Advertisement
E-Paper

স্বাধীনতার মানে!

সেই ছিদ্রান্বেষক স্বাধীনতার মধ্যে আর জিলিপি-শিঙাড়া দেখে না, ল‌জেন্স চাখে না, খেপের মাঠে ফুটবল পেটায় না। সে তখন ফিচার লেখে বিবিধ অপ্রাপ্তি নিয়ে। শিরোনাম দেয় — ‘ভাত দে হারামজাদা, নইলে মানচিত্র খাব!’

অনিন্দ্য জানা

অনিন্দ্য জানা

শেষ আপডেট: ১৭ অগস্ট ২০২৫ ০৭:৫৫
The ever changing meaning of freedom: from childhood to now

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

সত্যিই তো! কী মানে স্বাধীনতার? মানে কী?

স্কুলের ছোট ক্লাসের সময় স্বাধীনতার মানে ১৫ অগস্টে সাদা শার্ট-সাদা হাফ প্যান্ট, পায়ে সাদা কেড্‌স চড়িয়ে পাড়ায় প্রভাতফেরি, পাড়ারই পার্কে জাতীয় পতাকা তোলা, তার পরে শিঙাড়া-জিলিপি বা লজেন্স। কখনও সেই পোশাকে স্কুলে গিয়ে জাতীয় পতাকা এবং শিঙাড়া ইত্যাদি।

স্কুলের বড় ক্লাসের সময় স্বাধীনতার মানে এনসিসি-র নেভি উইং। চেরি ব্লসম দিয়ে ঝাঁ-চকচকে করা বুট, হিল্‌-এ ঘোড়ার খুরের মতো অর্ধচন্দ্রাকৃতি লোহার পাত ঠুকে বসানো। যাতে প্যারেডের সময় সম্ভ্রমসূচক টকাস-টকাস আওয়াজটা হয়। ব্রাসো দিয়ে ঘষা বেল্টের বাক্‌ল এবং ‘বেরে’ টুপির ‘ক্যাপ ব্যাজ’ (যেটা আয়না দেখে বাঁ চোখের ঠিক ভ্রুর উপর রাখতে হবে)। আবাসিক স্কুলের অডিটোরিয়ামের সামনের তিনকোনা রেলিংঘেরা জমিতে পোঁতা জাতীয় পতাকাটা যখন উত্তোলন করবেন বিশেষ অতিথি, তখন গলা সপ্তমে তুলে এবং মাপমতো দার্ঢ্য এনে গোটা প্যারেডকে কমান্ড করা।

কলেজের সময় স্বাধীনতার মানে সারা দিন এ মাঠ থেকে ও মাঠে ভরপুর কাদা মেখে ফুটবলের ‘খেপ’। শুরু সকাল ১০টা নাগাদ। শেষ বিকেল পেরিয়ে। মাঠের পাশে অপেক্ষমাণ মোটরবাইক। এক মাঠে খেলা শেষ হলে অন্য মাঠে নিয়ে যাবে। সে মাঠে খেলা শেষ হলে আবার অন্য মাঠে।

চাকরিজীবনের প্রথম দিকে স্বাধীনতা মানে এক বিরল ছুটির দিন। সেদিন অফিস যেতে হয় না। পরদিন খবরের কাগজ পাওয়া যায় না। স্বাধীনতার দিন সকাল থেকে পাড়ার বন্ধুদের সঙ্গে চায়ের দোকানে গুলতানি করে দুপুরে মাংস-ভাত খেয়ে কোলবালিশ জড়িয়ে ঘুম। সন্ধ্যায় আবার চায়ের ভাঁড় তাক করে কিছু রাজা-উজির মেরে ‘ছুটির দিনটা চলে গেল’ হা-হুতাশ করতে করতে বাড়ি ফিরে নিষ্ফলা গজগজের সঙ্গে পরদিন অফিস যাওয়ার জন্য তৈরি হওয়া।

চাকরিজীবনের কয়েক বছর কাটার পরে স্বাধীনতা মানে সংক্ষিপ্ত ছুটিতে কলকাতায় এলেও ৫০তম স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে দ্রুত পোঁটলা বেঁধে কর্তৃপক্ষ স্থানীয়দের সটান নয়াদিল্লির কর্মস্থলে চালান করে দেওয়া। হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারা যে, কাগজ ছুটি থাকলেও আমার ছুটি নেই। আমার স্বাধীনতা মানে ১৯৯৭ সালের ১৫ অগস্ট দেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে সংসদ ভবনের সেন্ট্রাল হল-এ লতা মঙ্গেশকরের দেশাত্মবোধক গান এবং তৎসহ বিবিধ কর্মকাণ্ড কভার করার অ্যাসাইনমেন্ট করেও সেদিন ডেসপ্যাচ না পাঠাতে হওয়ার বিরল বিলাসিতা।

চাকরিজীবনের আরও কিছু বছর যাওয়ার পরে স্বাধীনতা মানে এক্কেবারে চিনের প্রাচীর। ইয়ার্কি নয় কিন্তু! ২০০৮ সালের ১৫ অগস্টে অলিম্পিক্স কভারেজের অ্যাসাইনমেন্টে বেজিঙে। অলিম্পিক্সের ঠিক মাঝ বরাবর ১৫ অগস্ট। কিন্তু সেদিন কাগজ বন্ধ (ভাগ্যিস)। ভারতীয়দের কারও কোনও ইভেন্টও নেই। অতএব নোটবই-কলম সেদিনের মতো গুটিয়ে রেখে আদ্যন্ত ট্যুরিস্ট হয়ে ক্যামেরা-ট্যামেরা বাগিয়ে পৃথিবীর সাতটি আশ্চর্যের একটি চিনের প্রাচীরে সওয়ার।

সাংবাদিকের পেশায় আরও বেশ কিছুদিন অতিবাহিত করার পরে স্বাধীনতা মানে ভিতরে ভিতরে একটা ছিদ্রান্বেষীর জন্ম। যাকে মহামতিরা ‘সিনিক’ বলে বর্ণনা করে থাকেন। সেই ছিদ্রান্বেষক স্বাধীনতার মধ্যে আর জিলিপি-শিঙাড়া দেখে না, ল‌জেন্স চাখে না, খেপের মাঠে ফুটবল পেটায় না, দুপুরে মাংস-ভাত সাঁটিয়ে বালিশে মাথা রাখে না, পাড়ায় আড্ডায় নরক গুলজার করে না। সে তখন ফিচার লেখে স্বাধীনতার পরে বিবিধ অপ্রাপ্তি নিয়ে। শিরোনাম দেয় বাংলাদেশের কবি রফিক আজাদের ১৯৭৪ সালে লেখা কবিতার লাইন ধার করে— ‘ভাত দে হারামজাদা, নইলে মানচিত্র খাব!’

আরও কিছু বছর যাওয়ার পরে তার কাছে স্বাধীনতার মানে আরও বদলে যায়। তখন স্বাধীনতা মানে শপিং মলে ছয়লাপ তেরঙা। স্বাধীনতা মানে বিভিন্ন পণ্যের উপর মেলা ছাড়ের গন্ধ শুঁকে বেড়ানো। স্বাধীনতা মানে ফুরফুরে বর্ষায় একাকী লং ড্রাইভ। স্বাধীনতা মানে ট্রাফিক সিগন্যালে থেমে থাকা গাড়ির কাচ নামিয়ে নেহাতই দয়াপরবশ হয়ে কিনে ফেলা পুঁচকে স্ট্যান্ডে লাগানো তেরঙা জাতীয় পতাকা। স্বাধীনতা মানে টিভি-তে বেন কিংসলের ‘গান্ধী’, পরেশ রাওয়ালের ‘সর্দার পটেল’, অজয় দেবগনের ‘ভগৎ সিংহ’ অথবা ‘বর্ডার’। কিম্বা উপড়োনো টিউবওয়েল নিয়ে ষাঁড়ের মতো তেড়ে আসা সানি দেওল।

তা হলে স্বাধীনতার মানে কী? কী মানে?

স্বাধীনতা মানে দলিত যুবককে দলবেঁধে পিটিয়ে মারা। স্বাধীনতা মানে শিক্ষামন্ত্রীর বান্ধবীর বাড়িতে টাকার পাহাড় জমিয়ে রাখা। স্বাধীনতা মানে দলিত যুবতীকে গণধর্ষণ করে খুন করা। স্বাধীনতা মানে ফেসবুকে-টুইটারে যাকে ইচ্ছে যথেচ্ছ গাল দেওয়া, যার-তার নামে যা খুশি লিখে তাকে সমাজে বেইজ্জত করা। স্বাধীনতা মানে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভুল বানানে বিবিধ ‘হ্যাজ’ নামানো। স্বাধীনতা মানে সর্বসমক্ষে (ট্রেন, বাস, মেট্রো, এরোপ্লেন) বিনা হেডফোনে গাঁক গাঁক করে ‘রিল’ দেখা। স্বাধীনতা মানে সিনেমাহলে বসে পরিপার্শ্বের তোয়াক্কা না করে মোবাইলে টানা কথা বলে যাওয়া। স্বাধীনতা মানে বেলাগাম, বেসহবত এবং বেশরম ভিডিয়ো বানানো। স্বাধীনতা মানে তাঁদের বাঁ পায়ের কড়ে আঙুলের নখের যুগ্যি না হয়েও সমালোচনা বা বিরোধিতার নামে প্রধানমন্ত্রী বা মুখ্যমন্ত্রীকে প্রকাশ্যে ছাপার অযোগ্য ভাষায় কটূক্তি করা। স্বাধীনতা মানে রাতের অন্ধকারে সরকারি হাসপাতালের জরুরি বিভাগে উঠে গিয়ে কর্তব্যরত তরুণী চিকিৎসককে ধর্ষণ করে খুন করা। স্বাধীনতা মানে গুজব রটানো। স্বাধীনতা নামে সমাজমাধ্যমে গুজবকে ‘খবর’ বলে দাবি করা, বৈধতা দেওয়া। স্বাধীনতা মানে রাস্তাঘাটে চিৎকার করে কাউকে রোহিঙ্গা বলা। স্বাধীনতা মানে কেউ বাংলা ভাষায় কথা বললেই তাঁকে ‘বাংলাদেশি’ বলে দাগিয়ে দেওয়া। স্বাধীনতা মানে কর্তব্যরত পুলিশ অফিসারকে টেলিফোনে বাছা বাছা এবং কুৎসিত শব্দপ্রয়োগে সম্বোধন করা এবং তাঁর মা এবং স্ত্রীর জন্য বিশেষ নিদান শোনানো। স্বাধীনতা মানে ভোটের আগে কাঁচা টাকা বিলিয়ে ভোট কেনা। স্বাধীনতা মানে সততার বিগ্রহের ভেক ধরে নিজের বসবাসের জন্য দেশের রাজধানী শহরে বিপুল ব্যয়ে ‘শিশমহল’ তৈরি। স্বাধীনতা মানে অপ্রিয় প্রশ্ন পছন্দ না-হলে প্রশ্নকর্তাকে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার হুকুম দেওয়া। স্বাধীনতা মানে বিষয়বস্তু অপছন্দ হওয়ায় ফিল্মের সেটে ঢুকে পরিচালককে সপাটে চ়ড় কষানো। স্বাধীনতা মানে বিখ্যাত চিত্রকরের পেন্টিং অপছন্দ হলে প্রদর্শনীতে ঢুকে ভাঙচুর করা।

স্বাধীনতা মানে কী?

স্বাধীনতা মানে ক্রিকেট মাঠে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কেউ খারাপ পারফর্ম করলে এবং তিনি ধর্মে মুসলিম হলে গ্যালারি থেকে তাঁকে ধর্মীয় খেউড় করা। স্বাধীনতা মানে একটি শহরের যাবতীয় পথকুকুরকে ইচ্ছামতো খোঁয়াড়ে ভরে দেওয়া। স্বাধীনতা মানে বিদেশে কর্মরত গবেষককে বিমানবন্দর থেকে গ্রেফতার করে আদালতে হাজির করানোর পর তাঁকে আমেরিকান সেন্টার হামলার মূল চক্রী জঙ্গি আফতাব আনসারির সঙ্গে তুলনা করা। স্বাধীনতা মানে রাজনৈতিক খুঁটির জোরে স্থানীয় ফুটবল টুর্নামেন্টের ম্যাচে সিদ্ধান্ত পছন্দ না-হলে সটান মাঠে ঢুকে পড়ে আপাত-নির্বিরোধী এবং নিরীহ রেফারির মাজায় লাথি মারা। স্বাধীনতা মানে মনগড়া কাহিনিকে ‘ট্রু স্টোরি’ বলে সেলুলয়েডে চালানো। স্বাধীনতা মানে মিছিলে মরণাপন্ন রোগী বহনকারী অ্যাম্বুল্যান্স আটকে দেওয়া। স্বাধীনতা মানে আইনের ছাত্রীর কলেজতুতো দাদার দ্বারা কলেজের মধ‍্যেই ধর্ষিতা হওয়া আর সেই মুহূর্তগুলো অসহায় ভাবে ভিডিয়ো-বন্দি হতে দেখা। স্বাধীনতা মানে সরকারি হাসপাতালের মর্গের সামনে অকালমৃতা হতভাগিনীর দেহের দখল নেওয়ার জন‍্য দু’টি মূলস্রোতের রাজনৈতিক দলের বচসা আর হাতাহাতি। স্বাধীনতা মানে সামরিক উর্দি চাপিয়ে ভারতীয় সেনা তিন বাহিনীর তিন মহিলা অফিসারকে একটি বেসরকারি চ্যানেলের জনপ্রিয় গেম শো-য়ে দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ খ্যাতনামীর উল্টোদিকে নিয়ে গিয়ে বসানো।

পুনশ্চ: ভারতের স্বাধীনতার বয়স হল ৭৯ বছর। ধরে নিন এই বয়সে একটু মতিচ্ছন্ন হয়েছে। ওটাও স্বাধীনতা!

freedom Independence
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy