থাকেন যাঁরা ‘ভাল কনটেন্ট’ খোঁজেন, ‘ভাবনার খিদে’ নিয়ে বাঁচেন, মানসিক শ্রমে গড়ে তোলেন এক বিকল্প সাংস্কৃতিক বাস্তবতা। আমাদের দায়িত্ব— সংখ্যার আগ্রাসনের বিপরীতে, বিরাট ভিড়ের সামনে সংস্কৃতির লাশের উপর ক্ষমতার নগ্ন নাচে হাততালি দেওয়ার বদলে রুচির প্রতিরোধ গড়ে তোলা। তা হয়তো সহজ নয়, কিন্তু অসম্ভবও নয়। ইতিহাস সাক্ষী— সাহিত্য, দর্শন, মননের পথ কখনও মসৃণ ছিল না, তবু সেই পথেই তৈরি হয়েছে সমাজের মানচিত্র। ‘ট্রেন্ড’ মুছে যায়, সত্যিকারের সৃষ্টি রয়ে যায়। ‘ভিউ’-এর নীচে চাপা পড়ে যাওয়া সেই চিন্তা আর সৃষ্টিই হয়তো হবে ভবিষ্যতের পথনির্দেশ। প্রশ্ন একটাই: আমরা কি স্পর্ধা দেখাব রুচিকে প্রশ্ন করার, যাপিত সময়কে পাল্টানোর?
ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট, কলকাতা।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)