E-Paper

ঠিক কতখানি স্বাধীনতা ভাল

অর্থশাস্ত্রের প্রথাগত ধারণা অনুযায়ী, শীর্ষ ব্যাঙ্কের মূল কর্তব্য হল দেশে মূল্যবৃদ্ধির হার নিয়ন্ত্রণে রাখা। ব্যাঙ্ক এই কাজটি করবে সুদের হার আর টাকা ছাপানোর হার নিয়ন্ত্রণ করে।

পরন্তপ বসু

শেষ আপডেট: ২৪ নভেম্বর ২০২৫ ০৫:১৩

আমেরিকাতে বেকারত্বের হার বাড়তে শুরু করেছে। ট্রাম্পের আগ্রাসী আমদানি শুল্ক এবং তার সঙ্গে সরকারি অচলাবস্থার জন্য সমস্যা এখন গুরুতর। তিন মাস আগে অবধি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের উপর্যুপরি চাপের পরেও আমেরিকার শীর্ষ ব্যাঙ্ক ফেডারাল রিজ়ার্ভ-এর কর্ণধার জেরোম পাওয়েল সুদের হার কমাতে নারাজ ছিলেন। সেপ্টেম্বরে ফেডারাল ওপেন মার্কেট কমিটি সুদ কমাল ০.২৫%। অক্টোবরে দ্বিতীয় বার সুদ কমানো হল আরও ০.২৫%।

অর্থশাস্ত্রের প্রথাগত ধারণা অনুযায়ী, শীর্ষ ব্যাঙ্কের মূল কর্তব্য হল দেশে মূল্যবৃদ্ধির হার নিয়ন্ত্রণে রাখা। ব্যাঙ্ক এই কাজটি করবে সুদের হার আর টাকা ছাপানোর হার নিয়ন্ত্রণ করে। এই মুদ্রানীতির সাহায্যে শীর্ষ ব্যাঙ্ক মূল্যবৃদ্ধির হারকে ২% লক্ষ্যসীমায় রাখবে। যে হেতু শীর্ষ ব্যাঙ্ক টাকা ছাপাতে পারে, তাই তা হবে সকলের শেষ অবলম্বন ঋণদাতা। অন্য দিকে, সরকার জাতীয় আয়বৃদ্ধি, এবং বেকারত্বের সমস্যার দিকে নজর রাখবে রাজস্ব এবং সরকারি অনুদানের মাধ্যমে। যে প্রতিষ্ঠানগুলি উদ্ভাবনী শক্তির মাধ্যমে প্রযুক্তির উন্নতি সাধন করছে, সেগুলিকে সরকার কর ছাড় বা সরকারি অনুদান দেবে, যাতে দেশের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। এর বেশি কিছু সরকার করতে পারবে না।

পূর্ণ প্রতিযোগিতার জগতে শত পুষ্প বিকশিত হবে। শীর্ষ ব্যাঙ্ক শুধু মূল্যবৃদ্ধির রাশ নিজের হাতে রাখবে। এই ধ্রুপদী তত্ত্বের জগতে মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা অটুট রাখার জন্য শীর্ষ ব্যাঙ্কের পূর্ণ স্বাধীনতা প্রয়োজন। সুদ বা টাকা ছাপানোর সিদ্ধান্ত শীর্ষ ব্যাঙ্ক নেবে। সরকার এতে হস্তক্ষেপ করবে না। তবে ব্যাঙ্ক তাদের মুদ্রানীতি জনসাধারণের কাছে অস্বচ্ছ রাখতে পারবে না। খোলাখুলি জানিয়ে দিতে হবে আগামী দিনে ব্যাঙ্ক কত শতাংশ সুদের হার ধার্য করবে, আর কত টাকা ছাপাবে, যাতে মানুষের মনে মুদ্রানীতি নিয়ে কোনও বিভ্রান্তি সৃষ্টি না হয়। প্রশ্ন হল, শীর্ষ ব্যাঙ্কের মুদ্রানীতি প্রণয়নের কতখানি স্বাধীনতা সমাজের পক্ষে কল্যাণকর?

সম্প্রতি জন ককরেন দ্য ফিসক্যাল থিয়োরি অব দ্য প্রাইস লেভেল নামে একটি বই লিখেছেন, যার মূল প্রতিপাদ্য হল— সরকারি ব্যয় আর রাজস্ব নীতির সঙ্গে মূল্যবৃদ্ধির একটি নিবিড় সম্পর্ক আছে। বাজারে কোনও সংস্থার শেয়ারের দাম যেমন সেই প্রতিষ্ঠানের মুনাফার উপরে নির্ভরশীল, সরকারের ঋণপত্র বা বন্ডের মূল্যও তেমনই সরকারি বাজেটের ঘাটতি বা উদ্বৃত্তের সঙ্গে জড়িত। ঋণের বাজার যদি আঁচ করে যে, সরকারের ভাঁড়ারে ঘাটতি আসন্ন, তা হলে সরকারি ঋণপত্রের মূল্য কমতে শুরু করবে। এবং এর প্রভাব পড়বে দ্রব্যমূল্যের উপরে। ধরুন, আমি গত বছরে একটি সরকারি বন্ড কিনেছি দশ হাজার টাকা মূল্যে। বন্ডটির দশ বছরের মেয়াদ। তার ফেসভ্যালু হল এক লক্ষ টাকা, অর্থাৎ সরকার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে যে, দশ বছর বাদে বন্ডটি সরকারি তহবিলে জমা দিলে আমি এক লক্ষ টাকা পাব। এক বছর বাদে আমার মনে হল, সরকারের ভাঁড়ে ভবানী। তাই আমি বন্ডটি বেচে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমার মতো অনেকেই এক চিন্তা করলে, বন্ডটির বাজার মূল্য কমতে থাকবে। ধরুন, সেই বন্ডটি আজকের বাজারে পাঁচ হাজার টাকায় বিক্রি হল। যে বন্ডটির ফেসভ্যালু আর নয় বছর বাদে এক লক্ষ টাকা, তা আজ বিকোচ্ছে ৫০০০ টাকায়। অর্থাৎ নয় বছর বাদে ১০০,০০০ টাকার আজ মূল্য হল মাত্র ৫০০০ টাকা। অর্থাৎ, বন্ড মার্কেট বলছে যে, আগামী ন’বছরে বার্ষিক দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির গড় হার হবে ৩৯.৪৫%। বাজারে এই ধরনের মূল্যবৃদ্ধির প্রত্যাশার কারণ সরকারি কোষাগারে ঘাটতি হওয়ার ভয়। শীর্ষ ব্যাঙ্কের মুদ্রানীতি এবং সরকারের রাজস্ব নীতি তাই অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িত।

অন্য দিকে, সরকার যদি বাজেটে ঘাটতি মেটাতে জনসাধারণের কাছে ঋণপত্র না বেচে, শীর্ষ ব্যাঙ্কের কাছে হাত পাতে, তা হলে শীর্ষ ব্যাঙ্ককে নতুন টাকা ছাপিয়ে ঘাটতি মেটাতে হবে। এই পদ্ধতির নাম হল মনিটাইজ়েশন অব ডেট বা বাজেট ঘাটতির মুদ্রায়ণ। এর ফলে বাজারে অনেক টাকা ঘুরতে থাকবে, যা চাহিদা তৈরি করবে, কিন্তু সেই টাকা বিনিয়োগের মাধ্যমে উৎপাদনের জন্য ব্যয় না হলে, এই অতিরিক্ত চাহিদার জন্য মূল্যবৃদ্ধি হবে।

মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে সরকারি কোষের এই গভীর সম্পর্কের জন্য, শীর্ষ ব্যাঙ্ককে সরকারি শিবির থেকে আলাদা করে দেখা সম্ভব নয়। শীর্ষ ব্যাঙ্কের স্বাধীনতার তাই একটি সীমা আছে। তবে শীর্ষ ব্যাঙ্ক যদি সরকারের হাতের পুতুল হয়ে যায়, তা হলেও মুশকিল।

সরকার যদি নির্বাচনে জেতার জন্য পপুলিস্ট প্রকল্পে খরচ বাড়ায় বা বাণিজ্যিক কুমিরদের কর ছাড় দিয়ে, বাজেট ঘাটতি মেটানোর জন্য শীর্ষ ব্যাঙ্ককে বলে টাকা ছাপাতে, তা হলে তার বিরূপ প্রভাব পড়বে বাজারের উপর। সুতরাং, শীর্ষ ব্যাঙ্কের কিছু স্বাধীনতার অবশ্যই প্রয়োজন আছে।

অর্থনীতি বিভাগ, ডারহ্যাম ইউনিভার্সিটি।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

RBI Economy

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy