E-Paper

দুই বিপরীতের সংঘাত

দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্রহ্মচর্যাশ্রমকে রবীন্দ্রনাথ বিদ্যালয়ের রূপ দেন। কবি-মনে সম্পত্তি ঘেরাঘিরির কোনও জায়গা ছিল না। ইট-কাঠ-বালির ইস্কুলের প্রথাগত শিক্ষাব্যবস্থায় তাঁর আস্থা ছিল না।

মানস রায়

শেষ আপডেট: ০৯ জুন ২০২৫ ০৫:৪৮
Share
Save

ঠোকাঠুকি চলছিলই, তবে ইদানীং দুই বিপরীতধর্মী পথের মুখোমুখি সংঘাত স্পষ্ট হয়ে উঠেছে শান্তিনিকেতনে। এক দিকে রবীন্দ্রভাবনায় প্রকৃতির কোলে বিদ্যালয় ও শিল্পশিক্ষা-চর্চা, অন্য দিকে ইউজিসি-র কাচে-মোড়া ইমারত-বিশ্ববিদ্যালয়, অর্থমূল্যে ডিগ্রি অর্জন!

দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্রহ্মচর্যাশ্রমকে রবীন্দ্রনাথ বিদ্যালয়ের রূপ দেন। কবি-মনে সম্পত্তি ঘেরাঘিরির কোনও জায়গা ছিল না। ইট-কাঠ-বালির ইস্কুলের প্রথাগত শিক্ষাব্যবস্থায় তাঁর আস্থা ছিল না। শান্তিনিকেতনে নিজের বিদ্যালয়টিকে তিনি প্রকৃতির হাটে, খোলা হাওয়ার মাঝে, তরুছায়ায় বসিয়েছিলেন: শিশুমন যেন বেড়াজালে আটকে না যায়। কিন্তু তিনি যা ভেবেছিলেন, হল তার উল্টো। ইউজিসি দায়িত্বের ব্যাটনটি হাতে তুলে নেওয়া ইস্তক আশ্রম-বিদ্যালয় চরিত্র হারাতে থাকে; বিশ্ববিদ্যালয় তার বিপুল মহীরুহ-ছায়ায় তাকে ঢেকে ফেলতে শুরু করে। রবীন্দ্রপ্রয়াণের পর, গত প্রায় আশি-চুরাশি বছর ধরে কেন্দ্রের টাকায় শান্তিনিকেতনে গড়ে উঠেছে ইট-কাঠ-সিমেন্টের পেল্লাই ইমারত— বিশ্ববিদ্যালয়ের। পাঁচিল যত্রতত্র। ইউজিসি-ও বলে দিয়েছিল, নিজের সম্পত্তি, নিজের আয়ের উৎস নিজে বুঝে নাও। রবীন্দ্রনাথ এক পাশে সরে যান, পাঁচিলে মোড়া বিশাল বপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মোড়কে শান্তিনিকেতন সেই যে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল, তদবধি বৈপরীত্যের সংঘাত চলছেই।

এখন কবির আশ্রম-বিদ্যালয় শিবরাত্রির সলতে। তবু সে এখন আজকের ভাষায় বঙ্গের ‘ইউএসপি’, সঙ্গে ‘স্টেটাস-সিম্বল’ হিসাবে রয়েছে পৌষ মেলা, বসন্ত উৎসব, মাঘ মেলা। রাজ্য সরকারের প্যাকেজ-টুর শান্তিনিকেতনে, প্রায় সারা বছরই টুরিস্ট বাসের ভিড়। বিচিত্র পোশাকের পর্যটক-ভিড়ে পাঠভবন, শিক্ষাসত্র, উত্তরায়ণ ও তার মাঠ, মন্দির চত্বর, কলাভবন, সঙ্গীতভবন-প্রাঙ্গণ রমরম করে। আশ্রম-বিদ্যালয়ের বালক-বালিকার পোশাকের রবীন্দ্ররং তার পাশে যেন ম্লান। কবির ‘প্রাণের আরাম, আত্মার শান্তি’র শান্তিনিকেতনে প্রায়ই চলে ‘এক্সপো’ উৎসব।

বাঙালি একদা মধুপুর, জসিডি, গিরিডিতে হাওয়া-বদলে যেত। এখন স্থান-বদল করে শান্তিনিকেতন, খোয়াই ও তার কাছাকাছি বাসা বেঁধেছে। কবির যেখানে ইচ্ছে ছিল একতলা, বড়জোর দোতলার বেশি বাড়ি কখনওই নয়, সেখানে এখন গুরুপল্লি, পূর্বপল্লি, রতনপল্লি, শ্যামবাটী, ভুবনডাঙা এমনকি সোনাঝুরিতেও বড়-বড় বাড়ি। হোটেল, মল, বিপণিতে জমে উঠেছে ব্যবসা। লালবাঁধের পাশে শ্রীপল্লি হস্টেলের ছাদে দাঁড়ালে কয়েক বছর আগেও দেখা যেত, শ্রাবণের বৃষ্টি আসছে প্রান্তিক স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম-শেষে ডিসট্যান্ট সিগন্যালের কাছ থেকে। এখন মানুষই গিলে ফেলেছে আস্ত খোয়াইকে। উন্মুক্ত প্রকৃতি আর লাগামছাড়া ব্যবসার সংঘাত চলছে, চলবে।

রবীন্দ্রনাথ চাইতেন, আচার্য হবেন ছাত্রছাত্রীদের পিতার মতো, মাস্টারমশাইরা বয়োজ্যেষ্ঠ দাদার মতো। তাঁরা সবাই আশ্রম-চৌহদ্দির মধ্যে সর্বক্ষণ থাকবেন, বৈতালিক-সহ শান্তিনিকেতনের বছরভর অনুষ্ঠানাদিতে আচার্যের সঙ্গে হাজির থাকবেন। বাস্তবে কী হচ্ছে? শান্তিনিকেতন থেকে ১৩৯৭ কিমি দূরে দিল্লিতে থাকেন আচার্য। তাঁকে দেশ চালাতে হয়, রবীন্দ্র-আদর্শ মেনে চব্বিশ ঘণ্টা কি শান্তিনিকেতনের পিতা হয়ে থাকা সম্ভব? মাস্টারমশাইদের ক্ষেত্রেও কি সম্ভব রবীন্দ্র-ভাবনানুসারে চব্বিশ ঘণ্টা ছাত্রদের সঙ্গে থাকা, বৈতালিক বা অন্য অনুষ্ঠানে যোগদান! ইউজিসি বলেছে, দেশ-বিদেশের ল্যাবে গবেষণা করে, সেমিনার-ওয়ার্কশপে হাজির থেকে জ্ঞানসমৃদ্ধ হতে হবে তাঁদের, পড়ুয়াদের শিক্ষার মান বাড়াতে হবে। আইকিউএসি-র স্ক্যানে শিক্ষকদের সেই গতিবিধি ধরা থাকবে। রবীন্দ্র-আদর্শের পাশে মিলিয়ে দেখলে কেমন লাগে?

বৈপরীত্যের এই সংঘাত কি মেটানো যায় না? সব আমলেই উপাচার্যকে ঘিরে থাকে শুভানুধ্যায়ীদের বলয়, তাঁদের কাছে তিনি গঠনমূলক পরামর্শ চান। অথচ তাঁরা শুধুই যেন রাজার ধ্বজা উড়িয়ে তাঁর কাছাকাছি যাওয়ার প্রতিযোগিতায় মত্ত। এঁরা সত্যিই শুভমতি হলে হাজারো সমস্যার মধ্যে অন্তত দু’টি প্রধান সমস্যার আশু সমাধান অনায়াসেই করতে পারতেন। যেমন, প্রথমেই দরকার ছিল, ঐতিহ্যবাহী আশ্রম-বিদ্যালয়কে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রশাসনিক ভাবে আলাদা করে দেওয়া। শান্তিনিকেতনের আশ্রম-বিদ্যালয় পাঠভবন ও শ্রীনিকেতনের বিদ্যালয় শিক্ষাসত্র, দু’টিকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অধীন না রেখে এক জন সহ-উপাচার্য বা সমতুল পদমর্যাদার, স্কুল-প্রশাসনে অভিজ্ঞ কারও অধীনে আলাদা স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রশাসনিক কাঠামোর মধ্যে বিদ্যালয় দু’টিকে আনা। সঙ্গে থাকবেন পূর্ণ মর্যাদার কর্মসচিব, বিত্ত আধিকারিক, পরীক্ষা নিয়ামক। এঁদের আলাদা কর্মসমিতি ও শিক্ষাসমিতি থাকবে, যাতে কর্মী নিয়োগ থেকে শুরু করে সিলেবাস পুনর্গঠন, ছাত্র ভর্তি, পরীক্ষা নেওয়া ও ফল প্রকাশ ইত্যাদি বিদ্যালয়ের যাবতীয় কাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের মুখের দিকে না তাকিয়ে এঁরা স্বাধীন ভাবে পরিচালনা করতে পারেন— রবীন্দ্র-আদর্শ মনে রেখে। এতে আশ্রম-বিদ্যালয় থাকবে আশ্রম-বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো, ইউজিসির ফতোয়া মানতে হবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ও চলবে তার মতো।

দ্বিতীয়ত, যত্রতত্র পাঁচিল না তুলে, বৃহত্তর সীমানা-পাঁচিলে শান্তিনিকেতন ও শ্রীনিকেতনকে ঘেরা। এ ভাবে গঠিত হবে ক্যাম্পাস-চৌহদ্দি। পাঠভবন বিদ্যালয় থেকে শুরু করে শিক্ষাসত্র, কলাভবন, সঙ্গীতভবন ইত্যাদি শিক্ষাকেন্দ্রগুলি এবং মেলা মাঠ ও উত্তরায়ণের মাঠকে ফুলের গাছ বা বেড়ায় ঘিরলে ক্যাম্পাসের সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা ও পড়াশোনার পরিবেশ রক্ষা পাবে। সঙ্গে ব্যবস্থা করা: সুপারমার্কেট/দমকল অফিসের দিকে, শ্রীনিকেতনে কালীসায়রের দিকে ও শ্যামবাটী প্রভৃতি সব ক’টি ‘এন্ট্রি-পয়েন্ট’-এ যাতে প্রকৃত প্রয়োজন ছাড়া কাউকে ঢুকতে দেওয়া না হয়। সপ্তাহে দুই ছুটির দিনে নির্দিষ্ট সময়ে পর্যটকরা ঢুকতে পারেন— টিকিটের বিনিময়ে। ক্যাম্পাসে ঢুকে বছরভর হইহই বন্ধ হবে না কেন? লজ-মোড় থেকে শ্যামবাটীর মোড় পর্যন্ত শান্তিনিকেতনের বুকের উপর দিয়ে যাওয়া রাস্তায় রুটের বাস-সহ সব রকম ভারী গণযান চলাচল বারণ হোক; ক্যাম্পাসের মধ্যে হোটেল-রেস্তরাঁর ব্যবসাও। এতে দূষণ থেকে বাঁচবে শান্তিনিকেতন, বাঁচবে শিক্ষার পরিবেশ। ‘আমাদের শান্তিনিকেতন’-এর হৃত গৌরব ফিরিয়ে তাকে তুলে ধরা চাই।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Rabindranath Tagore UGC Visva Bharati University

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে আপনার সাবস্ক্রিপশন আপনাআপনি রিনিউ হয়ে যাবে

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।