Advertisement
E-Paper

এই মৃত্যু উপত্যকা

মনে হয়, এই এক জনপদ, যা আপন কণ্ঠনালি বহু ভাবে ছিঁড়ে ফেলে কাঁদার চেষ্টা করে গিয়েছিল অনেক বার। সেই স্নায়ুহীন, দ্যুতিহীন অশ্রুময়তায় কোনও রেখা নেই, কোনও উচ্চারণ নেই।

ধ্বংসাবশেষ: হিন্দমোটর কারখানার বন্ধ হয়ে যাওয়া ফটক।

ধ্বংসাবশেষ: হিন্দমোটর কারখানার বন্ধ হয়ে যাওয়া ফটক। ছবি: কেদারনাথ ঘোষ।

বোধিসত্ত্ব ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ০৫:০৯
Share
Save

আমাদের পূর্বপুরুষ, পাড়া-প্রতিবেশীদের অনেকে এখানেই চাকরি করেছেন। এই এলাকায় সব বাড়িরই কেউ না কেউ চাকরি করেছেন এই কারখানায়। শিফ্ট শেষের ভোঁ বাজলে জায়গাটায় থিকথিক করত মানুষ। এই এলাকার তো শুধু এই কারখানাটা ছাড়া আর কিছু ছিল না।” কলকাতার কাছেই এক মফস্‌সলে বিকেলবেলায় দাঁড়িয়ে এই কথাগুলো বললেন মাঝারি উচ্চতার প্রণয় পাল। যে দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বললেন তিনি, সেই জায়গাটা শূন্য। যত দূর চোখ যায়, রাস্তাটা ফাঁকা। পড়ন্ত শীতের বিকেলের মিয়নো আলোর মধ্যেও এই রাস্তা মনে হয় কেবলই অন্ধকার হাতড়ে চলেছে!

সামনেই স্টেশন। ব্যস্ত। হাওড়া-ব্যান্ডেল, হাওড়া-বর্ধমান অহরহ! অথচ, স্টেশনের বাইরে ধ্বংসস্তূপ! মুখে চোখে আবছা সংসার নিয়ে চায়ের দোকানে কয়েক জন মানুষ। স্টেশন থেকে নামলেই শুরু রাস্তা। অযত্নে বেড়ে ওঠা গাছপালায় রাস্তার দু’পাশের জায়গাটা জঙ্গল। তার মধ্যে পরিত্যক্ত জলাশয়ের পাশে গলায় মালা দিয়ে একা বসে আছে এক পাগল। কী উপলক্ষহীন সেই বসে থাকা! শুধু চোখ ছাড়া আর কোনও ইন্দ্রিয়ই যেন জেগে নেই তার। ধূসর ও ধূসরতর হয়ে ওঠা বিকেলবেলায় হাওড়া মেন লাইনের ট্রেনের গতিতে কেঁপে ওঠা জলের দিকে তার তাকিয়ে থাকা দেখে মনে হয়, কত যুগ ধরে এই পাগল এক ভাবে খুঁজে চলেছে নিজের জন্ম ও মৃত্যু...

হিন্দমোটর!

১৯৪৮ সাল। দেশ ভাগ হয়ে যাওয়া স্বাধীনতাকে কী ভাবে গ্রহণ করবে, তা ভাবতে গিয়ে মনে মনে বিভক্ত হচ্ছেন মানুষ। পূর্ব পাকিস্তান থেকে কলকাতায় চলে আসছেন ভিটেমাটি হারানো মানুষ। কোথায় থাকবেন, কী করবেন— মনে এই সংশয় নিয়ে সন্ধের দিকে কোনও ফাঁকা জায়গায় বসে পড়লে তাড়া দিতে ছুটে আসে পুলিশ-ভ্যান। শহরের আশেপাশের বহু জায়গায় জমির দাম চারশো-পাঁচশো টাকা কাঠা। এ রকম একটা সময়েই ১৯৪২ সালে গুজরাতে শুরু হওয়া অ্যাসেম্বলি প্লান্টকে নিয়ে হুগলির উত্তরপাড়ায় চলে এল বিড়লা গোষ্ঠী। তৈরি হল স্বাধীন ভারতের সবচেয়ে বড় গাড়ি প্রস্তুতকারক ইউনিট। বাজারে এল ‘মরিস ১০’ সিরিজ়ের আদলে তৈরি ভারতীয় মডেল— ‘হিন্দুস্তান ১০’।

১৯৫১-৫২ সালে জওহরলাল নেহরু সাধারণ নির্বাচনে জয়ী হয়ে আসার পর ভারতের মাটিতে অটোমোবাইল শিল্পের কাঠামোর বিবর্ধনে জোর দেন। ভারতের মাটিতে সম্পূর্ণ ভারতীয় যন্ত্রপাতি দিয়ে তৈরি করতে হবে গাড়ি। ঠিক হয়, মহিন্দ্রা অ্যান্ড মহিন্দ্রা বানাবে জিপ। টেলকো তৈরি করবে ট্রাকের মতো ভারী গাড়ি। আর, হিন্দুস্তান মোটরস বাজারে আনবে ব্যক্তিগত প্রয়োজনে ব্যবহারের জন্য তৈরি চার চাকা গাড়ি, যার পোশাকি নাম ‘প্রাইভেট কার’। ১৯৫৭ সালে বাজারে এল সেই ‘প্রাইভেট কার’। অ্যাম্বাসাডর। যে গাড়ি দ্রুত, অতি দ্রুত হয়ে উঠল স্বাধীন ভারতের স্বাবলম্বী উচ্চাকাঙ্ক্ষার প্রতীক। মন্ত্রী-আমলা থেকে সম্পন্ন সাধারণ মানুষেরনির্বিকল্প বাহন।

স্বাধীন দেশের প্রথম বড় গাড়ি-কারখানা এই রাজ্যে। তাকে ঘিরে তৈরি হল জনপদ। রেল স্টেশন। একটা কারখানা মানে অনেক স্বপ্নের একত্র হওয়াও তো বটে। প্রচুর কর্মসংস্থান। যেখানে পরিচর্যা আছে। নিয়ম আছে। সামঞ্জস্য আছে। নানা অলঙ্করণ আছে। দুপুর, বিকেল, রাতের উপরে টাঙানো আছে আনন্দ ও উজ্জ্বলতা। গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকের শেষ থেকে যে ‘অ্যাম্বাসাডর’ বানানো শুরু হল, তার দাম সেই সময় ছিল প্রায় চোদ্দো হাজার টাকা! দেশের প্রধানমন্ত্রী থেকে রুপোলি পর্দার মহাতারকা— সকলেরই প্রিয় সেই সবেধন নীলমণি! হিন্দুস্তান কি জান, হিন্দুস্তান কি শান!

২০১৪ সালের মে মাসে বন্ধ হয়ে গেল সেই হিন্দমোটর। এক সময়ে যে গাড়ি নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিল গোটা দেশ, তার প্রথম কারখানাটিতে তালা পড়ে গেল। হাজারখানেক কর্মচারী কাজে যোগ দিতে এসে জানতে পারলেন, পরের দিন থেকে আর আসতে হবে না। নোটিস দিয়ে দিলেন কর্তৃপক্ষ। কারখানা যে ভাবে বন্ধ হয়ে যায়, সে ভাবেই। এই পশ্চিমবঙ্গ জানে, হুগলির পার্শ্ববর্তী বিস্তীর্ণ জনপদ জানে সেই বন্ধ হয়ে যাওয়ার ক্রিয়া-প্রক্রিয়া। তার পরও, হিন্দমোটর বন্ধ হয়ে যাওয়ার অভিঘাত কিঞ্চিৎ পৃথক। এ যেন এক বিস্তীর্ণ জনপদের হৃৎপিণ্ডের থমকে যাওয়া।

“আমরা আন্দাজ করতে পেরেছিলাম, কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে। তবে, সে দিনই যে হবে, তা জানতাম না। প্রোডাকশন বছরখানেক ধরে প্রায় কিছুই ছিল না। দেখতাম, যে গাড়িগুলো ডেলিভারির জন্য যেত, সেগুলো ফিরিয়ে দিচ্ছেন ভেন্ডররা। আগের দিন ডেলিভারি করা গাড়ি পরের দিন ফেরত চলে আসার পর স্ক্র্যাপ করে ফেলা হত। বেতনের কোনও ঠিক ছিল না। যদিও, ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর ম্যানেজমেন্ট আমাদের বকেয়া মিটিয়ে দিয়েছিল,” বললেন এক কালে হিন্দমোটরে ম্যানেজার হিসাবে কর্মরত হালদারবাবু। কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর প্রথমে একটি পেট্রল পাম্পে কাজ করতেন। এখন পশু হাসপাতালে সিকিয়োরিটির কাজ করেন। “যখন প্রথম হিন্দমোটরে চাকরি করতে আসি, তখন বন্ধুবান্ধব অন্য চোখে দেখত। এমনই ছিল এর মহিমা! কাউকে আর বলতে পারি না এখন কী কাজ করি। খুব লজ্জা লাগে। কিন্তু, বলতে লজ্জা লাগলেও পেট তো আর তা শুনবে না! তার জন্য কিছু তো করতে হবে। সংসারটাকে বাঁচাতে হবে তো।”

হিন্দমোটরের পথে পথে ঘুরলে, প্রতিটি রাস্তার দিকে প্রতিটি মুখের দিকে তাকালে নীরবে, এমনই আরও নানা মহাভার টের পাওয়া যায়। মনে হয়, এই এক জনপদ, যা আপন কণ্ঠনালি বহু ভাবে ছিঁড়ে ফেলে কাঁদার চেষ্টা করে গিয়েছিল অনেক বার। সেই স্নায়ুহীন, দ্যুতিহীন অশ্রুময়তায় কোনও রেখা নেই, কোনও উচ্চারণ নেই। পথের উপরে যে ভাবে পথ মিশে থাকে, সে ভাবেই হিন্দমোটরের যাবতীয় বেদনার ভার একা কাঁধে নিয়ে অতীতের সঙ্গে মিশে রয়েছে তার বর্তমান। অতীত যে আসলে বর্তমানেরই পুরনো অভ্যাস, এই শহরকে দেখলে তাও তো মনে পড়ে যায় নানা ভাবে!

প্রণয় পাল দেখাতে থাকেন এক সময়ের গমগম করা এমপ্লয়িজ় কোয়ার্টার। এখন তাদের শরীরে গাছ বেড়ে উঠেছে। ছালবাকল। অন্ধকারে ছোট লাফ দিয়ে পাঁচিল ডিঙিয়ে যাচ্ছে শিয়াল। হিন্দমোটরের কয়েক হাজার কর্মচারী থাকতেন এখানে। কোয়ার্টারের ভিতরেই ছিল বাজার, মাঠ, স্কুল। এক সময় এই কারখানায় কর্মী-সংখ্যা ছিল প্রায় বাইশ হাজার! সিংহভাগই পরিবার-সহ থাকতেন এই কোয়ার্টারগুলোয়। কারখানায় ক্রমাগত কর্মী সঙ্কোচন হওয়ার সময় কোয়ার্টারগুলো ফাঁকা হতে শুরু করে। এক সময় বন্ধ করে দেওয়া হয় বিদ্যুৎ ও জলের সরবরাহ।

১৯৮৬ সালে তেজস্ক্রিয় নির্গমনের ঘটনার জেরে খালি করে দিতে হয়েছিল ইউক্রেনের চের্নোবিল। যে অবস্থায় ছিলেন, সেই অবস্থাতেই ঘরদোর ফেলে রেখে চলে যেতে হয়েছিল বাসিন্দাদের। মাপে অতটা বড় নয় হয়তো, নেপথ্যের কারণটিও সম্পূর্ণ ভিন্ন, তা সত্ত্বেও, সামান্য হাসিতেও বুক কেঁপে উঠবে শীতের সন্ধের এমন পরিপূর্ণ অন্ধকারে শয়ে শয়ে ফাঁকা কোয়ার্টার, বাজার, ভলিবল কোর্ট, বন্ধ হয়ে যাওয়া স্কুল দেখে মনে হয়— সকলের অলক্ষ্যেই কারখানাহীন কর্মসংস্থানহীন রাজ্যে পরিত্যক্ত চের্নোবিল শহরের মতো টিকে রয়েছে স্বাধীন ভারতের প্রথম অটো হাব হিন্দমোটর।

হিন্দমোটরের ইতিহাস ও বর্তমান, কোনওটাই খুব অজানা নয়। কারখানা বন্ধ হয়ে গেলে পরিত্যক্ত জনপদ কেমন ভাবে বেঁচে থাকে, বেঁচে থাকতে পারে— এবং, তাকে আদৌ বেঁচে থাকা বলা যায় কি না— এই সব প্রশ্ন ও তার উত্তর পশ্চিমবঙ্গ বিলক্ষণ জানে। তবু, জানা কথা, চেনা কথাও বার বার মনে করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন কখনও কখনও। তাও এক ধরনের নাগরিক কর্তব্যই। অতীত গৌরবের বলেই বর্তমানের মালিন্য আরও বেশি করে চোখে পড়ে। সেই মলিনতা এতটাই তীব্র সত্য যে, মনে হয়, তাকে শুধু সত্যি বলে মেনে নিলেই সেই কর্তব্য শেষ হয়ে যায় না। অনুভবও করতে হয়।

পুরনো কারখানা পুরনো আস্তানাকে চোখের দেখা দেখবেন বলে বসিরহাট থেকে, মালদহ থেকে, রানাঘাট থেকে বছরে দু’তিন বার হলেও এখানে আসেন অমিত চট্টোপাধ্যায়, রাম বাহাদুর গুপ্ত, সুজিত জানার মতো বহু প্রাক্তন কর্মচারী। কেউ একা আসেন, কেউ ছোট দল বেঁধে। তাঁদের অনেকের বয়স আশি ছুঁইছুঁই। অতীতের দাঁত লাগা বাড়িঘর, রাস্তা, কারখানা নিয়ে সহজ আঘাতের মতো তাঁদের চোখের সামনে জেগে থাকে দৃশ্য-ছবি-গন্ধময় কর্মবহুল এক জনপদ। অলীক জেনেও তাঁরা কয়েক মুহূর্তের জন্য পোহাতে চান অতীতের কোনও উজ্জ্বল সকালের অন্তরঙ্গ রোদ— সেই জনপদে, যার মাটিতে ধুলোয় মিশে গিয়েছে কারখানার জন্য তৈরি রেলের দাগ। ২০২৫-এর ভূগোলে যার কোনও জায়গা নেই।

তাঁরা দেখতে থাকেন। কারখানা যাঁদের জন্য অপেক্ষা না করলেও, কারখানার জন্য অপেক্ষা করেছিলেন যাঁরা। শ্রমিকদের টাউন হিন্দমোটরের উপরে স্তব্ধ হয়ে থাকে জন্মান্তরের জ্যোৎস্না।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

industry Car Ambassador

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}