E-Paper

হত্যাপর্বই কি সঙ্কটের সমাধান

ডিআরজি ও বস্তার ফাইটার্স জঙ্গল অভিযানে মুখ্য হয়ে উঠেছে। মাওবাদীদের বিরুদ্ধে মাওবাদীদের নিজস্ব পদ্ধতিতে ‘ট্যাকটিক্যাল কাউন্টার অফেনসিভ ক্যাম্পেন’ শুরু করেছে এখন ছত্তীসগঢ়ের পুলিশ।

কিংশুক গুপ্ত

শেষ আপডেট: ১৬ জুন ২০২৫ ০৬:২৫
Share
Save

বছরের পর বছর ধরে ছত্তীসগঢ় যেন এক দীর্ঘস্থায়ী গৃহযুদ্ধের মানচিত্র। এক দিকে মাওবাদী গেরিলা বাহিনী, অন্য দিকে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা বাহিনী। মাঝখানে ফাঁদে পড়া সাধারণ মানুষ— যাঁদের উপর পড়ে দুই তরফের বলপ্রয়োগের চাপ। এই সংঘাতের পিছনে যেমন আছে জনজাতি মানুষের জমি, অধিকার, স্বপ্ন ও বঞ্চনার দীর্ঘ ইতিহাস, তেমনই রয়েছে রাষ্ট্রের দমনমূলক কৌশল ও প্রয়োজনে উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি। ২০২৩-এর ডিসেম্বরের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি ক্ষমতায় ফেরার পর, রাজ্যে ফের শুরু হয়েছে দমন অভিযান। তবে এই বার্তাটি আগের চেয়ে আরও আক্রমণাত্মক এবং প্রশাসনিক ভাবে ‘ক্লিন’ বলে দাবি করা হচ্ছে।

পুলিশ বাহিনীর দাবি, ২০২৪-এর গোড়া থেকেই তারা মাওবাদীদের ঘাঁটিতে প্রবেশ করতে পারছে— যেটা অতীতে কখনও ঘটেনি। পর পর একাধিক এনকাউন্টারে মৃত্যু হয়েছে অনেক শীর্ষ মাওবাদী নেতার, যার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য নম্বলা কেশব রাও ওরফে বাসবরাজু। এই সাফল্যের পিছনে বড় ভূমিকা নিচ্ছে ছত্তীসগঢ় পুলিশের বিশেষ বাহিনী— ‘ডিস্ট্রিক্ট রিজ়ার্ভ গার্ড’ (ডিআরজি) এবং ‘বস্তার ফাইটার্স’। এই দুই বাহিনী আদতে ভিতরের মানুষদের নিয়ে তৈরি— বহু ক্ষেত্রেই যাঁরা এক সময় মাওবাদী সমর্থক ছিলেন কিংবা জঙ্গল চেনা স্থানীয় যুবক যুবতী। ফলে গেরিলা কৌশল রপ্ত, এলাকা পরিচিত, ভাষা জানা— সব মিলিয়ে তাঁরা এই যুদ্ধে সুবিধাজনক অবস্থানে।

ডিআরজি ও বস্তার ফাইটার্স জঙ্গল অভিযানে মুখ্য হয়ে উঠেছে। মাওবাদীদের বিরুদ্ধে মাওবাদীদের নিজস্ব পদ্ধতিতে ‘ট্যাকটিক্যাল কাউন্টার অফেনসিভ ক্যাম্পেন’ শুরু করেছে এখন ছত্তীসগঢ়ের পুলিশ। হাতে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র, রাতভর ‘পেট্রলিং’ নজরদারি, মোবাইল টিমে দ্রুত গতিতে অভিযান চালানো— এ সব কৌশলে তারা ধীরে ধীরে জঙ্গল দখল শুরু করেছে। কোথাও মাইন উদ্ধার, কোথাও মাটিতে পোঁতা ‘আইইডি’-তে আগে থেকেই সতর্ক, আবার কোথাও হঠাৎ করে হানা দিয়ে মাওবাদীদের পিছু হটিয়ে দিচ্ছে। এই সমস্ত কিছুর মধ্যেই বড় প্রশ্ন রয়ে যাচ্ছে— এ ভাবে খতমের পর খতম ঘটিয়ে কি সত্যিই সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব?

কারণ, এই যুদ্ধের উৎপত্তি কেবল অস্ত্রধারীদের নিয়ে নয়। এর শিকড় আরও গভীরে। যখন কোনও অঞ্চল বছরের পর বছর ধরে স্বাস্থ্য পরিষেবা, শিক্ষার আলো, পানীয় জল ও রোজগারের সুযোগ থেকে বঞ্চিত থাকে, তখনই প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। ছত্তীসগঢ়ে এখনও দেশের মধ্যে শিশুদের অপুষ্টির হার উচ্চতম, সাক্ষরতার হার জাতীয় গড়ের নীচে, জনজাতিপ্রধান গ্রামগুলিতে রাস্তা পৌঁছয়নি বহু জায়গায়। ফলে সরকারি ক্যাম্প তৈরি হলেও, সেই ক্যাম্পের বাইরে ছড়িয়ে থাকা মানুষের জীবনে উন্নয়নের ছোঁয়া কতটা পৌঁছচ্ছে— তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।

বস্তারের অরণ্যে যে সব এলাকাকে প্রশাসন এখন বলছে ‘মাওমুক্ত’, সেই সব অঞ্চলের অনেকটাই কার্যত দিনের বেলা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে, আর রাতে মাওবাদীদের প্রভাব বিস্তার দেখা যায়। প্রশাসনের উপস্থিতি যে শুধু ‘পোস্ট’ তৈরি করলেই হয় না, তা একাধিক বার প্রমাণিত হয়েছে। চিকিৎসক নেই, শিক্ষক আসেন না, বিদ্যুৎ আসে না— এই সমস্ত অনুপস্থিতিই মানুষের অবিশ্বাসের ভিত্তি গড়ে তোলে। আর এই ফাঁকেই নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখে মাওবাদী শাসন।

তবে পাল্টে যাচ্ছে এক চিত্র। অনেক তরুণ এখন আর মাওপথে যেতে চান না। তাঁরা মূলস্রোতে ফিরতে চাইছেন। আত্মসমর্পণের সংখ্যা বেড়েছে। সরকার পুনর্বাসনের প্রকল্প চালু করেছে। কিন্তু বহু ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, যাঁরা আত্মসমর্পণ করছেন, তাঁরা বহু আগেই নিষ্ক্রিয় ছিলেন। আবার তাঁদের নিরাপত্তা ও জীবিকা এখনও অনিশ্চিত। ফলে অনেকেই আত্মসমর্পণ করলেও, অবিশ্বাস আর আতঙ্কের মেঘ এখনও কাটেনি।

এখানে রাজনীতিও বড় ভূমিকা নিচ্ছে। কংগ্রেস বলছে, তাদের আমলে রাস্তা, সেতু, রেশন ব্যবস্থার সংস্কার ও গ্রামীণ পরিকাঠামো উন্নয়নের কাজ হয়েছে। বিজেপি বলছে, তারা প্রশাসনকে নতুন কৌশলে সক্রিয় করেছে এবং গেরিলা কৌশলের মোকাবিলায় ডিআরজি-বস্তার ফাইটার্সকে সাজিয়ে মাঠে নামানো হয়েছে। কিন্তু জমির লড়াই, অধিকার লড়াই, আত্মপরিচয়ের লড়াই— এ সব প্রশ্নে দুই সরকারই অনেক সময়ে প্রতিক্রিয়াশীল থেকেছে।

ছত্তীসগঢ় খনিজে ভরপুর এক রাজ্য। লোহার আকরিক, বক্সাইট, কয়লার বিশাল ভান্ডার লুকিয়ে আছে মাটির তলায়। কিন্তু এই খনিজ আদায়ের অর্থনৈতিক চাকা কতটা জনজাতীয় জীবনে ঘোরে? কয়েকটি বড় শিল্পগোষ্ঠী এই অঞ্চল থেকে বিপুল সম্পদ আহরণ করছে, অথচ স্থানীয় মানুষ এখনও খিদে, রোগ, অনিশ্চয়তার মধ্যেই। এই বৈষম্যই মাওবাদকে টিকিয়ে রাখে।

লড়াই হয়তো শেষ হয়নি। রক্ত ঝরে চলেছে, আশা-নিরাশার টানাপড়েন চলছে। কিন্তু শান্তি যদি সত্যিই চাওয়া হয়, তবে তা আসতে পারে কেবল মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরির মধ্য দিয়েই। প্রশ্ন হল, সেই সম্পর্ক গড়ে তোলার সদিচ্ছা আদৌ আছে কি? যে গ্রামে চিকিৎসা নেই, শিক্ষার আলো নেই, যেখানে শিশুরা পুষ্টিহীন শরীরে বেড়ে ওঠে, সেখানে কেমন করে শোনানো যায় উন্নয়নের গান? একের পর এক ক্যাম্প বসিয়ে এলাকা ‘মাওমুক্ত’ ঘোষণার মধ্যে কি থাকতে পারে চিরস্থায়ী সমাধানের ছক?

যদি মানুষের বিশ্বাস গড়ে তুলতে হয়, রাষ্ট্রকে তবে দাঁড়াতে হবে আরও সংবেদনশীল, আরও দৃঢ় মানবিক ভূমিকার উপর। এই অরণ্যে কত শীত, কত বর্ষা গিয়েছে। বন্দুকের নলের মুখে দাঁড়িয়ে কত প্রজন্ম বড় হয়েছে। কত প্রজন্ম অভিভাবকহীন হয়েছে। তাই প্রশ্নটি হয়তো শুধু কত জন মাওবাদী খতম হল, তা নয়। প্রশ্ন হল, কত জন মানুষ স্বপ্ন দেখতে শিখল?

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

army police crpf

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে আপনার সাবস্ক্রিপশন আপনাআপনি রিনিউ হয়ে যাবে

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।