E-Paper

যত্নআত্তির সীমারেখা

শিশুকে লালন-পালনের প্রক্রিয়া সব সমাজেই ব্যক্তিগত সম্পর্ক আর সামাজিক দায়িত্বের এক জটিল সংযোগে বাঁধা। সন্তানকে দত্তক গ্রহণ এই সম্পর্কের এক বিশেষ রূপ।

সুদেষ্ণা গোস্বামী

শেষ আপডেট: ১৩ নভেম্বর ২০২৫ ০৬:৪৫

অলিভিয়ার বয়স পনেরো। বৌদ্ধিক বিকাশের নিরিখে সে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু। বড় হচ্ছে দত্তক কন্যা হিসেবে। প্রতিপালক পিতা অলিভিয়াকে বুঝিয়েছেন, তার বয়স আসলে সাত বছর। ফলে অলিভিয়া বিশ্বাস করে যে সে সাত বছরের একটি মেয়ে এবং সেই অনুযায়ী আচরণও করে— বাথরুম ব্যবহার করার সময় দরজা খোলা রাখে। স্কুল থেকে ফিরলে বাবা তার পোশাক পরিবর্তন করে দেন, তার ক্লান্তি দূর করতে হাত-পা টিপে দেন। অলিভিয়ার কাছে এ সবই ‘স্বাভাবিক’। সে দক্ষিণ কলকাতার একটি বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের স্কুলে পড়ে। সম্প্রতি ক্লাসের সমাজকর্মী ও কাউন্সেলরের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে মেয়েটি এ সব তথ্য নিজেই জানিয়েছে। বেশ দৃঢ় ভাবে বলেছে, “আমার বয়স সাত বছর।”

প্রতিপালক পিতার স্নেহযত্নে খামতি নেই— তিনি চাকরি ছেড়ে দিয়ে বাড়িতে থাকেন যাতে মেয়েকে ‘মানুষ’ করতে পারেন। কেন তিনি সাত বছরের শিশুর মানসিক স্তরে অলিভিয়াকে বেঁধে দিয়েছেন, বোঝা কঠিন— হয়তো ছোট সন্তানের পরিচর্যার তৃপ্তির ক্ষুধা থেকে। কিংবা হয়তো অলিভিয়ার মতো এক কন্যার কৈশোর, যৌবনে পরিবর্তনের মোকাবিলা করার উপায় তিনি জানেন না। প্রতিপালক মা কর্মরত, দিনের বেশির ভাগ সময় তিনি বাড়ির বাইরে থাকেন। এই বাবা-মা খেয়াল করেননি, অথবা বোঝেননি যে, নিজের বয়স সম্পর্কে এই ভুল ধারণা (এজ ডিসফোরিয়া) অলিভিয়ার জীবনের এক বিপজ্জনক বিকৃতি।

শিশুকে লালন-পালনের প্রক্রিয়া সব সমাজেই ব্যক্তিগত সম্পর্ক আর সামাজিক দায়িত্বের এক জটিল সংযোগে বাঁধা। সন্তানকে দত্তক গ্রহণ এই সম্পর্কের এক বিশেষ রূপ। যখন গ্রহণ করা হয় এমন একটি শিশুকে যার বিশেষ শারীরিক বা মানসিক চাহিদা রয়েছে, তখন দত্তকগ্রহণ কেবল এক দম্পতির (বা ব্যক্তির) মানবিক উদ্যোগে সীমাবদ্ধ থাকে না। শিশুর মনস্তত্ত্ব বোঝার পাশাপাশি নিজেদের মানসিক গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে সচেতন হওয়ার নৈতিক দায়িত্বও বর্তায় অভিভাবকদের উপরে। একটি শিশুকে ঘরে আনা মানে কেবল তাকে আশ্রয় দেওয়া নয়, এটি এমন এক সিদ্ধান্ত যা পরিবার, আইন, সমাজ, সব কিছুর সঙ্গে সম্পৃক্ত। শিশুকে যেমন আপন করে নিতে হবে, তেমনই ঘনিষ্ঠতার সীমাও নির্ধারণ করতে হবে, এবং মেনে চলতে হবে। সামাজিক নিয়ম ও নৈতিক বোধের পরিসীমার মধ্যে ‘বন্ডিং’ এবং ‘বাউন্ডারি’-র ভারসাম্য বজায় রাখা চাই।

এই ‘বাউন্ডারি’ বা সীমারেখা বস্তুত শিশুটির সুরক্ষার ভিত্তি। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের আত্মরক্ষার ক্ষমতা সীমিত। তাদের যোগাযোগ প্রায়ই সঙ্কেত-নির্ভর, ভাষা অসম্পূর্ণ। ফলে তারা নিজের অস্বস্তি, ভয় বা বিপদ স্পষ্ট ভাবে প্রকাশ করতে পারে না। তাই ক্ষমতায় ভারসাম্যহীনতা তৈরি করে। যদি যথাযথ তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ না থাকে, তা হলে এই অসম সম্পর্ক নানা ভাবে শিশুর ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। বিশেষ চাহিদাসম্পন্নদের ‘চিরশিশু’ করে রাখার চেষ্টা এমনই একটি ঝুঁকি। বিশেষ শিশুর প্রকৃত বয়স অনুযায়ী তার সঙ্গে উপযুক্ত আচরণ করা উচিত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, শারীরিক বা মানসিক প্রতিবন্ধকতা সম্পন্ন শিশুদের উপর যৌন বা মানসিক নির্যাতনের হার সাধারণ শিশুদের তুলনায় তিন-চার গুণ বেশি।

বিশ্ব জুড়ে গবেষণায় দেখা গিয়েছে, পরিচর্যা বা ‘গ্রুমিং’ নামে পরিচিত প্রক্রিয়াটি অনেক সময় প্রথমে স্নেহ ও মনোযোগের মাধ্যমে শুরু হয়, ধীরে ধীরে নির্যাতনের পরিবেশ তৈরি করে। অনাবশ্যক স্পর্শ, নির্জনতা খোঁজা, বা শিশুর ব্যক্তিগত সময়ে অতিরিক্ত হস্তক্ষেপ, এ সবই অস্বাস্থ্যকর প্রবণতার লক্ষণ। এই কারণেই আধুনিক দত্তক নির্দেশিকায় বলা হয়েছে— শিশুর সঙ্গে একক ভাবে দীর্ঘ সময় থাকা উচিত নয়। পোশাক পরিবর্তনের মতো ব্যক্তিগত যত্নের ক্ষেত্রে সীমা মানতে হবে।

বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুকে দত্তক গ্রহণ করতে চায় যে পরিবার, তার সদস্যদের মানসিক প্রস্তুতির মূল্যায়ন প্রয়োজন। দত্তক নিতে ইচ্ছুক দম্পতির মানসিক ভারসাম্য, পারিবারিক সম্পর্ক, কাজের চাপ, অতীতের যৌন আচরণ ও আত্মনিয়ন্ত্রণ— সবই এই মূল্যায়নের অংশ। তাই প্রতিটি দত্তক প্রক্রিয়ায় ‘হোম-স্টাডি রিপোর্ট’ অপরিহার্য। ‘জুভেনাইল জাস্টিস (কেয়ার অ্যান্ড প্রোটেকশন অব চিলড্রেন) অ্যাক্ট’, ২০১৫-য় বলা আছে, দত্তক পরিবারকে নিয়মিত পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে, বিশেষ করে প্রথম দু’বছর। চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কমিটি এবং ডিসট্রিক্ট চাইল্ড প্রোটেকশন ইউনিট এই দায়িত্ব পালন করে।

শিশুর অস্বস্তির ইঙ্গিত কান্না, অকারণ চুপ থাকা, দৃষ্টি এড়ানো। এগুলো অবহেলা করা উচিত নয়। মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, দেহভাষা প্রায়ই শিশুর একমাত্র ভাষা। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুরা অনেক সময় বুঝেও উঠতে পারে না যে তার সঙ্গে কোনও অন্যায় ঘটছে। বাবা-মা, পরিবার, শিক্ষকদের দায়িত্ব হল শিশুর কথা শুনতে শেখা, পর্যবেক্ষণ করা, প্রয়োজনে স্পেশ্যাল এডুকেটর বা নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠানের সাহায্য চাওয়া। যদি আত্মীয়, প্রতিবেশী, শিক্ষক বা বন্ধুরা শিশুর অস্বাভাবিক পরিবর্তন দেখে চোখ ফিরিয়ে নেন, তা হলে কোনও আইনই তাকে রক্ষা করতে পারবে না।

দত্তক নেওয়া ‘উদ্ধার কার্য’ নয়। প্রতিপালকের অতিরিক্ত আবেগও শিশুর মস্তিষ্কে, মনে, ব্যবহারে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুর দত্তক আসলে একটি সামাজিক ও নৈতিক চুক্তি, যেখানে আবেগের পাশাপাশি যুক্তি, সংযম ও সজাগতা সমান ভাবে প্রয়োজন। শিশুর জীবন ব্যক্তিগত পরীক্ষা বা চাহিদা মেটানোর উপাদান নয়।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

parenthood child

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy