E-Paper

উদ্যোগমনস্ক ছাত্র গড়তে

কারিগরি শিক্ষা ও হাতেকলমে প্রশিক্ষণের ভিত্তিতে স্ব-উদ্যোগমনস্কতা ও বাণিজ্যিক সচেতনতা কি তৈরি করা সম্ভব?

প্রজ্ঞাপারমিতা মণ্ডল

শেষ আপডেট: ২৩ মে ২০২৫ ০৬:০১

গত ১০ মে পালিত হল বিশ্ব ন্যায্য বাণিজ্য দিবস। ২০০১ থেকে ওয়ার্ল্ড ফেয়ার ট্রেড অর্গানাইজ়েশন স্বীকৃত ন্যায্য বাণিজ্য দিবস পালিত হয় মে মাসের দ্বিতীয় শনিবার। এ বছর দিনটির থিমে ছিল বাণিজ্য বিপ্লবের কণ্ঠ হয়ে ওঠার আহ্বান। জাতীয় শিক্ষানীতিতে পঠনপাঠনের সমান্তরালে শিক্ষার্থীদের ব্যবসা ও বাণিজ্যমুখী করে তোলার কথা বলা হয়েছে। স্কিল ডেভলপমেন্ট বা ইন্টার্নশিপের মাধ্যমে তাদের কর্মমুখী ও কর্মোপযোগী করার বিবিধ উপায় ইতিমধ্যে পাঠ্যক্রমের অন্তর্গত। কিন্তু কারিগরি শিক্ষা ও হাতেকলমে প্রশিক্ষণের ভিত্তিতে স্ব-উদ্যোগমনস্কতা ও বাণিজ্যিক সচেতনতা কি তৈরি করা সম্ভব?

স্ব-উদ্যোগ ও ব্যবসাবৃত্তির জন্য বাণিজ্যিক সাক্ষরতা নিঃসন্দেহে প্রয়োজন। উদাহরণ হিসেবে দেখা যেতে পারে আর্থিক অন্তর্ভুক্তিকরণের বিভিন্ন গবেষণাধর্মী আলোচনা, যেখানে এসএইচজি-পরবর্তী সময়ে গ্রামীণ অর্থনীতিতে মহিলাদের অংশগ্রহণ এবং তাঁদের অর্থনৈতিক সাক্ষরতা ও স্বাধিকারের বিষয়টি স্বীকৃত হয়েছে। তবে শিক্ষা ও সাক্ষরতা লাভের মধ্যে মাত্রাভেদ থাকে। স্ব-উদ্যোগ বিষয়ে ঠিক কী ধরনের পাঠ-নির্দেশিকা ছাত্রদের জন্য কার্যকর হতে পারে সে প্রশ্ন থেকেই যায়। স্ব-উদ্যোগ নির্মাণ বা স্টার্ট-আপ পরিকল্পনা ও পরিচালনায় কিছু নির্দিষ্ট দক্ষতা লাগে। এ ক্ষেত্রে উদ্ভাবন, অভিযোজন, সমস্যা-সমাধান বা নেতৃত্বের ক্ষমতা এবং অর্থনৈতিক বিনিয়োগ, ব্যবস্থাপনা ও ঝুঁকি নেওয়ার পারদর্শিতা ইত্যাদি প্রয়োজন হয়। তবে এ সব মৌলিক দক্ষতা অর্জনের প্রক্রিয়ায় এক জন শিক্ষার্থীকে তখনই চালিত করা সম্ভব যখন বাণিজ্য, ব্যবসা ও স্ব-উদ্যোগের সামগ্রিক চর্চায় তার অভিমুখীকরণ বা ‘ওরিয়েন্টেশন’ ঘটে। আর বাণিজ্যের সঙ্গে তাদের যুক্ত করার এই পদ্ধতি অবশ্যই হতে হবে একাধারে ধারণাগত ও অভিজ্ঞতানির্ভর।

গ্রাম-বাংলার ছেলেমেয়েরা তবে কোন ভাবনা হাতিয়ার করে ব্যবসা বা স্টার্ট-আপের দিকে এগোবে? এক জন উদ্যোক্তার ভূমিকায় নিজেকে দাঁড় করাতে হলে বাজার ব্যবস্থা ও ‘চাহিদা-জোগান’এর অঙ্কের সঙ্গে সঙ্গে শ্রম নীতি ও শ্রম আইনের সঙ্গেও তাদের পরিচিত হওয়া দরকার। শ্রম-সংস্কৃতির বৃহত্তর প্রেক্ষিতে কর্মী নিয়োগকারী হিসেবে এক জন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, উৎপাদক বা উদ্যোক্তার আর্থ-সামাজিক অবদান কী— পড়ুয়াদের সে ধারণা থাকা বাঞ্ছনীয়। দেশ-বিদেশে উৎপাদকদের কোন নৈতিক পরিকাঠামো, আইনবিধি, সামাজিক পরিমণ্ডল এবং পরিবেশ সংরক্ষণ নীতির প্রতি সংবেদনশীল থেকে বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করতে হয়, তার তথ্যসমৃদ্ধ রূপরেখা এবং চেতনাগত শিক্ষা পঠনের আওতায় পড়ে।

উদাহরণ হিসাবে ধরা যায় বিশ্ব ন্যায্য বাণিজ্য দিবসের প্রসঙ্গ। ভারত সরকার নির্দেশিত অন্ত্রপ্রনরশিপ সংক্রান্ত অন্য বিশেষ দিনগুলি, যেমন উদ্যমী ভারত: ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি শিল্প দিবস (২৭ জুন), বিশ্ব উদ্যোক্তা দিবস (২১ অগস্ট), আন্তর্জাতিক নারী উদ্যোক্তা দিবস (১৯ নভেম্বর), জাতীয় ক্ষুদ্র শিল্প দিবস (৩০ অগস্ট) ইত্যাদি সম্বন্ধে জানলেও, ন্যায্য বাণিজ্যের ধারণাটি সাধারণ স্নাতক পড়ুয়াদের কিছুটা অজানা। বাজারে জিনিস কেনাবেচার সময় প্যাকেটের উপর ফেয়ার ট্রেড লেবেল দেখে নেওয়ার একটা রেওয়াজ আছে। বাণিজ্যে ন্যায্যতার ধারণাটা আসে একটা নির্দিষ্ট সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট থেকে। অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের শ্রমনির্ভর অনেক আন্তর্জাতিক শিল্প ও বাণিজ্য যেমন কফি, কোকো (চকলেট), হিরে বা রেডিমেড ব্র্যান্ডেড বস্ত্র উৎপাদন কারখানায় বহু ক্ষেত্রে শ্রমিকের অধিকার ও বিভিন্ন স্তরে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি উদ্বেগজনক এবং যথেষ্ট চর্চিত। আফ্রিকায় কোকো উৎপাদনে আইভরি কোস্ট ও ঘানার শিশু শ্রমিকদের দুর্দশা ‘স্লেভ-ফ্রি চকলেট’ ও ‘মেক চকলেট ফেয়ার’ আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু। আবার বাংলাদেশের জামাকাপড় তৈরির কারখানায় নানা অব্যবস্থা ও কাঠামোগত ত্রুটির কথা রানা প্লাজ়া দুর্ঘটনার সময় উঠে এসেছিল। তাই ন্যায্যতা নীতি হিসেবে গৃহীত হয়: ১) যে কোনও বৃহৎ বা ক্ষুদ্র উদ্যোগে শ্রমিকের কর্মজনিত অধিকারকে মর্যাদা দেওয়া; ২) লিঙ্গ-ধর্ম-জাতি-ভাষানির্বিশেষে তাঁদের সম মজুরি ও স্বাচ্ছন্দ্যকে নৈতিক স্বীকৃতি দেওয়া; ৩) শিশুশ্রম, বিপজ্জনক শ্রম, দাসত্ব বা শোষণনির্ভর উদ্যোগ প্রতিরোধ করা; এবং ৪) পরিবেশ ও প্রকৃতি সংরক্ষণের পরিপন্থী এমন উদ্যোগ শিল্পকে বর্জন করা। এই নীতিগুলো প্রয়োগের উদ্দেশ্যই হল সুস্থায়ী উন্নয়ন লক্ষ্যকে সুনিশ্চিত করা এবং উদ্যোগ শিল্পের পরিকাঠামো আরও মজবুত করা।

ন্যায্যতার সঙ্গে জড়িয়ে ন্যায়ের প্রশ্নও। জন রলস্ আ থিয়োরি অব জাস্টিস-এ ন্যায্যতাকে ন্যায়পরায়ণতা হিসেবে চিহ্নিত করে মানুষের মৌলিক স্বাধীনতা, সম্পদ ও সুযোগের সমবণ্টনের কথা বলেন। অন্য দিকে দি আইডিয়া অব জাস্টিস-এ অমর্ত্য সেন প্রাতিষ্ঠানিক ন্যায্যতার বাইরে গিয়ে বাস্তবিক অবিচারের প্রেক্ষাপটে মানুষের ব্যক্তিগত ক্ষমতায়নের মাধ্যমে ন্যায়নীতি কার্যকর করার প্রস্তাব দেন। স্ব-উদ্যোগ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ছাত্ররা এই বৃহত্তর নৈতিক ধারণাগুলোকে তাদের বাণিজ্যিক ভাবনার সঙ্গে যুক্ত করতে পারছে কি না তা সুনিশ্চিত করা অতি জরুরি। ‘এথিক্যাল ট্রেড’-এর মডেলে শ্রম ও উদ্যোগ শিল্পে ন্যায়নীতি পালন, মানবাধিকার ও শ্রমিকের অধিকার রক্ষা এবং উৎপাদন প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে পরিবেশ প্রকৃতিকে সংরক্ষণের বার্তা বাদ দিলে উদ্যোগমনস্কতার শিক্ষা অবশ্যই অসম্পূর্ণ।

নাড়াজোল রাজ কলেজ

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Students trade Education Skill Development Program

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy