E-Paper

জনসংখ্যা থেকে জনসম্পদ

জনসংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ে উৎকণ্ঠার উৎস ম্যালথাসের তত্ত্ব ছিল, জনসংখ্যা বাড়লে মাথাপিছু খাবার-সহ সব সম্পদ কমবে।

সুমিত মজুমদার

শেষ আপডেট: ০৬ জুন ২০২৩ ০৫:৫০
An image of the Population Clock

মুম্বইয়ের আন্তর্জাতিক জনসংখ্যা বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠানের ক্যাম্পাসে গেটের ঠিক সামনে লাগানো হয়ছে ‘পপুলেশন ক্লক’। —ফাইল চিত্র।

মুম্বইয়ের আন্তর্জাতিক জনসংখ্যা বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠানের ছোট্ট, ছিমছাম ক্যাম্পাসে গেটের ঠিক সামনে লাগানো আছে ‘পপুলেশন ক্লক’ (ছবি)। কিছু গাণিতিক মডেলের সাহায্যে প্রতি দিন মোটামুটি যা বলে দেয় দেশবাসীর সংখ্যা। তার লাল সংখ্যাগুলো দপদপ করে যেন হুঁশিয়ারি দিচ্ছে— ভারত এখন বিশ্বের সর্বাধিক মানুষের দেশ। রাষ্ট্রপুঞ্জের জনসংখ্যা বিভাগের হিসাব, এপ্রিলের শেষে ভারতের জনসংখ্যা ১৪২ কোটি ছুঁয়ে ছাপিয়ে গিয়েছে চিনকে। যদিও ভারতে সন্তান উৎপাদনের হার কমছে, তবুও অতীতের উচ্চ জন্মহারের প্রভাবে মোট জনসংখ্যা বেড়ে চলছে, চলবে আরও কয়েক দশক। ফলে আবার উঠেছে পুরনো প্রশ্ন— এ কি আশার কথা, না দুর্ভাবনার বিষয়?

জনসংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ে উৎকণ্ঠার উৎস ম্যালথাসের তত্ত্ব ছিল, জনসংখ্যা বাড়লে মাথাপিছু খাবার-সহ সব সম্পদ কমবে। এর বিপরীতে রয়েছে ‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড’-এর তত্ত্ব। যে কোনও দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে যদি আনুপাতিক হারে বাড়তে থাকে কর্মক্ষম মানুষদের সংখ্যা, তার সঙ্গে দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা যদি তৈরি করে উপযুক্ত কাজের সুযোগ, তা হলে মোট জাতীয় আয় বা উৎপাদন বৃদ্ধির সূচকও হবে ঊর্ধ্বমুখী, উন্নয়নের সুফল মিলবে ঘরে ঘরে।

বেশ কিছু জনবিদ্যা গবেষক, অর্থনীতিবিদেরা ফের সেই আশার কথাই শোনালেন: ভারতে জনসংখ্যার বিন্যাসে শিশু, বৃদ্ধদের তুলনায় কর্মক্ষম নবীন বেশি। তাদের সহজলভ্য শ্রম অর্থনীতির নানা ক্ষেত্রে আনতে পারে জোয়ার। আবার তাদেরই নিত্যনতুন চাহিদার সঙ্গে তাল মেলাতে উজ্জীবিত হতে পারে দেশের অভ্যন্তরীণ বাজার। নব্য-ধ্রুপদী ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির সমীকরণ বলে, এর ফলে দেশে আসবে ‘সবকা বিকাশ’। তবে সন্দেহ থাকে, বিনিয়োগ করেও আশানুরূপ লাভ বা ‘ডিভিডেন্ড’ পাওয়ার সম্ভাবনা কতটা?

যে কোনও দেশেই জনসাধারণের কর্মক্ষমতা বা উৎপাদনশীলতা নির্ভর করে মূলত দু’টি বিষয়ের উপর। প্রথমটি হল মৌলিক চাহিদা মেটানোর পণ্যগুলি উপযুক্ত পরিমাণে ও গুণমানে, সঠিক সময়ে এবং সুষম ভাবে পাওয়া। পুষ্টিকর খাদ্য, পরিস্রুত পানীয় জল, বাসস্থান, বয়সানুযায়ী শিক্ষা, চিকিৎসা ইত্যাদি এর মধ্যে পড়ে। এগুলিকে বলা চলে ‘জরুরি শর্ত’ (নেসেসারি কন্ডিশন)। দ্বিতীয়টি হল যোগ্যতা, পছন্দের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সব শ্রেণির জন্য কর্মসংস্থান। কিছু পেশা, নির্দিষ্ট সামাজিক গণ্ডির বাইরে বিপুল কর্মপ্রার্থীর জন্য যথেষ্ট কাজ সৃষ্টিকে বলা চলে যথেষ্ট শর্ত (সাফিশিয়েন্ট কন্ডিশন)। ‘সব হাতে কাজ’-ই হল জনসংখ্যা বৃদ্ধি থেকে লাভ (ডিভিডেন্ড) পাওয়ার পাসওয়ার্ড। মুশকিল হল, রাজনীতির কারবারিরা নির্বাচনী ইস্তাহারে কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতি দিলেও, পরে বাজার অর্থনীতির ধুয়ো তুলে দাবি করেন, কাজ সৃষ্টিতে সরকার অপারগ।

প্রায় যে কোনও নিম্ন বা নিম্নমধ্য আয়ের দেশে কর্মসংস্থানের সমস্যাগুলো মোটামুটি এক। কৃষিতে রোজগার কমছে, তরুণদের কাজে নিয়োগের হার নিম্নগামী, গ্রামীণ এলাকাগুলিতে কাজের অভাবে আশেপাশের শহরাঞ্চলে স্বল্প আয়ের দিনমজুরি, বা নির্মাণের মতো নানা ক্ষেত্রে ঠিকা-চুক্তিতে কাজ নিচ্ছেন মানুষ। ছোট বা মাঝারি শিল্পগুলি নির্দিষ্ট কিছু ভৌগোলিক অঞ্চলে সীমিত। অ্যাপ-ক্যাব বা শপিং মল-রেস্তরাঁর মতো পরিষেবায় কাজ মোটামুটি সহজলভ্য, কিন্তু সে সব কাজ অসুরক্ষিত, আর কর্মপ্রার্থীর ভিড়ও প্রচুর। এর কোনওটাই উজ্জ্বল ভবিষ্যতের ছবি তুলে ধরে না। লিঙ্গ-অসাম্য, জাত-ধর্মের সঙ্কীর্ণতার বাড়তি সমস্যাগুলিও রয়ে গিয়েছে। মফস্‌সলের কলেজ বা স্কুলশিক্ষক বন্ধুরা তাই আক্ষেপ করেন, সত্তর বা আশি শতাংশ ছাত্রছাত্রীদের ভবিষ্যৎ কী, তাঁরা দেখতে পাচ্ছেন না। জনসংখ্যা বৃদ্ধির ‘ডিভিডেন্ড’-এর সম্ভাবনা অলীক মনে হয়।

ঠিক এখানেই খোঁজ পড়ে সেই বহু ব্যবহারে জীর্ণ, কিন্তু অপরিহার্য বস্তুটির— রাজনৈতিক সদিচ্ছা। বৈষম্যদুষ্ট, মুমূর্ষু পৃথিবীর ক্ষয়িষ্ণু রসদের শেষটুকু নিঃশেষ করতে ব্যস্ত বাজার অর্থনীতিতে রাশ টেনে, সমীকরণটাকে ধীরে ধীরে বদলে ফেলা সম্ভব কেবল রাষ্ট্রের উদ্যোগে। অর্থনীতিবিদ মারিয়ানা মাজ়ুকাতো হিসাব করে দেখাচ্ছেন, সঠিক পরিকল্পনা-প্রসূত সরকারি ব্যয় বিশ্বের অর্থনীতিতে তেজি ভাব আনতে পারে। মুনাফামুখী বৃহৎ পুঁজির খামখেয়ালি প্রভাবের চাইতে তার রেশ অনেক দীর্ঘস্থায়ীও হয়।

ভারতের মতো জনবহুল দেশে অব্যবহৃত মানবসম্পদ কাজে লাগাতে সরকারকেই খেলা ঘোরাতে হবে। ছোট ও মাঝারি শিল্পগুলির পুনরুজ্জীবন ঘটাতে হবে, নানা জনমুখী পরিষেবায় উৎসাহ দিতে হবে। জলবায়ুর পরিবর্তনের সঙ্কটকে পরিণত করা যায় সম্ভাবনার ক্ষেত্রে— নানা রকম বিকল্প শক্তির উৎপাদন, বর্জ্য-পরিশোধন ইত্যাদি প্রকৃতিবন্ধু শিল্পে যথেষ্ট কর্মসংস্থান হতে পারে, পাশাপাশি সুযোগ থাকছে এই সঙ্কট মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক শক্তি হিসাবে ভারতের উঠে আসার।

এই উপায়গুলির মধ্যে কর্পোরেট-বিরোধী বৈপ্লবিক কোনও ভাবনা নেই— যা আছে তা কেবল বাস্তবমুখী, প্রকৃত কল্যাণকামী রাষ্ট্রের ভূমিকা পালন। যাঁদের হাতে নিয়ন্ত্রণের রাশ, তাঁরা উটপাখির মতো বালিতে মুখ গুঁজে বসে থাকলে বিপদ কেবল বেড়েই চলবে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

India's Population Population Density Population Control Resources

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy