Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
ধৈর্য ধরলে সুফল মিলবে
Fiscal deficit

রাজকোষ ঘাটতির কথা না ভেবে খরচ করার সিদ্ধান্ত জরুরি ছিল

এ বারের বাজেটে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হল পরিকাঠামোতে বেশ কিছুটা বরাদ্দ বাড়ানো। এই সিদ্ধান্তের মধ্যেও যে খুব সৃষ্টিশীলতা আছে, তা দাবি করা যাবে না।

স্বপ্নেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ০৭:২৪
Share: Save:

করোনা-পরবর্তী পরিস্থিতিতে অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন এ বারের বাজেট পেশ করলেন। বিগত এক বছরের আর্থিক মন্দা, সরকারের ক্রমহ্রাসমান আয় আর চাহিদার অভাব বর্তমান সরকারের কাজ বেশ কঠিন করে তুলেছিল। তাই এই বাজেট থেকে খুব বেশি প্রত্যাশা কারও মধ্যেই ছিল না। তবে অর্থনীতির ছাত্র হিসেবে কিছু নতুন সৃষ্টিশীল ভাবনা ও পদক্ষেপ আশা করেছিলাম। কিন্তু, তেমন কিছুই পেলাম না। হয়তো প্রত্যাশা একটু বেশিই ছিল। আসলে একটি সত্য আমাদের বুঝতে হবে। নির্মলা আগে বাণিজ্যমন্ত্রী ছিলেন, বর্তমানে অর্থমন্ত্রী। বাণিজ্যমন্ত্রী আর অর্থমন্ত্রীর কাজের ধরন একটু আলাদা। বাণিজ্যমন্ত্রীর মধ্যে সৃষ্টিশীলতা ততটা না থাকলেও চলে। কিন্তু অর্থমন্ত্রীর কাজে তা আবশ্যিক। নতুন নতুন পদ্ধতি, নকশা, ভবিষ্যৎ কর্ম-পরিকল্পনা উদ্ভাবন করা, অর্থাৎ নতুন ‘পলিসি ডিজ়াইন’ করা অর্থমন্ত্রীর কাজের একটি আবশ্যিক অঙ্গ। বর্তমান অর্থমন্ত্রীর মধ্যে এর কিছুটা অভাব আছে, সেটা অস্বীকার করা যাবে না। এই বাজেটেও সেই ছাপ রয়েছে।

এ বারের বাজেটে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হল পরিকাঠামোতে বেশ কিছুটা বরাদ্দ বাড়ানো। এই সিদ্ধান্তের মধ্যেও যে খুব সৃষ্টিশীলতা আছে, তা দাবি করা যাবে না। তবে, এর স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি, দু’টি সুফলই আছে। ভারতীয় অর্থব্যবস্থা বর্তমানে যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, সেখানে পরিকাঠামো ক্ষেত্রে ব্যয়বৃদ্ধির দ্বিমুখী গুরুত্ব। এটি একাধারে কর্মসংস্থান বাড়াবে, আবার চাহিদাও বাড়াবে, যেগুলিকে আমরা স্বল্পমেয়াদি সুফল বলতে পারি। আবার এটি একটি জোগানভিত্তিক পদক্ষেপ, যা বাজারের প্রসার ঘটায়। এই দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের পূর্ণ সুফল পেতে আমাদের বেশ কিছু সময় অপেক্ষা করতে হবে। তার জন্য একটু ধৈর্যশীল হতে হবে। বাজেট পেশ হওয়া ইস্তক অনেকেই ‘গেল গেল’ রব তুলেছেন। কিন্তু, পরিকাঠামো খাতে লগ্নি না করে অন্য কোন পথে চললে ভারতীয় অর্থব্যবস্থার অধিকতর উপকার হত, কেউই তা স্পষ্ট করে বললেন না। বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা করার সময় এটা নয়, এটুকু মনে করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন।

তবে, পরিকাঠামো মানেই যে রাস্তাঘাট বানানো, তা কিন্তু নয়। বিদ্যুৎ উৎপাদন, কৃষি পরিকাঠামো, সেচব্যবস্থা ও সার্বিক গ্রামীণ পরিকাঠামোও এর মধ্যে আসে। এ বারের বাজেটে গ্রামীণ পরিকাঠামো উন্নয়ন নিয়ে কিছু নতুন ভাবনা আশা করেছিলাম। কিন্তু এখনও তেমন কিছু দেখছি না। গ্রামীণ পরিকাঠামো উন্নয়নে অতিরিক্ত বরাদ্দ সাধারণ মানুষের হাতে কিছুটা অর্থের জোগান দিত, যা চাহিদার অপ্রতুলতার সমস্যা কমাতে সাহায্য করত।

বেসরকারিকরণ ও ব্যয় সঙ্কোচন এই সরকারের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। দু’টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক ও জীবনবিমা নিগমের কিছু শেয়ার বিক্রি করে সরকার এক লক্ষ পঁচাত্তর হাজার কোটি টাকা আয়ের প্রস্তাব করেছে। আরও বেশ কিছু রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বেসরকারিকরণ আসন্ন এবং ভবিষ্যতেও এই জাতীয় বেসরকারিকরণ চলবে, সেটা স্পষ্ট। অর্থশাস্ত্রের একটি ধারার যুক্তি বলবে, সরকারের কাজ বিমান চালানো বা হোটেল চালানো নয়— পরিকাঠামো তৈরি করা, ও কল্যাণমূলক প্রকল্পে নিয়োজিত থাকা। এই ভাবধারার উপর ভিত্তি করে সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে সরে দাঁড়াচ্ছে, এবং নিজের দায়িত্বের পরিধি কমাতে চাইছে। মিশ্র অর্থনীতি থেকে বাজার অর্থনীতির দিকে অগ্রসর হওয়ার ছাপ এখন স্পষ্ট।

তবে, এত কিছু করেও আগামী আর্থিক বর্ষে রাজকোষ ঘাটতির পরিমাণ ৬.৮ শতাংশের নীচে রাখা সম্ভব হচ্ছে না, করোনা-পরবর্তী পরিস্থিতি এতটাই খারাপ। এখানে বলা প্রয়োজন, সরকার রাজকোষ ঘাটতির তোয়াক্কা না করে যে ব্যয়নির্ভর পথে হাঁটার কথা ভেবেছে, সেটা সাহসের পরিচয়। বিচক্ষণতারও। আগেই উল্লেখ করেছি যে, পরিকাঠামোর মতো মূলধনী খাতে টাকা খরচ করায় যেমন কর্মসংস্থান বাড়বে, বাজারে চাহিদা বাড়বে, তেমনই ভবিষ্যতে লগ্নিও সহজতর হবে, অনেক বেশি উৎপাদনশীল হবে। ফলে, আজ রাজকোষ ঘাটতি বাড়ালে ভবিষ্যতে জাতীয় আয়ের পরিমাণ, এবং তার সঙ্গে রাজস্ব আদায়ের পরিমাণও তুলনায় অনেক বেশি বাড়বে। তখন রাজকোষ ঘাটতির পরিমাণ আপনা থেকেই কমবে।

বিগত কয়েক বছর ধরেই এই সরকারের দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ করার প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল গবেষণা, অর্থাৎ ‘রিসার্চ অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট’কে উৎসাহিত করা। এ বারের বাজেটে এই খাতে বরাদ্দের পরিমাণ সামান্যই বৃদ্ধি করা হয়েছে। গবেষণায় উৎসাহ না দিলে কোনও দেশ বা জাতি এগোয় না, এটি সরকার যত তাড়াতাড়ি বুঝবে, ততই মঙ্গল। শিক্ষাক্ষেত্রে ভারত সরকারের বরাদ্দ ঐতিহাসিক ভাবেই কম। এ বারও তার অন্যথা হয়নি। অর্থমন্ত্রী শিক্ষাখাতের বরাদ্দ এ বার ৬০০০ কোটি টাকা হ্রাস করেছেন। বর্তমানে সরকার ব্যয় সঙ্কোচনের চেষ্টা করছে, কিন্তু শিক্ষায় ব্যয় সঙ্কোচন দুর্ভাগ্যজনক। ভাবতে অবাক লাগে যে, আমরা ৯-১০ শতাংশ হারে আর্থিক বৃদ্ধির স্বপ্ন দেখি, অথচ শিক্ষাখাতে বরাদ্দ কমিয়ে চলেছি। এই মানসিকতা বদলানো দরকার। শিক্ষিত পরবর্তী প্রজন্ম গড়তে না পারলে এই স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে।

বর্তমান কৃষক আন্দোলনকে প্রশমিত করতে সরকার বেশ কিছু পদক্ষেপ করেছে, যা মূল্যস্ফীতি ঘটাতে পারে। কৃষিক্ষেত্রে সরকার এ বার প্রায় ছয় শতাংশ বেশি বরাদ্দ করেছে। বলা হয়েছে যে, কৃষিক্ষেত্রের পরিকাঠামোগত উন্নতির জন্যই এই অতিরিক্ত বরাদ্দ। কিন্তু, কী জাতীয় পরিকাঠামোগত উন্নতির কথা সরকার ভাবছে, সেটা ঠিক স্পষ্ট নয়। এই অতিরিক্ত বরাদ্দের অনেকটাই আসছে বিভিন্ন দ্রব্যের উপর কর চাপিয়ে। পেট্রলের উপর ২.৫ শতাংশ সেস পেট্রলের দাম বাড়াবে। আরও অনেক জিনিসের উপর অতিরিক্ত কৃষি সেস চাপানো হয়েছে, যার মধ্যে ভোজ্য তেলও আছে। এই পদক্ষেপে কৃষিক্ষেত্রের কিছুটা সুরাহা হতে পারে, কিন্তু এতে মধ্যবিত্তের উপর মূল্যস্ফীতিজনিত চাপ হবে। তবে স্বস্তির কথা হল যে, ডিজ়েলের উপরে কোনও সেস চাপানো হয়নি— হলে, অনেক বেশি মূল্যস্ফীতি ঘটত। বর্তমান কৃষি আন্দোলনের একটা বড় কারণ হল, কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি এক শ্রেণির কৃষকের অবিশ্বাস ও অনাস্থা। এবং তা অনেকটা ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নিয়েও। এ বারের বাজেট ঘোষণাতে তাই সরকার বিগত দু’তিন বছরে কী ভাবে ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে চাল ও গমের সরাসরি ক্রয় বাড়িয়েছে, তার বিস্তারিত খতিয়ান আছে। আন্দোলনরত কৃষকরা এতে আশ্বস্ত হলেন কি না জানি না, সরকার চেষ্টার ত্রুটি রাখেনি। কী হবে, তা ভবিষ্যৎই বলে দেবে।

এই বাজেটে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে বরাদ্দ বেড়েছে ১৩৫ শতাংশ, করোনা-পরবর্তী পরিস্থিতিতে এটি কাম্য ছিল এবং তা কিছুটা হয়েছে। হয়তো আরও একটু বেশি হলে ভাল হত, তবে মোটের উপর এটি একটি সদর্থক পদক্ষেপ। শুধু আক্ষেপের বিষয় এই যে, এটি অনুধাবন করতে আমাদের একটি অতিমারির প্রয়োজন পড়ল। তবে এই বৃদ্ধির অনেকটাই করোনা টিকাকরণের প্রয়োজনে। স্বাস্থ্যখাতে আমাদের বরাদ্দ বরাবর জাতীয় আয়ের ১.৫ শতাংশ বা তার আশেপাশে থাকে, যা অধিকাংশ বড় অর্থব্যবস্থার তুলনায় অনেক কম। দেশের স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর আরও অনেক উন্নতি দরকার এবং তার জন্য ভবিষ্যতে স্বাস্থ্যে বরাদ্দ আরও অনেক বাড়াতে হবে।

আগামী অর্থবর্ষে ভারতের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার ১১.৫ শতাংশের আশপাশে থাকার অনুমান, এই অর্থবর্ষে ৭.৭ শতাংশ সঙ্কোচনের পর যা খুবই স্বাভাবিক। আগামী ৪-৫ বছর টানা ৯-১০ শতাংশের কাছাকাছি আর্থিক বৃদ্ধি না রাখতে পারলে আমরা অনেক পিছিয়ে পড়ব। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, গবেষণায় খরচের পাশাপাশি সমস্ত রকম পরিকাঠামোর সার্বিক উন্নয়নই আমাদের সেই দিকে নিয়ে যেতে পারে। সরকারের সেই চেষ্টাই করা উচিত।

অর্থনীতি বিভাগ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Fiscal deficit Corona Coronavirus in India
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE