E-Paper

পার্ক বাড়ছে, কমছে মাঠ

কলকাতা শহরে গত এক দশকে খোলা জায়গার পরিমাণ প্রায় ৫৭% কমে দাঁড়িয়েছে মাথাপিছু ০.৬৫ বর্গমিটার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ মাথাপিছু ৯ বর্গমিটার।

প্রসেনজিৎ সরখেল

শেষ আপডেট: ২৮ মে ২০২৫ ০৬:০৫

এক বন্ধুর বাড়িতে সবাই মিলে ইউরোপিয়ান ফুটবল দেখা হচ্ছিল। মেসির ড্রিবল দেখে উচ্ছ্বসিত বন্ধুর সদ্য মাধ্যমিক-উত্তীর্ণ পুত্রটি। প্রশ্ন করলাম, “ফুটবল খেলিস?” টিভিতে চোখ রেখেই দু’দিকে মাথা নাড়ল সে। তার বাবা-মা আমাকে বোঝালেন, জয়েন্ট এন্ট্রান্স-এর প্রস্তুতি চলছে, বাবিনের সময় কোথায়? তবে বাবিন নিয়মিত জিম-এ যায়। ন্যাশনাল টাইম ইউজ় সার্ভে ২০১৯ জানিয়েছিল যে, বাবিন একা নয়— সমীক্ষার আগের এক দশকে ৬-১৬ বছরের শিশু-কিশোরদের পড়াশোনায় বরাদ্দ সময় বেড়েছে প্রায় ৩০%, একই সঙ্গে বেড়েছে দৃশ্যমাধ্যম (যেমন টেলিভিশন) দেখার সময়। এক ঘণ্টারও বেশি কমেছে কথা বলা আর খেলার মাধ্যমে অবকাশ যাপনের। এই সমীক্ষায় স্মার্ট ফোনসংক্রান্ত আলাদা কোনও প্রশ্ন ছিল না। তবে অ্যানুয়াল স্টেটাস অব এডুকেশন রিপোর্ট ২০২৩ সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে যে, গ্রামেও প্রতি দশ জন শিশুর ন’জন সমাজমাধ্যম ব্যবহারে অভ্যস্ত।

কলকাতা শহরে গত এক দশকে খোলা জায়গার পরিমাণ প্রায় ৫৭% কমে দাঁড়িয়েছে মাথাপিছু ০.৬৫ বর্গমিটার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ মাথাপিছু ৯ বর্গমিটার। স্কুল সম্পর্কে জাতীয় সমীক্ষা (ইউডাইস ২০২৩-২৪) অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গে তিনটি স্কুলের একটিতে নিজস্ব মাঠ নেই— গোটা দেশে প্রতি পাঁচটি স্কুলের একটি মাঠবিহীন। খেলার পরিসর ফিরিয়ে আনার বদলে নগরোন্নয়ন নীতি এখন জোর দিচ্ছে পার্ক তৈরিতে। ‘সৌন্দর্যায়ন’ প্রকল্পের দৌলতে কলকাতা পুর এলাকায় সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিতে তৈরি হওয়া পার্কের সংখ্যা দু’দশকে দেড়গুণ বেড়ে এখন দাঁড়িয়েছে ৭৫০। এক চিলতে সবুজ জমিতেও এখন কেয়ারি করা গাছ, বেঞ্চে বয়স্কদের আড্ডা, অপেক্ষারত অভিভাবকদের জটলা। বাহারি দোলনা আর স্লিপ বাঁচিয়ে সেখানে দৌড়-ঝাঁপ করাই কঠিন। পাড়ায় পাড়ায় যে ক’টি বড় মাঠ টিকে রয়েছে, সেগুলিও চলে যাচ্ছে ঘেরাটোপের আড়ালে। নির্দিষ্ট সময়ে সেখানে ক্যারাটে, ফুটবল বা ক্রিকেট প্রশিক্ষণ চলে। এ ছাড়াও বছরের অনেকটা সময় মাঠ জুড়ে চলে মেলা-উৎসবের আয়োজন। পাড়ার মাঠগুলি এখন ‘আয়ের উৎস’ হয়ে উঠছে পুরসভার কাছে।

পাড়ার মাঠের ব্যবস্থাপনা যখন অর্থমূল্যে নিয়ন্ত্রিত হয়, তখন সাধারণ ঘরের ছেলেমেয়েদের সুযোগ কমে যায়। কোচিং ক্যাম্প বা প্রাইভেট অ্যাকাডেমির ফি দেওয়ার বাধ্যবাধকতা বহু ছেলেমেয়েকে অলক্ষ্যে সরিয়ে দেয় খেলাধুলার চর্চা থেকে। তার প্রতিফলন মেলে ক্লাব বা জাতীয় স্তরের খেলার চিত্রে। ডার্বি ম্যাচের উৎসাহ মাথায় রেখে যদি ফুটবলের কথাই ধরা হয়, নজরে পড়বে যে, বড় ক্লাবগুলির প্রথম একাদশে বাংলার প্রতিনিধিত্ব তলানির দিকে। অথচ একটা সময়, যখন ক্লাব ফুটবলে চুক্তির টাকা নির্ভর করত কর্মকর্তাদের বদান্যতার উপর, তখনও দুই প্রধান দলের অধিকাংশ খেলোয়াড় পশ্চিমবঙ্গের নানা জেলার নিম্নবিত্ত পরিবার থেকেই আসতেন। এর প্রতিফলন মেলে সাহিত্যেও। মতি নন্দীর স্ট্রাইকার উপন্যাসের চরিত্র প্রসূন ভট্টাচার্য কিংবা স্টপার-এর নায়ক কমল গুহ, দারিদ্র ও অসম্মানের সঙ্গে লড়াই করে উঠে এসেছিল। নব্বইয়ের দশকের শেষে যখন ফুটবল ক্লাবগুলিতে সংগঠিত কর্পোরেট পুঁজি বিনিয়োগ শুরু হয়, তখন থেকে পরিস্থিতি বদলায়। এখন ইন্ডিয়ান সুপার লিগে আট অঙ্কের পারিশ্রমিকে চুক্তিবদ্ধ ফুটবলারের সংখ্যা কম নয়। তা হলে কি আর্থিক সচ্ছলতার সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও পরিকাঠামোর নাগাল না পেয়ে বাদ পড়ে যাচ্ছেন প্রতিভাময় কিশোর-কিশোরীরা?

আশার কথা, রাজ্যের জেলা-সদর থেকে দুর্মর আকাঙ্ক্ষায় ভর করে এখনও অনেক ছেলেমেয়ে উঠে আসেন ট্রায়াল ক্যাম্পে। কঠিন দারিদ্রের মোকাবিলা করে প্রীতম কোটাল, রবি হাঁসদা বা রুপান্তি মুন্ডার মতো কয়েক জন সাফল্যের মুখও দেখেন। কিন্তু এঁদের রূপকথা-সদৃশ উত্থানের গল্প সকলের মধ্যে পৌঁছে দিতে পারে, এমন খেলার পত্রপত্রিকাই বা কোথায়? খেলার মাঠে লোকাল হিরোদের অন্তর্ধানের সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে গিয়েছে স্থানীয় ভাষার ক্রীড়া পত্রিকাগুলিও।

শুধু মাঠের অভাব, বা প্রচারের অভাবই ক্রীড়া নিরাসক্তির কারণ নয়। গত কয়েক দশকের স্বাস্থ্য ভাবনা খেলাধুলার মধ্যে নিহিত শ্রমকে আলাদা করে দেখতে শিখিয়েছে। স্বাস্থ্যের এই ভাষ্যে, দৌড়ঝাঁপের প্রধান প্রয়োজন যেন শারীরিক সৌষ্ঠব বজায় রাখা। যা এক সময়ে ছিল ক্রীড়া দক্ষতার স্বাভাবিক অনুষঙ্গ, এখন তা-ই পরিণত হয়েছে মুখ্য উদ্দেশ্যে। জিমখানার বাতানুকূল প্রকোষ্ঠে, বেঞ্চ প্রেস করলে কত ক্যালরি খরচ হবে, সেই তথ্য এখন মুখে মুখে ফেরে। এই ফিটনেস উন্মাদনা সুকৌশলে আড়াল করে রাখে যূথবদ্ধ ক্রীড়ার স্বতঃস্ফূর্ত সুযোগের থেকে এক বিপুল অংশের বঞ্চনাকে। ট্রেডমিলে ধাবমান একাকী বাবিন বুঝতেই পারে না সে আসলে নির্বাসিত— সবুজ মাঠ থেকে, বেগবান ক্রীড়ার কৌশল-ভাবনার থেকে, তেকাঠির মধ্যে বল রাখার পরমুহূর্তের উত্তুঙ্গ আনন্দ থেকে।

কয়েক দশক আগেও পাড়ার মাঠগুলি ছিল কমবয়সিদের সামাজিক মেলামেশার অবাধ ক্ষেত্র। বড় মাঠ মানেই ফুটবল বা ক্রিকেট, আর ছোট জায়গায় চলত গাদি, পিট্টুর মতো দেশি নানা খেলা, যা আজকের গ্যাজেটমুখী, স্বল্পবাক প্রজন্ম প্রায় ভুলতেই বসেছে। পরিপাটি শহর গড়ে তুলতে গিয়ে আমরা কি তবে বিচ্ছিন্নতার জন্ম দিচ্ছি?

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

park Play Grounds

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy